“এ বয়সে পিএইচডি করে ফেলেছেন–”
“পিএইচডি করা সোজা। বোঝাবুঝির ব্যাপার নেই। কামলার মতো পরিশ্রম করলেই অ্যাডভাইজার খুশি। আর অ্যাডভাইজার খুশি হলেই সবাই খুশি।”
“কী নিয়ে কাজ করেছিলেন?”
“মোটামুটি ইন্টারেস্টিং–”
তৃষা শামসকে থামাল, “একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“আমাদের সবার সামনে একটা প্রেজেন্টেশান দেন।”
“প্রেজেন্টেশান? এ জাহাজে? বেড়াতে এসে এ কী বিপদে পড়লাম!”
তৃষা হি হি করে হাসল। বলল, “না না, সে রকম প্রেজেন্টেশান না। আমরা আপনার সাথে বসলাম, একটু কথা বললাম। আপনি কিছু বললেন, আমরা কিছু বললাম, এ রকম আর কী। আড্ডার মতো। কোনো কুটনামি না করে আড্ডা দেওয়া আর কী।”
শামস হাসল, বলল, “ঠিক আছে।”
.
ঠিক এ রকম সময় রাতুল জাহাজের ছাদে সব বাচ্চাকে নিয়ে বসেছে। বাচ্চারা গোল হয়ে বসেছে, সামনে রাতুল গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বক্তৃতার মতো করে বলল, “একটু আগে আমাকে তোমাদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
বাচ্চারা আনন্দের মতো শব্দ করল। রাতুল বলল, “আমি তাদের কী বলেছি জান?”
“কী?”
“আমি বলেছি আমাকে একটা চাবুক দিতে হবে।”
বাচ্চারা আবার আনন্দের মতো শব্দ করল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “দিয়েছে?”
“এখনও দেয় নাই, দেবে।”
শান্ত বলল, “আমি হবো আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমাকে বলবেন কাকে চাবুক মারতে হবে, আমি মেরে দেব।”
“মনে হচ্ছে তোমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে।” সবাই হি হি করে হাসল। রাতুল বলল, “আর কী বলেছে জান?”
“কী?”
“বলেছে তোমরা যদি ভালো না হয়ে থাক, শান্ত না হয়ে থাক তা হলে আমাকে সুন্দরবনে রেখে আসবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্যে ব্রেকফাস্ট।”
মৌটুসি বলল, “তোমার চিন্তা করতে হবে না স্পাইডার ভাইয়া। আমরা সবাই খুবই ভালো হয়ে থাকব।”
“গুড।” রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমরা দেখি এ জাহাজে মজার মজার কী করতে পারি। কার কী আইডিয়া আছে বলো।”
রাজা বলল, “নাচানাচি করতে পারি।”
রাতুল অবাক হয়ে বলল, “নাচানাচি?”
“জে।”
“কী রকম নাচানাচি?”
“দেখাব?”
“দেখাও।”
রাজা উঠে দাঁড়াল, অন্য সবাই তাকে জায়গা করে দিল। রাজা তখন অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচা শুরু করে। পৃথিবীর কোনো নাচের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। বাচ্চারা রাতুলের মতো অবাক হল না, তারা সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে হাততালি দিতে লাগল। রাজা জিজ্ঞেস করল, “এই নাচ তুমি কোথায় শিখেছ?”
“একটা বিদেশিদের জাহাজে উঠেছিলাম সেইখানে।”
“লুকিয়ে?”
“জে।”
“তুমি তো দেখি মহা কামেল মানুষ!”
রাজা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, রাতুল মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, রাজার আরও গুণাবলি আছে, যেগুলো সে এখনও জানে না এবং ধীরে ধীরে সেগুলো প্রকাশ পেতে থাকবে।
রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা ট্রেজার হান্ট খেলতে পারি, ঠাণ্ডা গরম খেলতে পারি, মৌনী বাবা খেলতে পারি, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে খেলতে পারি, রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলতে পারি।”
টুম্পা জানতে চাইল, “রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা কেমন করে খেলে?”
“চোর-পুলিশের মতো। শুধু চোর-ডাকাতের জায়গায় হবে রাজাকার, আলবদর আর পুলিশ-দারোগার জায়গায় হবে মুক্তিযোদ্ধা আর সেক্টর কমান্ডার। খুবই সোজা।”
“ট্রেজার হান্ট কীভাবে খেলে?”
যখন সময় হবে তখন বলব। এখন চলো মৌনী বাবা খেলি।
মৌটুসি জানতে চাইল, “সেটা কেমন করে খেলে?”
“খুবই সোজা। কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। কথা না বলে কে কতক্ষণ থাকতে পারে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।” সবাই রাজি হল এবং হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। মনে হল ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া জাহাজে কোনো শব্দ নেই। অল্প ক’জন বাচ্চা এত শব্দ করে কে জানত?
.
রাত্রে খাওয়া শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করে সবাই আবিষ্কার করল কারও কিছু করার নেই। দিনের বেলা যখন আলো ছিল তখন জাহাজটাকে একরকম দেখাত, রাত্রে জাহাজটাকে কেমন জানি অপরিচিত মনে হতে থাকে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস তাই আর বাইরে কেউ নেই, কেবিনের মানুষজন কেবিনের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। অন্য সবাই ডেকে, সেখানে সবার জন্যে আলাদা আলাদা বিছানা। ডেকের পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে তারপরেও ভেতরে বেশ শীত। সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। রাতুল বাচ্চাদের সবাই শুয়ে পড়েছে কী না দেখে ফিরে যাচ্ছিল, তখন টুলু তাকে ডাকল, “স্পাইডার ভাইয়া, স্পাইডার ভাইয়া।”
“কী হল?”
“ঘুম আসছে না।”
“চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো, ঘুম চলে আসবে।”
“একটা গল্প বলবেন, প্লীজ?”
তখন একসঙ্গে অনেকে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল, “হ্যাঁ, প্লীজ। একটা গল্প বলেন।”
“গল্প? এখন?”
“হ্যাঁ।” রাতুল হাত নাড়ল, “আমি গল্প বলতে পারি না।”
টুম্পা বলল, “তা হলে আমি কেমন করে ঘুমাব? ঘুমানোর সময় আমার আম্মু আমাকে গল্প শোনায়।”
“তোমার আম্মুকে মিসকল দিব? ফোনে গল্প শুনিয়ে দেবেন?”
টুম্পা হাসল, “না, না স্পাইডার ভাইয়া। তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।”
“আমি গল্প বলতে পারি না।”
“পার পার। আমি জানি তুমি পার।”
কয়েকজন উঠে এবার রাতুলের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। রাতুল বাচ্চাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে চলে যেত কিন্তু ঠিক তখন সে তৃষাকে হেঁটে আসতে দেখল। তৃষা এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “গল্প! গল্প! স্পাইডার ভাইয়া গল্প বলবে।”