“হ্যাঁ।” তৃষা মাথা নাড়ল, “হ্যান্ডসাম মানুষ দেখলেই মনে হয় কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলি।”
রাতুল বলল, “খেয়ে ফেলি?”
তৃষা হাত তুলে রাতুলকে থামাল, বলল, “কথা বলিস না, শুনি হ্যান্ডসাম কী বলে?”
রাতুলও শুনল শামসও বলছে, “আমি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্কুল অব সিনেম্যাটিক আর্টে পিএইচডি করেছি।”
আলমগীর ভাই বললেন, “তার মানে তুমি শামস নও, ডক্টর শামস।”
ডক্টর শামস আবার বিদেশি কায়দায় কাঁধ ঝাঁকাল। আলমগীর ভাই বললেন, “তুমি এখন কী করছ বল।
“আমি ফ্লোরিডায় ছোট একটা ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছি। আমার ইন্ডিপেনডেন্টভাবে কাজ করার ইচ্ছা। কাজেই শেষ পর্যন্ত মাস্টারি করার ইচ্ছা নেই।”
তৃষা দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিশ্বাস বের করে বলল, “হ্যান্ডসাম শুধু চেহারায় হ্যান্ডসাম না, দেখেছিস? দেখে মনে হয় বাচ্চা ছেলে-”
“মোটেও বাচ্চা ছেলে মনে হয় না।” রাতুল বলল, “বেশ বয়স।”
“অবশ্যি বাচ্চা ছেলে মনে হয়। আমাদের থেকে বড়জোর তিন-চার বছর বেশি হবে। কিন্তু এর মাঝে পিএইচডি করে ইউনিভার্সিটির মাস্টার। বাপরে বাপ!”
“ওই দেশে তো আর সেশন জ্যাম নাই। যদি থাকত তা হলে দেখতাম।”
তৃষা কথার উত্তর দিল না। চোখ বড় বড় করে ডক্টর শামসের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতুল তৃষার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল। আজকেও সকালে তৃষা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সে আর তৃষা হচ্ছে বন্ধু। শুধু বন্ধু। তার জেলাস হওয়ারও অধিকার নেই!
পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই চা খেতে উঠে গেল, তখন তৃষা গলা উঁচিয়ে বলল, “ভলান্টিয়াররা যাবি না, এক মিনিট।”
গীতি বলল, “কেন?”
“দায়িত্বগুলো একটু নতুন করে ভাগাভাগি করি।”
যারা ভলান্টিয়ার তারা তৃষাকে ঘিরে দাঁড়াল। তৃষা বলল, “আমাদের রাতুল ছোট বাচ্চাদের খুব ভালো ম্যানেজ করতে পারে, তাই তাকে বাচ্চাদের দায়িত্বে দিয়ে দিই।”
রাতুল প্রবল বেগে মাথা নাড়ল, “না, না! সর্বনাশ! আমি মোটেও বাচ্চাদের ম্যানেজ করতে পারি না।”
“আমি নিজের চোখে দেখলাম–”
”কী দেখেছিস?”
“সব বাচ্চা তোর পিছে পিছে ঘুরছে। হ্যাঁমিলনের বংশীবাদকের মতো।”
“বাচ্চাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা এক জিনিস আর দায়িত্ব নেওয়া অন্য জিনিস।”
গীতি বলল, “তোমার দায়িত্ব হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা।” কথা শেষ করে সে হি হি করে হাসতে থাকে।
তৃষা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, তাদের ব্যস্ত রাখা।”
“আমাকে অন্য কোনো দায়িত্ব দে। টয়লেট পরিষ্কার হলেও আপত্তি নাই, কিন্তু বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব? অসম্ভব।”
তৃষা ভুরু কুঁচকে বলল, “মোটেও অসম্ভব না। তাদের ব্যস্ত রাখবি। গেম খেলতে দিবি। কোনো কাজে ব্যস্ত রাখবি।”
সজল নামের ছেলেটি বলল, “তা ছাড়া তুমি নিজে থেকে রাজার দায়িত্ব নিয়েছ। মনে আছে?”
“হ্যাঁ।”
“একজন রাজার দায়িত্ব যদি নিতে পার তা হলে এক ডজন প্রজার দায়িত্ব নিতে সমস্যা কী?”
গীতি আবার হি হি করে হাসতে থাকে। সজল তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেবিনের গেস্টদের দায়িত্বে আমার সঙ্গে আর কাউকে দিতে হবে।”
“কেন?”
“তাদের সবসময়ই কিছু না কিছু লেগেই আছে, চা দাও, কফি দাও, মশার কয়েল দাও, সিগারেট দাও, ম্যাচ দাও, খবরের কাগজ দাও।”
তৃষা বলল, “হ্যাঁ, সকালে দেখলাম তুই ঝাড় নিয়ে ঘুরছিস!”
“একজনের ঘরে না কী গোবদা একটা মাকড়সা। তিনি আবার মাকড়সাকে ভয় পান। সেটাকে মারতে হবে।”
“মেরেছিস?”
“ধুর! মাকড়সা মারা কী এত সোজা না কি। পালিয়ে গেছে। আমি বলেছি মেরেছি।”
“আবার যখন হাজির হবে?”
“যখন হাজির হবে তখন দেখা যাবে।”
“কী বলবি তখন?”
“বলব আগেরটার গার্লফ্রেন্ড এসেছে।”
সজল বলল, “কিন্তু আরেকজন দরকার আমার। আমি একা ম্যানেজ করতে পারছি না।”
তৃষা বলল, “ঠিক আছে, আমি থাকব তোর সঙ্গে।”
.
সাত নম্বর কেবিনটি সিঙ্গেল কেবিন, জানালায় গালে হাত দিয়ে শামস বসে ছিল, তৃষা থেমে গেল, “একা একা বসে আছেন?”
শামস হাসার চেষ্টা করল, “কী করব? তোমরা এই জাহাজে হয় বেশি বুড়ো না হয় বেশি বাচ্চা এনেছ।”
“আমি কোন ক্যাটাগরিতে পড়েছি? বুড়া না বাচ্চা?”
“তুমি ঠিক আছ। কিন্তু তোমরা এত ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছ, তাই ডিস্টার্ব করছি না।”
“মোটেও ব্যস্ত না। ব্যস্ত থাকার ভান করি, তা না হলে কেউ গুরুত্ব দেয় না।”
“সেটাও তো একটা কাজ।”
তৃষা সুর পাল্টাল, “চা খাবেন?”
“খেতে পারি।”
“দুধ-চিনি?”
“দুধ নো। চিনি ইয়েস।”
“আপনি বসেন, নিয়ে আসি।”
“ছিঃ ছিঃ। তুমি কেন আনবে। আমি আনছি।” শামস বের হওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল।
তৃষা হাসার ভঙ্গি করল, “আপনারা এত গুণী মানুষ, আপনাদের চা খাওয়াতে পারাই আমাদের সৌভাগ্য।”
“কেন আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ?”
“ঠাট্টা না। সত্যি কথা।”
“থাক এত সত্যি কথা বলে কাজ নেই।”
নিচে নেমে প্লাস্টিকের কাপে গরম পানি, টি ব্যাগ ও চিনি দিয়ে তৃষা বলল, “সস্তা চা খেতে পারবেন তো?”
“আমি এমন কিছু খুঁতখুঁতে মানুষ না। গরম হলেই হল।”
শামস চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি কী কর?”
“ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।”
“কোন সাবজেক্ট?”
“ফিজিক্স।”
শামস ভয় পাওয়ার ভান করল, “বাবারে বাবা। ফিজিক্স-ম্যাথমেটিক্স খুব ভয় পাই।”
“ঠাট্টা করছেন?”
“কেন ঠাট্টা করব? আসলেই ম্যাথ, ফিজিক্স এগুলো ভয় পাই।”