ছোটরা চিৎকার করে নিজেদের মতো উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে থাকে, বড়রা হাসি হাসি মুখে বসে থাকে। আলমগীর ভাই এক-দুইজনের কথা শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “হয় নাই। আমাদের উদ্দেশ্য খুব সহজ। যে কয়জন যাচ্ছি ঠিক সেই কয়জন ফিরে আসা! আমরা কাউকে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাবার হিসেবে রেখে আসতে চাই না। বুঝেছ?”
সবাই হি হি করে হেসে মাথা নাড়তে থাকে। আলমগীর ভাই বললেন, “এবার আমরা পরিচয় পর্ব সেরে নিই। অনেকে অনেককে চেনে আবার অনেকে চেনেও না। এই হচ্ছে সুযোগ, সবাই সবার পরিচয় দেবে।”
রাতুল ভেবেছিল পরিচয় পর্বটা হবে একঘেয়ে আর বিরক্তিকর কিন্তু দেখা গেল সেটা মোটামুটিভাবে উপভোগ্যই হল। টেলিভিশনে অত্যন্ত সুন্দর অভিনয় করে একটি মেয়ে, নাম শারমিন, খুব সুন্দর চেহারা। কিন্তু মুখ ফুটে কথাই বলতে পারে না। তার পাশেই সবসময় বসে আছেন তার মা, তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হয় তিনি তার মেয়েকে চোখে চোখে রাখছেন পাছে কেউ তাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায়। নাট্যকার বাতিউল্লাহ একটু জোকার টাইপের, সাধারণভাবে কথা বলতেই পারেন না, প্রত্যেকটা কথার মাঝেই একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দেন। কবি শাহরিয়ার মাজিদ নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, “আমি শব্দের কারিগর। একটা অতি সাধারণ শব্দের পাশে আরেকটা অতি সাধারণ শব্দ এমনভাবে এনে দাঁড় করিয়ে দিই যখন দুটো শব্দই হঠাৎ করে অসাধারণ হয়ে ওঠে।” রাতুল তার কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বলল, “আহারে! ন্যাকামো দেখে মরে যাই!” একজন হচ্ছেন চিত্রপরিচালক, নাম আজাদ আজাদ–এ রকম নাম রাতুল জন্মেও শোনেনি। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে চলচ্চিত্র জগতের সংকটের ওপর একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। কিছু কিছু মানুষ খুবই নার্ভাস টাইপের, উঠে দাঁড়িয়ে শুধু নামটা বলতে গিয়েই ঘেমেটেমে একসার। ভলান্টিয়ার একটা মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, নাম গীতি, কথায় কথায় হাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসি খুবই সংক্রামক একটা বিষয়, তার হাসি শুনে অন্যরাও হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। নিজের পরিচয় দেওয়ার বেলায় ছোট বাচ্চাদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি, তারা সবাই নিজেদেরকে জুনিয়র ভলান্টিয়ার হিসাবে দাবি করতে থাকে। রাতুল জানতে পারল, সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটির নাম হচ্ছে শান্ত–এ রকম ভুল নামকরণ না কী পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জানা গেল টুম্পা নামে আরেকজন বাচ্চা ভলান্টিয়ার গত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রধান অতিথিকে বাথরুম দেখাতে নিয়ে গিয়ে ভুল করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল। টুলু অতিথিদের চা এনে দিতে গিয়ে একজন স্পন্সরের কোলে গরম চা ফেলে দিয়েছিল–এ তথ্যগুলোর সব পুরোপুরি সত্য নয়–কিছু কিছু অতিরঞ্জিত কিন্তু দেখা গেল সবাই সেগুলো নিয়ে হইচই করতে পছন্দ করে।
সবার সাথে রাজাকেও তার পরিচয় দিতে বলা হল। সে নিজে থেকে কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু প্রশ্ন করে করে যে উত্তর পাওয়া গেল তা অসাধারণ। যেমন–তারা তিন ভাই এবং অন্য দুজনের নাম বাদশা এবং সম্রাট। তার দুজন বোন যথাক্রমে রানী এবং রাজকইন্যা। নামগুলো রেখেছেন তার বাবা এবং বাবা দীর্ঘদিন থেকে পলাতক। সংসারে চাপ কমানোর জন্যে সে নিজেও পলাতক। অন্যদের কথা তার বেশি মনে পড়ে না কিন্তু ছোট বোন রাজকইন্যার জন্যে তার মাঝে মাঝেই ‘পেট পোড়ে। সুন্দরবন এবং বান্দরবান ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় পুরোটাই দেখে ফেলেছে সে। সাধারণত ট্রেনের ছাদে বসে সে দেশ ভ্রমণ করে, থাকা এবং খাওয়া নিয়ে সে চিন্তা করে না। কোনো না কোনোভাবে তার ব্যবস্থা হয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি তার কখনও না খেয়ে থাকতে হয়নি। অ আ ক–এ রকম তিন-চারটা বাংলা অক্ষর সে পড়তে পারে। ইংরেজি পড়তে পারে না কিন্তু ‘নো ফুড মি হাংগ্রি টেন টাকা’ এ রকম তিন-চারটা ইংরেজি বাক্য বলতে পারে।
রাজা তার পরিচয় দেওয়ার পর অন্য সবার পরিচয় রীতিমতো পানশে মনে হতে থাকে। এলোমেলো চুলের একজন কম বয়সী সুদর্শন ছেলের পরিচয়ও খুব সাদামাটাভাবে শেষ হয়ে যেত কিন্তু আলমগীর ভাই সেটাকে আকর্ষণীয় করে দিলেন। ছেলেটা দাঁড়িয়ে বলল, “আমার নাম শামস। আমি দেশের বাইরে থাকি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কথা শুনে চলে এসেছি।” শামস নামের ছেলেটা বসে যাচ্ছিল, আলমগীর ভাই তাকে বসতে দিলেন না, বললেন, “কী হল, আরও একটি-দুটি কথা বলো নিজের সম্পর্কে।”
“কী বলব?”
“তোমার ফিলের কথা বলো, অ্যাওয়ার্ডের কথা বলো, ইউনিভার্সিটির কথা বলো।”
ছেলেটা একবার কাঁধ ঝাঁকালো, রাতুল বিদেশি সিনেমায় অভিনেতাদের এ রকম কাঁধ ঝাঁকাতে দেখেছে, দেশে কখনও দেখেনি। শামস নামের ছেলেটা বলল, “আমি প্রিন্সেস নামে একটা শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলাম, গ্রিন আর্থ নামে একটা ছোটখাটো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।”
তৃষা রাতুলের দিকে ঝুঁকে বলল, “ছেলেটা কি হ্যান্ডসাম, দেখেছিস?”
রাতুল বলল, “হ্যান্ডসাম? তুই এর মাঝে হ্যান্ডসাম কী দেখলি। চেহারাটা কী রকম জংলি জংলি।”
“জংলি?” তৃষা রীতিমতো রেগে উঠল, “কী ম্যানলি চেহারা। মনে হয় কচ করে খেয়ে ফেলি।”
রাতুল চোখ কপালে তুলে বলল, “কি বললি? কচ করে খেয়ে ফেলি?”