খালাসিটা এ কথা শুনে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, বাচ্চাটার ঘাড় ধরে চিৎকার করে বলল, “কী, কী কইলি হারামজাদা? সুন্দরবন যাবি? শখ দেখে বাঁচি না।”
রাতুল ছেলেটাকে মুক্ত করে বলল, “তুমি আমাদের সাথে সুন্দরবন যেতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
তাদের ঘিরে একটা ছোটখাটো ভিড় হয়েছে, সেখান থেকে এবার একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। খালাসিটা আবার এগিয়ে আসে, বলে, “আয় আমার সাথে, তোরে আমি এক লাথি দিয়া সুন্দরবন পাঠামু।”
রাতুল বলল, “আপনি কী বলছেন এসব? ছিঃ।”
“আমার হাতে দেন, আমি এর ব্যবস্থা করি।”
“কী ব্যবস্থা করবেন?”
“জাহাজ থামায়া কোনো একটা নৌকাতে তুলে দেব।”
“নৌকায় তুলে দেবেন? তারপর?”
“নৌকা ওরে পাড়ে নামায়া দেবে।”
“তারপর সে কেমন করে সদরঘাট যাবে?”
“সেইটা আমার চিন্তার ব্যাপার না। সেইটা এই হারামজাদার চিন্তা।”
ওদের ঘিরে থাকা মানুষগুলোর ভেতর থেকে কে যেন বলল, “ওরা স্ট্রীট স্মার্ট–নিজেরা ম্যানেজ করে নেবে।”
“পথশিশু যে রকম থাকে এরা হচ্ছে সে রকম জলশিশু।” রাতুল তাকিয়ে দেখল কবি শাহরিয়ার মাজিদের মুখে এক ধরনের স্নিগ্ধ হাসি, সেই হাসিটাকে আরও বিস্তৃত হতে দিয়ে বললেন, “এই জলশিশু এক জলযান থেকে অন্য জলযানে করে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।”
রাতুল সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চা একটা ছেলে আমাদের সাথে সুন্দরবন যেতে চাচ্ছে, একে নিয়ে গেলে সমস্যা কী?”
সবাই চুপ করে রইল, শুধু খালাসিটা মাথা নেড়ে বলল, “না। না।”
রাতুল বলল, “একজন মানুষ, কী আসে যায়?”
কবি শাহরিয়ার মাজিদের মুখের স্নিগ্ধ হাসি হঠাৎ করে উবে গেল, মুখ সূঁচালো করে বললেন, “এদের প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। জাহাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে নৌকায় তুলে দেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।”
রাতুলের ইচ্ছে হল বলে, “এই শিশুদের বেলায় আপনি স্পর্শকাতর নন? এর সুকুমার মনোবৃত্তি বিকাশ নিয়ে আপনার কোনো দুর্ভাবনা নেই?” কিন্তু সে কিছুই বলল না।
এ রকম সময় আলমগীর ভাই এসে ভিড় ঠেলে ঢুকলেন। তার মেয়ে মৌটুসি গিয়ে বাবার হাত ধরে তাকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল।
আলমগীর ভাই মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিক আছে।”
তৃষা বলল, “আলমগীর ভাই, এই ছেলেটা লুকিয়ে জাহাজে উঠে গেছে–”
“শুনেছি, লুকিয়ে না উঠে এর কী অন্য কোনোভাবে ওঠার উপায় আছে?”
“তা নেই। কিন্তু—”
”কিন্তু কী?”
“জাহাজের লোকজন ওকে একটা নৌকায় নামিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
আলমগীর ভাই বললেন, “কিন্তু আমার মেয়ে বলছে ওকে নিয়ে নিতে। কী বল?”
রাতুল কথাটা লুফে নিয়ে বলল, “আমিও তাই বলছি। বাচ্চা একটা ছেলে সুন্দরবন যেতে চাইছে–”
“ঠিক আছে তা হলে।” আলমগীর ভাই ছেলেটার দিকে তাকালেন, “তোমার নাম কী?”
“রাজা।”
“একেবারে রাজা? মন্ত্রী-কোটাল না?”
বাচ্চাটা থতমত খেয়ে বলল, “না। রাজা।”
“তুমি যাবে আমাদের সাথে, কিন্তু কোনোরকম দুষ্টুমি করতে পারবে না। আমাদের কথা মেনে চলতে হবে। ঠিক আছে?”
ছেলেটার এগাল থেকে ওগাল জোড়া হাসি ফুটে ওঠে, “ঠিক আছে।”
রাতুল খুশি খুশি গলায় বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে দেখে রাখব।”
কবি শাহরিয়ার মাজিদ একটা নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললেন, “কাজটা ঠিক হল না।”
রাতুল কথাটা না শোনার ভান করে ছেলেটাকে বলল, “রাজা।”
“জে।”
“তুমি শেষবার কবে গোসল করেছ?”
“জে, আমি পেরতেক রোজ গোসল করি।”
“গোসল করার কথা পানি দিয়ে। তুমি নিশ্চয়ই আলকাতরা দিয়ে গোসল কর?”
“জে না–”
তৃষা বলল, “বুড়িগঙ্গার পানি দিয়ে গোসল করা আর আলকাতরা দিয়ে গোসল করার মাঝে কোনো পার্থক্য নাই।”
রাতুল বলল, “তোমাকে অন্তত একবার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে আমার সামনে।”
“জে, করব।”
“তার আগে খেয়ে নাও।”
মৌটুসি দাঁত বের করে হেসে বলল, “ঘাসের বিচি আর ডাইনোসরের মাংস। তাই না স্পাইডার ভাইয়া?”
রাতুল মাথা নাড়ল, চোখের কোনা দিয়ে দেখল কবি শাহরিয়ার মাজিদ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যাচ্ছেন।
.
রাজাকে গোসল করানোর সময় বাচ্চাদের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত থাকল। দড়ি লাগানো বালতি দিয়ে রাতুল নদী থেকে পানি তুলে রাজার মাথায় ঢালতে লাগল আর রাজা প্রবল বেগে সারা শরীরে সাবান মেখে গোসল করতে লাগল। গোসল করার পর তৃষা তাকে একটা টি-শার্ট দিল, বাচ্চাদের ভেতর থেকে একটা প্যান্ট খুঁজে বের করা হল। পরিষ্কার কাপড় পরার পর দেখা গেল তাকে অন্য বাচ্চাদের থেকে খুব আলাদা করা যাচ্ছে না!
.
বিকেলবেলা জাহাজের নিচতলায় সবাই একত্র হয়েছে। প্রাস্টিকের চেয়ারে বড়দের বসার ব্যবস্থা, মাঝখানে কার্পেট বিছানো হয়েছে, সেখানে ছোটদের বসার ব্যবস্থা। তাদের অবশ্য বসার আগ্রহ নেই, এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে।
আলমগীর ভাই মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, “বস, সবাই বস।”
একটি বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “কেন আংকেল? বসতে হবে কেন?”
“এখন সবার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে।”
“কেন আংকেল?””আমরা সবাই মিলে যাচ্ছি, সবার সাথে সবার পরিচয় থাকতে হবে না?”
রাতুল ব্যাখ্যা করে দিল, “মনে কর সুন্দরবনে বাঘ একজনকে খেয়ে ফেলল, তা হলে আমাদের জানতে হবে না কাকে খেয়েছে?”
এই ব্যাখ্যাটি বাচ্চাদের পছন্দ হল, এবার তারা কার্পেটে বসে যায়। আলমগীর ভাই মাইক্রোফোনে বললেন, “সবাইকে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণে আমন্ত্রণ। এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী কে বলতে পারবে?”