“আর যেটা ওঠে সেটাকে?”
“সেটা শুধু দাঁত।”
“উঁহু” রাতুল মাথা নাড়ল, সেটা হচ্ছে, “মাংস দাঁত।”
তৃষা খানিকক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই পারিসও বটে। ভাগ্যিস তোকে আসতে বলেছিলাম–বাচ্চাগুলোকে ম্যানেজ করতে পারবি।”
রাতুল গলা নামিয়ে বলল, “তুই যদি আমার পাশে থাকিস তা হলে আমি যে কোনো মানুষকে ম্যানেজ করতে পারব। চাইলে ওই কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকারদেরকেও
“ফাজলেমি করবি না।”
.
খাবার যখন শেষের দিকে তখন আধবুড়ো টাইপের একজন রাতুলের দিকে এগিয়ে এলেন, তুষার কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকারদের একজন। রাতুলের দিকে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুমি কী জান শিশুদেরকে কোমলমতি শিশুদেরকে কখনও প্রতারণা করতে হয় না?”
রাতুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কোমলমতি, প্রতারণা–এসব শব্দ সে বইয়ে পড়েছে, মুখের কথায় কেউ ব্যবহার করতে পারে ধারণা করেনি। সে অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আধবুড়ো টাইপের মানুষটি বললেন, “আমি লক্ষ করলাম শিশুগুলো বলছে তারা ডাইনোসরের মাংস খাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ডাইনোসরের মাংস খাওয়ার ভান করার জন্যে তারা তাদের আচরণে একটা বর্বরতার রূপ ফোঁটানোর চেষ্টা করছে।”
রাতুল চেষ্টা করে বলল, “আমি মানে ইয়ে–”
আধবুড়ো মানুষটি বললেন, “তারা মোটেও ডাইনোসরের মাংস খাচ্ছে না। কাজেই তাদেরকে সেটি বলা ভুল। তারা শিশু বলে তাদেরকে ভুল-মোটা দাগে আমি ভুল শব্দটি ব্যবহার করছি, যদি সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করি আমি মিথ্যা শব্দটাও ব্যবহার করতে পারতাম, কিন্তু আমি ভুল শব্দটিই ব্যবহার করছি–শিশুদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া ঠিক নয়।”
রাতুল একবার ঢোক গিলে বলল, “আমি আসলে মজা করছিলাম।”
“আমি সেটি অনুমান করেছি। শিশুদের ব্যাপারে আমি খুব স্পর্শকাতর। তাদের সাথে সঠিক ব্যবহার করা হয় না বলে নতুন প্রজন্মের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ হয় না।”
রাতুল এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, কী বলবে সেটাও ঠিক করেছে। বাচ্চাগুলো খুব ভালো করে জানে, এটা ডাইনোসরের মাংস নয়, তাদেরকে কোনো ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি, এটা এক ধরনের খেলা, বিষয়টা যখন সে বলতে শুরু করেছে আধবুড়ো মানুষটি তখন হাত নেড়ে রাতুলকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে হেঁটে চলে গেলেন। রাতুল মাথা ঘুরিয়ে তৃষার দিকে তাকাল, তৃষা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। রাতুল বলল, “দেখলি? দেখলি ব্যাপারটা?”
“তোকে আমি আগেই বলেছিলাম–”
”কে মানুষটা?”
“সর্বনাশ, তুই কবি শাহরিয়ার মাজিদকে চিনিস না?”
“না। আমি মাজিদ, বা বাজিদ কাউকেই চিনি না।”
“বিখ্যাত কবি। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তোর সাথে যে কথা বলেছে। সেই জন্যেই তোর জীবন ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা।”
“আমার সাথে মোটেই কথা বলেনি–আমাকে গালাগাল করে চলে গেছে। আমি যখন কথা বলতে চেয়েছি তখন আমার কথা না শুনে চলে গেছে। মানুষ যেভাবে মাছি তাড়ায় ঠিক সেইভাবে হাত দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
তৃষা হাসি চেপে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন প্রথমে সরু গলায় একটা চিৎকার, তারপর সম্মিলিত অনেকগুলো চিৎকার শোনা গেল। জাহাজের পেছনে একটা জটলা তৈরি হয়ে গেল এবং সেখান থেকে উত্তেজিত গলার স্বর শোনা যেতে থাকে। রাতুল আর তৃষা ছুটে গেল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় একটা বেঞ্চের নিচে উবু হয়ে অনেকে কী যেন দেখছে।
“কী?” তৃষা বেঞ্চের নিচে উঁকি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এখানে?”
“মানুষ।” একটা বাচ্চা উত্তেজিত গলায় বলল, “একটা মানুষ বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে আছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
এবার রাতুলও উঁকি দিল। সত্যি সত্যি বেঞ্চের নিচে খানিকটা দুরে অন্ধকারে একজন মানুষ গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে আছে। তৃষা বলল, “সাবধান। হাতে কিছু থাকতে পারে।”
এ রকম সময় জাহাজের একজন খালাসি ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো, সে একনজর দেখেই মনে হয় ব্যাপারটা বুঝে গেল। বেঞ্চের সামনে উবু হয়ে বসে সে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মানুষটার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে আনে। বাইরে টেনে আনার পর বোঝা যায় এটা একজন বড় মানুষ না, এটা একটা বাচ্চা। বয়স আট-দশ বছরের বেশি না। বেঞ্চের নিচে আবছা অন্ধকারে তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না বলে বোঝা যায়নি। খালাসিটা কোনো কথা না বলে ছেলেটার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মারতে শুরু করে।
তৃষা আর রাতুল ঝাঁপিয়ে পড়ে খালাসিটাকে থামাল। তৃষা বলল, “কী করছেন আপনি? মারছেন কেন ওকে?”
“মাইর ছাড়া এরা আর কিছু বোঝে না।” খালাসিটা নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “এরা যে কী বদমাইশ আপনারা জানেন না।”
“কেন? কী হয়েছে ওদের?”
”সবসময় এইভাবে লুকিয়ে জাহাজে উঠে যায়। তারপর চুরি করে পালায়।”
বাচ্চা ছেলেটা মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল, “না।”
রাতুল জানতে চাইল, “তা হলে জাহাজে উঠে লুকিয়ে আছ কেন?”
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না। হাত দিয়ে নাকটা মুছল, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। রাতুল বলল, “কী হল? কথা বলছ না কেন? বল কেন উঠেছ?”
ছেলেটা আরও মাথা নিচু করে কিছু একটা বলল। রাতুল ঠিক বুঝতে পারল না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”
ছেলেটা মাথাটা একটু উঁচু করে বলল, “আপনাগো লগে সুন্দরবন যামু।”