রাতুল নিচে গিয়ে দেখে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ছোট বাচ্চারা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে। বড়দের আলাদা লাইন, সেখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মুখে এক ধরনের অপ্রস্তুত ভাব, বোঝাই যাচ্ছে খাবারের জন্যে তাদের লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস নেই। রাতুলকে দেখে তৃষা বলল, “রাতুল, তুই বাচ্চাদের সামলা।”
“কী করতে হবে?”
“প্লেটে খাবার তুলে দে। আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“কেবিনে।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “কবি-সাহিত্যিক, ফিল্ম মেকারদের ডেকে আনি।”
টেবিলের ওপর বড় বড় গামলায় খাবার, তাকে খাবার তুলে দিতে হবে। বাচ্চাদের লাইনে সবার আগে দাঁড়ানো ছোট মেয়েটা, খাবারের দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে বলল, “আর কিছু নাই?”
রাতুল থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাও?”
“হাম বার্গার।”
“না।” রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “না আজকে শুধুমাত্র ডাইনোসরের মাংস।”
সামনে দাঁড়ানো বাচ্চাগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “ডাইনোসর?”
“হ্যাঁ।” রাতুল গম্ভীর হয়ে একটা মুরগির রান ওপরে তুলে বলল, “এই দেখো ডাইনোসরের ঠ্যাং।”
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা হি হি করে হেসে বলল, “এটা চিকেন?”
“মোটেও চিকেন না। এটা ডাইনোসর।”
“ডাইনোসর কত বড় হয়—”
“এগুলো ডাইনোসরের বাচ্চা। দাও প্লেট দাও।”
মেয়েটা প্লেট এগিয়ে দিল। রাতুল প্লেটে এক চামচ ভাত দিয়ে বলল, “শুধু ডাইনোসরের ঠ্যাং খেলে তো হবে না। সাথে কিছু ঘাসের বিচি দিয়ে দিই। ফ্রেশ জঙ্গল থেকে তুলে এনেছি।”
মেয়েটা আনন্দে হাসতে থাকে, সবজিটা দেখিয়ে বলে, “আর এটা কী?”
রাতুল এক চামচ সবজি তুলে বলল, “এর সাথে অনেক কিছু আছে। মাদাগাস্কার থেকে এসেছে টিউবারসাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে লাইকোপারসিকাম, উরুগুয়ে থেকে ব্রাসিকা ওলেরাসিয়া, আর্জেন্টিনা থেকে মেলংগিনা–”
রাতুল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, মেয়েটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা–এটা সবজি।”
“এটা মোটেও সবজি না।” রাতুল মুখ গম্ভীর করে বলল, “এর মাঝে অনেক কিছু আছে। ভাইটামিন এ থেকে জেড পর্যন্ত সবকিছু আছে।”
মেয়েটা এবার একটু মজা পেয়ে গেছে, ডালটা দেখিয়ে বলল, “আর এটা কী?”
“এটা খুবই স্পেশাল স্যুপ। স্পেনের রাজার জন্যে তৈরি করেছিল, আমাদের স্পেশাল এজেন্ট তোমাদের জন্যে চুরি করে এনেছে। এর মাঝে আছে টারমারিক এলিয়াম আর গার্বাঞ্জো।”
মেয়েটা তার প্লেট হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, রাতুল তাকে থামাল, “দাম না। দিয়ে চলে যাচ্ছ?”
“দাম?”
“হ্যাঁ। এই খাবারের দাম দিতে হবে না?”
রাতুল ঠাট্টা করছে বুঝতে তার একটু সময় লাগল। বোঝা মাত্র তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, “কত দাম?”
“একশ ডলার।”
মেয়েটা হাত মুঠো করে তার দিকে হাত এগিয়ে দেয়, “এই নাও-এক মিলিয়ন ডলার।”
রাতুল খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “থ্যাংকু। থ্যাংকু। তুমি নিশ্চয়ই একজন প্রিন্সেস। তা না হলে কেউ এত টাকা দেয়। কী নাম তোমার প্রিন্সেস?”
“মৌটুসি।”
“থ্যাংকু প্রিন্সেস মৌটুসি।” তারপর হাত ওপরে তুলে অদৃশ্য একটা কিছু ধরে গলা উঁচু করে বলল, “এই যে সবাই দেখ, প্রিন্সেস মৌটুসি আমাকে এক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।”
বাচ্চারা আনন্দের মতো শব্দ করল, বড়দের লাইনে দাঁড়ানো অনেকেই হাসি হাসি মুখ করে রাতুলের দিকে তাকাল।
একটু পর তৃষা এসে কয়েকটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কার জন্যে নিচ্ছিস?”
“কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার।”
“অন্যদের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে নেয় না কেন?”
“তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তারা লাইনে দাঁড়াবে?”
রাতুল দেখল কয়েকজন আধবুড়ো মানুষকে আলাদা করে বসিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, তারা খুব গম্ভীরভাবে খাচ্ছে এবং অন্যরা তাদের সমাদর করছে।
একটু পরেই তৃষা এসে রাতুলের পাশে দাঁড়াল, বাচ্চারা রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে খাবার নিচ্ছে দেখে তৃষা একটু অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার? এরা রীতিমতো মারামারি করছে খাবার নিতে? আমরা ভেবেছিলাম এদের খাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবে। হামবার্গার, ফ্রায়েড চিকেন আর পিঞ্জা ছাড়া এরা আর কিছু খেতে চায় না।”
রাতুল হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোমরা যদি ভাত, মুরগির মাংস, সবজি, ডাল এসব খেতে দাও তা হলে তো বাচ্চারা আপত্তি করবেই।”
তৃষা বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”
“দেখছ না আজকের মেনু। ডাইনোসরের মাংস, ঘাসের বিচি” রাতুল সামনের ছোট ছেলেটার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, “সব শেষ করতে হবে কিন্তু। ঠিক আছে?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে যাচ্ছিল, রাতুল থামাল, “কী হল সুপারম্যান, টাকা দিলে না? একশ ডলার প্লেট।”
ছেলেটা লাজুক মুখে রাতুলের হাতে অদৃশ্য ডলার তুলে দিয়ে হাসল, দেখা গেল তার সামনের দুটি দাঁত নেই। রাতুল ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “সুপারম্যান, তোমার সামনের দুটি দাঁতের কী হয়েছে? ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে না কি? মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছিলে নিশ্চয়ই
“না।” ছেলেটা ঝপ করে মুখ বন্ধ করে ফেলল।
”তা হলে?”
“পড়ে গেছে।”
“সর্বনাশ! এখন কী হবে?”
“আবার উঠবে।”
“যদি না ওঠে?”
ছেলেটা মুখ যথাসম্ভব বন্ধ রেখে বলল, “উঠবে, উঠবে।”
পেছনে দাঁড়ানো একটি মেয়ে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া, তুমি জান না দাঁত পড়ে গেলে আবার ওঠে? যে দাঁতটা পড়ে যায় সেটাকে বলে দুধদাঁত।”