নসু ডাকাত বুঝতে পারছে না, কেমন করে একজন শুকনো পাতলা মানুষ তাকে এভাবে মারতে পারে! সে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে ধড়াম করে নিচে পড়ে গেল। দুর্বলভাবে একবার ওঠার চেষ্টা করল, পারল না। রাতুল রেলিং ধরে যখন বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে তখন দুজন ছুটে এসেছে। রাতুলকে দেখে বলল, “কী হয়েছে?”
রাতুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ থেকে রক্ত মুছে নসু ডাকাতকে দেখিয়ে বলল, “বেঁধে ফেল। এই ডাকাতটাকে কোনো বিশ্বাস নেই।”
.
রাতুল হাঁটতে গিয়ে অনুভব করল তার পায়ের কোনো একটা জায়গায় খুব ব্যথা পেয়েছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে নিচে একটা বেঞ্চে বসে পা-টাকে সামনে ছড়িয়ে দেয়। বুক থেকে একটা বড় নিশ্বাস বের করে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে। ঠিক তখন জাহাজে একটা আনন্দোৎসব শুরু হয়েছে। শামসের নেতৃত্বে সব ডাকাতকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। শামস তাদের সামনে কাটা রাইফেল হাতে নাটকীয় একটা ভঙ্গি করে ছবি তুলল। জাহাজের বিভিন্ন ঘরে তালা মেরে আটকে রাখা খালাসি সারেং সবাইকে ছাড়ানো হল। গুলি খাওয়া আনসারকে একটু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হল। জোয়ারের পানি বেড়ে গেছে বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটাকে ডুবোচর থেকে মুক্ত করে নেওয়া হল। জাহাজটা যখন সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে গেল এবং আবার টেলিফোন নেটওয়ার্কের ভেতর চলে এল তখন শামস তার নাটকীয় ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড করে সারা পৃথিবীতে প্রচার করে দিল।
বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থেকে রাতুল টের পেল গা কেঁপে তার জ্বর আসছে। আসুক, এখন জ্বর এলে ক্ষতি নেই। সবাই বেঁচে গেছে, সবাই একসাথে আছে সেটাই বড় কথা।
৪. সদরঘাটে জাহাজ
সদরঘাটে জাহাজটা থামার আগেই সবাই দেখতে পেল সেখানে টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে অনেক সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজটা জেটিতে লাগার সাথে সাথে তারা লাফিয়ে জাহাজে উঠে এল। একটু পরেই দেখা গেল শামস জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। ডুবোচরে জাহাজটা কেমন করে আটকে গেল, কেমন করে ডাকাতের দল আক্রমণ করল, কেমন করে তাদের পরাস্ত করা হল–তার রোমহর্ষক বর্ণনা। রাতুল তার ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরল। সে একজন একজন করে তাদের সবাইকে একবার বুকে চেপে ধরল।
রাতুল তুষার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্যে এদিক-সেদিক তাকাল। সে কোথাও নেই। মনে হয় ওপরে টেলিভিশনের লোকজনের সঙ্গে আছে। শামস ইন্টারভিউ দিচ্ছে। সে হয়তো মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে। জ্বরটা কমেছে, কিন্তু পায়ে এখনও অনেক ব্যথা। মনে হয় অনেক দিন ভোগাবে। জাহাজ থেকে নেমে সে জেটি ধরে হাঁটতে থাকে। তখন কোথা থেকে রাজা দৌড়ে এসে তার হাত ধরল।”ভাই!”
“কী খবর রাজা?”
“আমারে একটা জিনিস বলবেন?”
“কী জিনিস?”
“আপনি সবকিছু করলেন, সব ডাকাত ধরলেন–”
“আমি একা তো না। তুমি ছিলে, অন্যরাও ছিল।”
“কিন্তু আপনি ছিলেন আসল। অন্য সবাই ফাউ।”
“কেউ ফাউ না। সবাই আসল।”
“কিন্তু টেলিভিশনের লোকেরা আপনার সাথে কথা না বলে ওই ভুয়া লোকটার সাথে কথা বলে কেন?”
রাতুল থামল, হাত দিয়ে রাজার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “আমার দিকে তাকাও। পায়ে জুতা নাই, খালি পা। শার্টটা দেখ, কত ময়লা। প্যান্টের অবস্থা দেখ, ছিঁড়ে গেছে। রক্ত লেগে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল জট পাকিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় একজন ফালতু মানুষ। ঠিক কি না?”
“কিন্তু কিন্তু–”
“কোনো কিছু নাই। টেলিভিশনের লোকেরা আমার মতো ফালতু মানুষের কাছে আসে না। তারা যায় বিখ্যাত লোকের কাছে। যাদের চেহারা সুন্দর, যারা সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তাদের দেখলে মানুষ খুশি হয়।”
রাজা মাথা নাড়ল। বলল, “ব্যাপারটা ঠিক হল না ভাই। কিন্তু আপনি ছিলেন বলে সবাই বেঁচে গেছে। আপনার কী সাহস, কী বুদ্ধি! আমি তাজ্জব হয়ে যাই।”
“থ্যাংক ইউ রাজা।”
রাতুল তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাজার দিকে এগিয়ে দিল। সেও তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সেটাকে স্পর্শ করল। ভালোবাসার স্পর্শ। রাজা চোখ মুছে রাতুলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল।
.
ঠিক তখন পুলিশ ডাকাতের দলটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। শামস আর তৃষা একটু সরে গিয়ে পুরো দলটাকে যাবার জন্যে একটু জায়গা করে দিল। হাতকড়া পড়া অবস্থায় যেতে যেতে হঠাৎ নসু ডাকাত দাঁড়িয়ে গেল। এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওই ছেলেটা কই?”
তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কোন ছেলেটা?”
“যে আমাদের সবাইরে ধরল।”
তৃষা শামসকে দেখিয়ে বলল, “এই যে।”
“ধুর। এই শালারে তো দেখি নাই কিছু করতে। হালকা-পাতলা ছেলেটা কই? যার জন্যে আমরা ধরা পড়লাম।”
শামসের মুখ লাল হয়ে ওঠে, সে তৃষাকে বলল, “চলো যাই।”
তৃষা দাঁড়িয়ে পড়ল, নসু ডাকাতকে জিজ্ঞেস করল, “কোন ছেলেটা?”
নসু ডাকাত হঠাৎ জেটিতে রাতুল আর রাজাকে দেখতে পায়। মুখ দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে যাচ্ছে। সাথে বিচ্ছু পোলাটাও আছে!”
“রাতুল? রাজা?”
নসু ডাকাত একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাদের খুব কপাল ভালো জাহাজে ঐ ছেলেটা ছিল। তোমাগোর উপর নিশ্চয়ই আল্লাহর দোয়া আছে। তা না হলে এই জাহাজে এই ছেলে থাকে? বাপরে বাপ! কী সাহস! মাথার মধ্যে কী বুদ্ধি! মানুষ না–একেবারে বাঘের বাচ্চা।”