ট্রলারটা এবার বেশ দ্রুত চলতে শুরু করেছে। রাতুল নিজেকে টেনে উপরে তুলল। মাথাটা একটু উপরে তুলতেই দেখতে পেল নসু ডাকাত শারমিন, গীতি আর তৃষাকে বেঁধে রেখেছে। তাদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা বলে তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রাতুল সাবধানে নিঃশব্দে পিছন দিয়ে ওপরে উঠল। নসু ডাকাত রাজাকে ট্রলারের ছাদে শুইয়ে রেখে পা দিয়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছে। এক হাতে কাটা রাইফেল অন্য হাতে হাল ধরে সে ট্রলারটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নসু ডাকাত তাকে দেখছে না, রাজা তাকে দেখতে পেল আর সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। রাতুল নিঃশব্দে রাজাকে ইঙ্গিত দিল তারপর দুজন একসাথে নসু ডাকাতকে আক্রমণ করল। রাজা হ্যাঁচকা টানে রাইফেলটা টেনে নিয়ে তার দু পা দিয়ে নসু ডাকাতের দুই পায়ের ফাঁকে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতুল তার সর্বশক্তি দিয়ে নসু ডাকাতের মুখে একটা ঘুষি মারল। নসু ডাকাত অবাক হয়ে পিছনে তাকাতেই রাতুল আবার সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখে আরেকটা ঘুষি মারল। হাল থেকে নসু ডাকাতের হাতটা ছুটে যেতেই ট্রলারটা ঘুরে যায়, আর সাথে সাথে তাল হারিয়ে নসু ডাকাত ঝপাং করে পানিতে পড়ে যায়।
রাজা তখন আনন্দে একটা চিৎকার করে ওঠে। রাতুল হালটা ধরে পানির দিকে তাকাল। নসু ডাকাত পানিতে পড়ে ডুবে যাবার মানুষ নয়। সাঁতরে নিশ্চয়ই উঠে যাবে। কোথায় উঠবে সেটাই সে দেখতে চায়।
ট্রলারটা তখন জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঠিক তখন রাতুল এক ঝলকের জন্যে নসু ডাকাতকে দেখতে পেল। পানির ওপর মাথা তুলে একবার নিশ্বাস নিয়ে আবার ডুবে যায়, মনে হয় জাহাজের সামনের দিকে যাচ্ছে। নিচে বেঁধে রাখা তিনজনকে খুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু রাতুল উদ্বিগ্ন মুখে পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্রলারটা জাহাজকে স্পর্শ করার সাথে সাথে রাতুলের মনে হল নসু ডাকাতকে সে আরও একবার দেখতে পেয়েছে। জাহাজের নোঙর ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। সে লাফ দিয়ে জাহাজে নেমে চিৎকার করে বলল, “ডাকাত! নসু ডাকাত!” তারপর সে সামনের দিকে ছুটে যেতে থাকে।
.
ঠিক তখন শামসকে দেখা গেল। সে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে ট্রলারে উঠে রাজার হাত থেকে নসু ডাকাতের কাটা রাইফেলটা নিয়ে একটা বীরত্বসূচক ভঙ্গি করে দাঁড়াল। তারপর ভিতরে ঢুকে চোখ বেঁধে রাখা তিনটি মেয়ের বাঁধন খুলে দিতে থাকে। গম্ভীর মুখে বলে, “মেয়েরা, তোমাদের আর কোনো ভয় নেই। আমি চলে এসেছি।”
তৃষা বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে অবাক হয়ে কাঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে? কেমন করে আমাদের উদ্ধার করলেন?”
শামস কাটা রাইফেলটা ঘাড়ে নিয়ে ভঙ্গি করে হাসল, বলল, “সে অনেক বড় কাহিনী! আপাতত জেনে রাখো, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি আছি।”
গীতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শামস তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে! আমরা থাকতে তোমাদের নিয়ে যাবে-সেটা কি হতে পারে?”
শামস যখন তিনজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে এবং বস্তার ভেতর থেকে উদ্ধার করা দামি ক্যামেরাটি দিয়ে নিজেদের ছবি তুলছে, রাতুল তখন জাহাজের সামনে নসু ডাকাতকে খুঁজছে। তার সঙ্গে নসু ডাকাতকে খুঁজতে যারা এসেছে সবাই রেলিংয়ের উপর থেকে মুখ নিচে করে তাকিয়ে আছে। নসু ডাকাতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু রাতুল জানে, সে আশেপাশে কোথাও আছে।
রাতুল হেঁটে হেঁটে একেবারে সামনে এসে যখন নিচের দিকে তাকিয়েছে ঠিক তখন সে পিছনে একটা শব্দ শুনতে পেল। মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই সে দেখে নসু ডাকাত হাতে একটা রড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল ঘুরে তাকাননা মাত্রই প্রচণ্ড আক্রোশে সে রাতুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রাতুল বিদ্যুৎ বেগে পাশে সরে গিয়ে কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করল। নসু ডাকাতের সাথে মারামারি করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু অন্যরা আসার আগে তার নিজেকে রক্ষা করতে হবে। কলেজে পড়ার সময় সে কিছুদিন তাইকোয়ান্ডো ক্লাস করেছিল। রেড বেল্ট পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিল। মাসে মাসে অনেক টাকা লাগে। টিউশনির টাকা দিয়ে এই বিলাসিতা সে কুলাতে পারেনি। তার ইন্ট্রাক্টর অবশ্য রাতুলকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন। বলেছিলেন, ব্ল্যাক বেল্ট পর্যন্ত যেতে পারলে টুর্নামেন্টে সে নির্ঘাত কোনো একটা মেডেল পাবে। রাতুলের ধারণা ছিল, টুর্নামেন্টে মেডেল পাওয়াই হচ্ছে এ ধরনের মার্শাল আর্টের উদ্দেশ্য। নসু ডাকাতের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে এই প্রথম সে বুঝতে পারল, মেডেল নয় তার প্রাণটাই আসল উদ্দেশ্য। হয়তো তাইকোয়ান্ডোর অল্প কিছু ট্রেনিংই তাকে রক্ষা করবে। নসু ডাকাত যখন আবার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন সে ঘুরে গিয়ে তার পা তুলে নসু ডাকাতের মুখে একটা লাথি মেরে দেয়। তাইকোয়ান্ডো ক্লাসে চেষ্টা থাকত কেউ যেন ব্যথা না পায়। এখন তার সব প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষটাকে যত জোরে সম্ভব আঘাত করা।
নসু ডাকাত লাথি খেয়ে নিচে পড়ে যায়। কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হিংস্র পশুর মতো আবার রাতুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নসু ডাকাত রাতুলকে নিচে ফেলে দিয়ে তার উপর বসে তাকে মারতে থাকে। রাতুলের মনে হল তাকে বুঝি খুনই করে ফেলবে। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করে সে ছিটকে সরে আসে। একটু দূরে গিয়ে সে আবার পা তুলে নসু ডাকাতকে আঘাত করল। একবার দুইবার। তারপর অনেকবার।