ফল হল ভয়ংকর। কাউলা রাগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে রাজাকে ধরার চেষ্টা করল। রাজা প্রস্তুত ছিল। সে জানে, যদি এখন কাউলা ডাকাত তাকে ধরতে পারে তা হলে তার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। তাই সে লাফ দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা-ই না, একটু দূরে সরে গিয়ে কাউলার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচে দিল। কাউলা তখন লাফিয়ে উঠে রাজাকে ধরতে চেষ্টা করে। রাজা প্রাণপণে ছুটতে থাকে। তার পিছু পিছু কাউলা ছুটে আসে।
সিঁড়ি দিয়ে রাজা নেমে যায়। কাউলা কোনো কিছু চিন্তা না করে তার পিছু পিছু ছুটে আসে। বাচ্চাদের গায়ের ওপর পা দিয়ে সে ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সব বাচ্চা তার পা ধরে ফেলে। কাউলা তাল সামলাতে না পেরে ধড়াম করে পড়ে যায়। সাথে সাথে অন্যেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বদি ডাকাতকে যত সহজে আটকানো গিয়েছিল কাউলাকে এত সহজে আটকানো গেল না। তার শরীরে মোষের মতো জোর। একেকটা ঝটকা দিতেই একেকজন কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। তার পরেও তারা তাকে ছাড়ল না। রাতুল বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথার পিছনে জোরে একটা আঘাত করার পর সে শেষ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
এবারে দ্রুত তার মুখে কাপড় গুঁজে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। তারপর পাটাতনের ডালা খুলে তার ভেতরে তাকেও ফেলে দেওয়া হল।
রাতুল ঘুরে তাকিয়ে দেখল বাচ্চাদের অনেকেই ব্যথা পেয়েছে। মৌটুসির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, শান্তর কপালের কাছে আলুর মতো ফুলে আছে। জামা কাপড় ঘেঁড়া, চুল এলোমেলো। কিন্তু সবাই উত্তেজিত।
রাতুল দুই হাতে দুইটা বন্দুক নিয়ে বলল, “সাতজনের ভেতর ছয়টাকেই আমরা কাবু করে ফেলেছি। এখন বাকি একটা। আমাদের কাছে বন্দুক দুইটা। ওপরে গেলে আরও পাব।” রাতুল রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “পাব না রাজা?”
“জে। চাইরটা। বন্দুক আর কাটা রাইফেল।”
“গুড। তার মানে আমাদের সব মিলিয়ে ছয়জন ওপরে যাব। ছয়জনের হাতে ছয়টা বন্দুক। সর্দারটাকে কাবু করা কঠিন কিছু হবে না। দরকার হলে গুলি করে দেব। ঠিক আছে?”
অবস্থা মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে দেখে এবারে অনেকেই উপরে যেতে রাজি। শুধু শামস বলল, “তোমরা কেউ কখনো বন্দুক দিয়ে গুলি কর নাই। দরকার হলেও গুলি করতে পারবে না। ঐ ডাকাতটা ঠিকই গুলি করতে পারে, সে সবাইকে শেষ করে দিবে।”
রাতুলের পরিকল্পনা এতক্ষণ নিখুঁতভাবে কাজ করেছে। তার উপরে এবারে সবার বিশ্বাস জন্মে গেছে। কাজেই শামসের কথা শুনে কেউ ভয় পেল না। আলমগীর ভাই পর্যন্ত একটা বন্দুক হাতে নিয়ে নসু ডাকাতকে ধরতে রাজি হয়ে গেলেন।
প্রথমে রাজা সাবধানে উঠে চারদিক দেখেশুনে বন্দুকগুলো টেনে সিঁড়ির কাছাকাছি এনে রাখে। নসু ডাকাত ট্রলারে কিছু একটা করছে। কাজেই এখনই সময়। প্রথমে রাতুল তারপর অন্য সবাই একজন একজন করে উপরে উঠে যায়। সবাই একটা করে বন্দুক নিয়ে একটু আড়ালে চলে গেল। নসু ডাকাত যখন উপরে উঠে আসবে তখন তাকে ঘেরাও করে ফেলা হবে। বন্দুক নিয়ে সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে।
নসু ডাকাত জাহাজে সবকিছু তুলে তার দলের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। জোয়ার এখনো শুরু হয়নি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে। এখন রওনা দেওয়া যায়। সে সবার জন্যে অপেক্ষা করছে কিন্তু কেউ আসছে না দেখে একটুখানি অবাক এবং অনেকখানি বিরক্ত। সে কয়েকবার চিৎকার করে ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। তখন সে হঠাৎ একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে যায়। কাটা রাইফেলটা ধরে সে তখন সাবধানে জাহাজে উঠে আসে। আর হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখল ছয় জন তার দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। রাতুল চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ।”
নসু ডাকাতের মুখটা দেখতে দেখতে ভয়ংকর হয়ে উঠল। বলল, “আমি মুখ্য-সুখ্য মানুষ। ইংরেজি বুঝি না। কী বলো?”
“বলেছি, হাতের রাইফেলটা নিচে ফেলে হাত তুলে দাঁড়াও।”
“যদি না দাঁড়াই তা হলে কী করবা?”
“গুলি করে দেব।”
“গুলি করবা? তুমি?” নসু ডাকাত হা হা করে হাসল এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ সে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে রাজাকে ধরে তার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে বলল, “তোমরা গুলি করবা না, আমি জানি। আমি কিন্তু গুলি করমু। সবার হাতের বন্দুক নিচে ফেল। তা না হলে এই হারামজাদা পোলার মাথার ঘিলু বের হয়ে যাবে।”
হঠাৎ পুরো পরিবেশটা পাল্টে যায়। নসু ডাকাত চিৎকার করে বলল, “বন্দুক নিচে ফেল, নইলে গুলি করমু।”
রাজার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সেখানে অবর্ণনীয় এক ধরনের আতঙ্ক। একজন একজন করে সবাই তাদের হাতের বন্দুক আর রাইফেল নিচে নামিয়ে রাখে। নসু ডাকাত তখন রাজার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে রেখে আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে ট্রলারটাতে ওঠে। ট্রলারের দড়িটা খুলে সেটাকে মুক্ত করে নেয়। ইঞ্জিনটাকে চালু করে তারপর ট্রলারটা চালিয়ে নিতে থাকে।
অন্য সবার সাথে রাতুল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দেখতে পেল নসু ডাকাত রাজার মাথায় রাইফেল ধরে রেখে শারমিন, গীতি আর তৃষাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। রাতুল পুরো ব্যাপারটা চিন্তাও করতে পারছে না। চিন্তা করার জন্যে সে অপেক্ষাও করল না। নসু ডাকাত যখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে তখন পানিতে ঝাঁপ দিল। পানিতে তলিয়ে গেল প্রথমে। সাঁতরে সে উপরে উঠতে উঠতে ট্রলারের দিকে এগিয়ে যায়। ট্রলারটা ঘুরছে। সেই জন্যে সে খানিকটা সময় পেয়ে গেল। একসময় সে ভালো সাতার কাটতে পারত। ঢাকা শহরে থেকে সে পানিতে নামেনি বহুদিন। সমুদ্রের কনকনে শীতল লোনা পানিতে আবার সে প্রাণপণে সাঁতার কেটে ট্রলারটাকে ধরে ফেলল।