রাতুল আশেপাশে তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “তুই আশেপাশে থাকলেই আমি কেমন জানি বোকা হয়ে যাই। খোদার কসম।–”
তৃষা সরু চোখে কিছুক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “দেখ রাতুল, তোকে একটা ব্যাপার খুব ভালো করে বলে দেওয়া দরকার।”
“কী?”
“তুই আর আমি হচ্ছি বন্ধু। বুঝেছিস? বন্ধু।”
“বুঝেছি।”
“শুধু বন্ধু।” তৃষা ”শুধু” কথাটাতে অনাবশ্যকভাবে জোর দিল। রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে। শুধু বন্ধু।” রাতুলও শুধু কথাটাতে জোর দিল, অপ্রয়োজনীয় এবং অনাবশ্যক জোর!
.
রাতুল যেহেতু এই জাহাজের কাউকে চেনে না তৃষা তাই তাকে নিয়ে বের হল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। প্রথমে দেখা হল আলমগীর ভাইয়ের সাথে। আলমগীর আলম মৌটুসি অ্যাড ফার্মের মালিক, মৌটুসি তার মেয়ের নাম। মেয়ের বয়স আট। যার অর্থ আট বছরের মাঝে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে আলমগীর আলম ফার্মটি দাঁড় করিয়েছেন। সেখান থেকে যে টাকা-পয়সা আসে তার বেশিরভাগ ফিল্ম সোসাইটির পেছনে খরচ করেন। গত বছর মাহী এবং তার লাল বেলুন’ নামে বাচ্চাদের জন্যে একটা সিনেমা তৈরি করেছেন–সিনেমাটা পুরোপুরি ফ্লপ গেছে কিন্তু সেটা নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। সিনেমার জগতে তার সাফল্যের কোনো ইতিহাস না থাকলেও আলমগীর আলমের অন্য একটা বড় গুণ আছে, যে কোনো বয়সের মানুষকে একত্র করিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।
আলমগীর ভাই ডেকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন, তৃষাকে দেখে বললেন, “সব ঠিক আছে তুষা?”
“ঠিক আছে। নো প্রবলেম।” তারপর রাতুলকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে রাতুল, যার কথা বলেছিলাম। নতুন ভলান্টিয়ার।”, আলমগীর ভাই রাতুলকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন, তারপর বললেন, “আমার মেয়ে মৌটুসি একটু আগে আমাকে বলে গেছে তুমি না কি স্পাইডারম্যানের মতো উড়তে পার। আকাশ থেকে উড়ে না কি ল্যান্ড করেছ।”
রাতুল অপ্রস্তুতের মতো হেসে বলল, “কাজটা খুব স্টুপিডের মতো হয়েছে–”
“বাচ্চাদের তা মনে হয়নি। তারা খুবই ইমপ্রেসড। সবাই এখন ওড়া প্র্যাকটিস করছে। জাহাজের ভেতরে থাকলে ঠিক আছে–জাহাজ থেকে বাইরে না উড়ে যাবার চেষ্টা করে!”
রাতুল মাথা নাড়ল, “করবে না। বাচ্চারা ছোট হতে পারে কিন্তু তারা আমার মতো গাধা না।”
আলমগীর ভাই হাসলেন, সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, “না, না–গাধা কেন হবে। তৃষা সারাক্ষণ রাতুল রাতুল করতে থাকে। তুমি গাধা হলে তৃষা তোমাকে পাত্তা দিত মনে করেছ?”
তৃষা চোখ পাকিয়ে বলল, “আমি কখন রাতুল রাতুল করেছি আলমগীর ভাই? মোটেও করিনি। শুধু গত সপ্তাহে
আলমগীর ভাই তৃষাকে থামালেন, “ঠিক আছে করনি। মাই মিসটেক।” তারপর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওকে রাতুল। ওয়েলকাম টু আওয়ার ফ্যামিলি। তৃষা হচ্ছে আমাদের কমান্ডার ইন চিফ। তার আন্ডারে আমাদের ভলান্টিয়ার বাহিনী-–তুমিও সেই বাহিনীতে যোগ দিয়ে দাও।”
“জি দেব। সেই জন্যে উড়ে চলে এসেছি।”
“গুড। আবার উড়ে চলে যাবে না তো!”
“না যাব না।”
তৃষা তারপর রাতুলকে নিয়ে অন্য ভলান্টিয়ারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশিরভাগই তাদের মতো ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। হাসি-খুশি উজ্জ্বল চেহারার ছেলেমেয়ে। তৃষার বন্ধু-বান্ধব। ছোট বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হল না। তারা সবাই তাকে স্পাইডার ভাইয়া ডাকছে। সেজেগুঁজে থাকা কিছু পুরুষ-মহিলাও আছেন। তৃষা রাতুলকে নিয়ে তাদের কাছে গেল না। গলা নামিয়ে বলল, “এরা হচ্ছে আমাদের স্পন্সরদের ফ্যামিলি। আমি নিজেও চিনি না। এদের বেশি খাতির-যত্ন করতে হবে, যেন সামনের বছরও আমাদের স্পন্সর করে।”
দোতলার কেবিনের কাছে গিয়ে বলল, “এই কেবিনে আমাদের ইনভাইটেড গেস্টরা আছে। বড় বড় মানুষজন, কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার। বিকেলে যখন সবাইকে নিয়ে গেট টুগেদার হবে, তখন তাদের সাথে পরিচয় হবে। আমরা এদের ঘাটাই না।”
“কেন?”
“কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার এরা হচ্ছে ক্রিয়েটিভ মানুষ। ক্রিয়েটিভ মানুষদের থেকে দূরে থাকতে হয়।”
“কেন?”
“এরা কখন কী করবে বলা মুশকিল। সবসময় ভালো করে কিছু দেখে না, বোঝে না, কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। উদাস উদাস ভাব। কিন্তু আসলে চোখের কোনা দিয়ে সবকিছু দেখে, সবকিছু বোঝে। আয়নার সামনে আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে, চুল এলোমেলো করে চেহারায় উদাস উদাস ভাব আনার জন্যে!”
তৃষার কথার ভঙ্গি শুনে রাতুল হেসে ফেলল। বলল, “তুই কবি সাহিত্যিকদের ওপর খুব খ্যাপা মনে হচ্ছে।”
“শুধু কবি-সাহিত্যিক না। কবি-সাহিত্যিক আর ফিল্ম মেকার।”
“কেন?”
“কাছে থেকে দেখিসনি তো সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছিস। এখানে এসেছিস, এখন কাছে থেকে দেখবি। তা হলে বুঝতে পারবি।”
.
দুপুরবেলাতেই রাতুল তৃষার কথাটার অর্থ বুঝতে পারল। সদরঘাট থেকে রওনা দিয়ে জাহাজটা তখন অনেক দক্ষিণে চলে এসেছে। প্রথম কয়েক ঘণ্টা নদীর দুপাশে শুধু ইটের ভাটা, পৃথিবীতে ইটের ভাটা থেকে কুৎসিত কিছু হতে পারে কি-না রাতুলের জানা নেই। ধীরে ধীরে ইটের ভাটা কমে এলো, তখন মাঝে মাঝে গ্রাম উঁকি দিতে থাকে, একসময় প্রায় হঠাৎ করে দেখা গেল নদীর দুই পাশে শুধু গ্রাম আর গ্রাম। বাংলাদেশের সবুজ গ্রাম। রাতুল রেলিংয়ে ভর দিয়ে নদী তীরে তাকিয়ে ছিল, তখন তৃষা তাকে নিচে ডেকে পাঠাল।