রাজা চায়ের কাপ, বিস্কুট, কলা, চানাচুর সবকিছু ডেকের ওপর রাখল। সাথে সাথে ডাকাতগুলো গোগ্রাসে খেতে শুরু করে। কয়েকজন চায়ের কাপ টেনে নিয়ে চুমুক দেয়। রাজা চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করে, একজন একবার ভুরু কুঁচকে চায়ের দিকে তাকাল। তারপর আবার চুমুক দিল। তারপর খেতে থাকল।
নসু ডাকাত চায়ে চুমুক দিয়েই ভুরু কুঁচকে বলল, “চায়ে ওষুধের গন্ধ কেন?”
“পানি।” রাজা হড়বড় করে বলল, “এরা পানির মাঝে ওষুধ দিয়ে খায়, সেই ওষুধের গন্ধ।”
“কীসের ওষুধ?”
“পানি বিশুদ্ধ করার ওষুধ। একজনের পেটের অসুখ হয়েছিল, তখন থেকে পানিতে এই ওষুধ দেয়। পানির মাঝে ওষুধের গন্ধ।”
নসু ডাকাত আবার চায়ের কাপটা শুকে মাথা নেড়ে রেখে দিল। রাজা জিজ্ঞেস করল, “খাবেন না ওস্তাদ?”
“নাহ।”
“আমি আপনারটা খাই?”
“খাবি? খা। ওষুধের গন্ধওয়ালা চা যদি খেতে চাস, তা হলে খাবি।”
“আমার অভ্যাস হয়ে গেছে” বলে রাজা চায়ের কাপ নিয়ে শব্দ করে চুমুক দিল। চা-টা খেলো না, মুখে রেখে দিয়ে পরের বার চুমুক দেওয়ার সময় বের করে দিল।
সাতজন ডাকাতের মাঝে শুধু চারজন চা খেলো। নসু ডাকাত গন্ধের জন্যে খেলো না। বদি আর কালোমলতান ডাকাতটা চা খাওয়ার চেষ্টা করল না। তারা না। কী চা খায় না।
চা-নাস্তা খেয়ে ডাকাতগুলো উঠে দাঁড়াল। কাটা রাইফেলটা একবার পরীক্ষা করে নসু ডাকাত বলল, “আয় যাই।”
সিঁড়ি দিয়ে যখন সাতজন ডাকাত নেমে এলো তখন নিচে আবার একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যারা নিচু গলায় কথা বলছিল তারা সবই কথা বন্ধ করে থেমে গেল। রাতুল রাজার দিকে তাকাল, সে পিছনে পিছনে নেমে এসেছে। রাজা সাবধানে চারটা আঙুল দেখাল, রাতুল অনুমান করে নেয় রাজা বোঝানোর চেষ্টা করছে চারজন চা খেয়েছে। তার মানে তিনজন খায়নি। তার মানে তিনজন ভয়ংকর ডাকাত এখনও রয়ে গেছে। রাতুল বুকের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে ডাকাতদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল কারা ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু বুঝতে পারল না। ওষুধের কাজ হতে আরও সময় নেবে মনে হয়।
নসু ডাকাত ঘ্যাস ঘ্যাস করে তার গাল চুলকে না-সূচকভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “নাহ্। পোষালো না। এত বড় একটা জাহাজ, এতগুলো বড়লোক মানুষ-মালসামান, গয়নাগাটি, টাকা-পয়সা গুনে দেখি কিছুই না। মনে হয় সব ফকিরনীর পুত জাহাজে উঠে এসেছে।”
হঠাৎ করে তার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। নসু ডাকাত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এত কম টাকায় আমি রাজি না। আমি তাই তোদের কয়টাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ লাখ করে টাকা দিলে আমি ছেড়ে দেব।”
বদি ডাকাত হুংকার দিয়ে বলল, “মাত্র বিশ লাখ!”
নিচে বসে থাকা সবাই আতঙ্কের একটা চিৎকার করল। নসু ডাকাত সাথে সাথে তার বন্দুকটা উঁচু করে বলল, “খবরদার। একটা কথা না।”
জাহাজের নিচে আবার নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। নসু ডাকাত নিচে বসে থাকা আতঙ্কিত মানুষগুলোর দিকে তাকায়। তার প্রথম পছন্দ হল শারমিনকে। আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “এইটা।”
শারমিন, তার সাথে অনেকে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। নসু ডাকাত চিৎকার করে বলল, “খবরদার, কোনো শব্দ না। খুন করে ফেলব।”
শারমিনের মা তবুও চিৎকার করে অনুনয়-বিনুনয় করতে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। দুজন ডাকাত গিয়ে শারমিনের দুই হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে। নসু ডাকাত এরপর পছন্দ করল গীতিকে-সবার শেষে তৃষাকে। দুজন দুজন করে ডাকাত এক-একজনকে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিতে থাকে। রাতুল শেষ মুহূর্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। নসু ডাকাত তখন তার কাটা রাইফেলের বাট দিয়ে রাতুলের মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। রাতুল হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, পারল না। মাথা ঘুরে সে নিচে পড়ে গেল।
.
কিছুক্ষণের মাঝে সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের খুব বড় বিপদ। আমাদের তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা হতে পারে না।”
আলমগীর ভাই বললেন, “হতে পারে না মানে কী? হয়ে গেছে।”
“এখনো হয়নি।”
“তুমি কী বলতে চাইছ?”
“আমাদের হাতে এখনো একটু সময় আছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”
শামস বলল, “তোমার মাথা খারাপ? ওদের কাছে কত রকম আর্মস দেখেছ? এখনো তো কেউ মারা যায়নি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে কেউ না কেউ গুলি খাবে। কেউ না কেউ মারা যাবে।”
“তার মানে আমরা আমাদের তিনজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যেতে দেব?”
“কী করবে তা না হলে। যত তাড়াতাড়ি আমরা ফিরে গিয়ে র্যানসামের টাকা দিতে পারব–”
রাতুল শামসের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো উৎসাহ পেল না। সে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কয়েকজন ভলান্টিয়ার দরকার।”
সজল জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করতে হবে?”
“আমি আমার প্যানটা বলি। সব মিলিয়ে ডাকাত হচ্ছে সাতজন। এর মাঝে আমরা চারজনকে ডাবল ডোজ ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে পেরেছি। তাই না রাজা?”
রাজা মাথা নাড়ল, “জে। চারজন।”
আলমগীর ভাই চমকে উঠে বললেন, “কী বললে? ঘুমের ওষুধ খাইয়েছ? কেমন করে?”
“চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে। আমাদের রাজা করেছে। তার মানে আর দশ মিনিটের মধ্যে চারজন ঘুমিয়ে পড়বে। বাকি থাকল তিনজন। এক সাথে তিনজনের সাথে ফাইট করা যাবে না। কিন্তু একজন একজন করে হলে সম্ভব।”