নসু বলল, “কিন্তু বড়লোকের বেটাবেটি ধরে আনার জন্যে দেরি করে লাভ নাই। টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ভয়ের চোটে দিয়ে দেয়, আপত্তি করে না। কিন্তু ছেলেপিলে কেড়ে নিতে হলে মনে হয় বাধা দিতে পারে।”
কালোমলতান ডাকাত কাউলা বলল, “আমাগো সবার হাতে বন্দুক। বাধা দিব মানে? গুলি করে দুইটা লাশ ফেলে দিলেই সব ঠাণ্ডা।”
নসু বলল, “মাথা ঠাণ্ডা রাখ কাউলা। লাশ যদি ফেলতে হয় দুইটা কেন আমি দুই ডজনও ফেলতে পারি। কিন্তু লাশ মানেই ঝামেলা। ভয় দেখা, মাইরপিট কর কিন্তু দরকার না হলে লাশ ফেলবি না।”
“ঠিক আছে।”
বদি জানতে চাইল, “তা হলে কী ঠিক হল ওস্তাদ?”
নসু ডাকাত বলল, “চল, এখন নিচে যাই। তারপর যে কটা দরকার ধরে আনি।”
“ধরে এনে রাখব কোথায়?”
“সোজা ট্রলারে। ট্রলারের ঝাঁপ ফেলে দে। নিচে বেঞ্চে ফেলে রাখবি। গামছা দিয়ে মুখ বেন্ধে রাখবি। চোখ বেন্ধে রাখবি।”
ডাকাতগুলো মাথা নাড়ল। বলল, “জে আচ্ছা।”
নসু বলল, “চল যাই।”
বদি বলল, “যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে শরীলটা গরম করে নিই ওস্তাদ।”
“চা। চা কোথায় পাবি?”
“নিচে ব্যবস্থা আছে। তাই না রে রাজা?”
রাজা একজন ডাকাতের ঘাড়, হাত-পা টিপে দিচ্ছিল। সে মাথা নাড়ল। বলল, “জে ওস্তাদ আছে।”
“যা নিচে যা, সাত কাপ চা নিয়ে আয়।”
“সাথে আর কিছু? বিস্কুট, কলা?”
“যা আছে নিয়ে আয়।”
রাজা উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে ওস্তাদ।”
.
রাতুল চমকে উঠে বলল, “কী বলছ? জিম্মি নেবে?”
রাজা এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “জে বাই। সুন্দর সুন্দর দেখে মেয়েছেলে ট্রলারে তুলে নিয়ে যাবে।”
“সর্বনাশ।”
“জে বাই। সর্বনাশ। আমারে চা আনতে বলেছে। চা খেয়েই নিচে নামবে।”
রাজা কোনো কথা বলল না। রাতুল বুকের ভেতর কেমন এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। যখন তাদের টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র নিয়েছে তখন কেউ আপত্তি করেনি। যদি এখান থেকে মেয়েদের তুলে নেয় তখন তো চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়-তাদের বাধা দিতে হবে। তখন কী হবে? তখন গোলাগুলি হবে? তাদের কেউ গুলি খাবে? মারা যাবে? রাতুল পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না। সব মিলিয়ে সাতজন ডাকাত-সবার কাছেই এখন বন্দুক না হয় রাইফেল। মানুষগুলো ভয়ংকর, খালি হাতেই ভয়ংকর। হাতে অস্ত্র থাকলে এরা আরও একশ গুণ ভয়ংকর হতে পারে।
রাজা চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব, ভাই?” সে একটু আগে উপর থেকে নিচে নেমে এসেছে। নিচে সবার চুপচাপ বসে থাকার কথা। তারপরও সে সাবধানে রাজার সাথে কথা বলছে। আশেপাশে কেউ নেই কিন্তু সবাই তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই বুঝে গেছে কিছু একটা বিপদ আসছে।
রাতুল বলল, “তুমি চা বানাতে শুরু কর। আমি আসছি।”
রাতুল তখন খুব সাবধানে, প্রায় নিঃশব্দে নাট্যকার বাতিউল্লাহর কাছে গেল। পাশে বসে গলা নামিয়ে বলল, “স্যার। আপনার পকেটে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো আছে না?”
“হ্যাঁ আছে। কেন?”
“আমাকে দেন।”
“কী করবে?”
“এখন প্রশ্ন করবেন না স্যার, আমাকে দেন।”
“তুমি কী করবে? পরে আমি বিপদে পড়ব।”
“আমরা সবাই বিপদের মাঝে আছি। এর থেকে বেশি বিপদের মাঝে পড়া সম্ভব না।”
বাতিউল্লাহ খুব অনিচ্ছার সঙ্গে ট্যাবলেটগুলো বের করলেন। রাতুল সাবধানে হাতে নিয়ে বলল, “কয়টা খেলে একজন খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে?”
“সেটা মানুষের সাইজের উপর নির্ভর করে।”
“সাধারণ সাইজ।”
“দুইটা। দশ মিনিটে আউট হয়ে যাবে।”
“ওষুধের কোনো গন্ধ আছে? স্বাদ?”
“থাকবে না কেন? যে কোনো ওষুধের গন্ধ থাকে, স্বাদ থাকে।”
“বেশি, না কম?”
“বেশি-কম এই শব্দগুলো খুবই আপেক্ষিক।”
“আহ্!” রাতুল বিরক্ত হয়ে বলল, “বাড়াবাড়ি কিছু আছে কি না–”
“মনে হয় নাই। কিন্তু লং টাইম রি-অ্যাকশান–”
রাতুল আর কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না। সাবধানে রাজার কাছে হাজির হল। রাজা সাত কাপ চা তৈরি করেছে। রাতুল বলল, “আট কাপ বানাও।”
“আরেকটা কেন?”
“তোমার জন্যে। তুমিও খাবে।”
“কেন?”
রাতুল দুটো দুটো ট্যাবলেট গুঁড়ো করে চায়ের কাপে দিয়ে বলল, “ওদের বিশ্বাস করানোর জন্যে। এগুলো ঘুমের ওষুধ, দশ মিনিটের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে।”
রাজার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ”সত্যি!”
“হ্যাঁ। যদি খাওয়াতে পার।”
“আমি খেলে আমিও ঘুমিয়ে পড়ব?”
“হ্যাঁ। কাজেই তুমি খাবার ভান করবে। এক-আধ চুমুক খাবে, বেশি না।”
“ঠিক আছে।”
রাতুল এদিক-সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “তারা যদি ওষুধের গন্ধের কথা বলে তা হলে বলবে, পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট দিয়ে আমরা পানি খাই। সেই জন্যে পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ। বুঝেছ?”
“বুঝেছি। ক্লোরিন?”
“হ্যাঁ, ক্লোরিন। মনে থাকবে?”
“জে। মনে থাকবে।”
রাতুল তখন বাক্স থেকে নতুন বিস্কুটের প্যাকেট বের করে দিল, কলা দিল, চানাচুরের প্যাকেট দিল। দিয়ে বলল, “যাও। এখন সবকিছু নির্ভর করছে তোমার উপর। যদি বুঝতে পারে ঘুমের ওষুধ দিয়ে চা এনেছ তা হলে তোমাকে কিন্তু খুন করে ফেলবে।”
“জানি।”
“ভয় করছে?”
“না। আমার ভয় করে না।” রাজা দাঁত বের করে হাসল, “আমার মা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিয়েছে, আমার কখনো বিপদ হবে না।”
রাতুল একটু হিংসা অনুভব করে, রাজার মতো সেও যদি বিশ্বাস করতে পারত যে তার কখনো কোনো বিপদ হবে না!