শামস বেশ কয়েকটা ছবি তুলল, নসু ডাকাত ছবিগুলো দেখে বেশ খুশি হল। শামসের পিঠে থাবা দিয়ে সে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের ঘাড়ে ঝুলিয়ে ফেলল। দামি ক্যামেরাসহ নসু ডাকাতকে তখন অত্যন্ত বিচিত্র দেখাতে থাকে।
কবি শাহরিয়ার মাজিদের মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় আবার একটু ঝামেলা হল, সেখানে একটা ময়লা পঞ্চাশ টাকার নোট এবং দুইটা বিশ টাকার নোট। ডাকাতটা খেপে গিয়ে বলল, “আর কিছু নাই?”
শাহরিয়ার মাজিদ মাথা নাড়লেন, “জে না। নাই।”
“ফকিরনীর পুত! তোর পকেটে একশ টাকাও নাই?”
শাহরিয়ার মাজিদ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ডাকাতটা রাইফেলের গোড়া দিয়ে তাকে মারতে গেল, শাহরিয়ার মাজিদ হাত তুলে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন, “আপনাগো আল্লাহর কসম লাগে আমারে মাইরেন না। আপনাগো পায়ে ধরি বাজান গো আমারে মাফ করেন। আমি নাদান মানুষ–”
শাহরিয়ার মাজিদের কান্নায় কাজ হল, ডাকাতটা তাকে ছেড়ে দিয়ে পরের জনের কাছে গেল।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবার কাছ থেকে যা কিছু নেওয়ার মতো সব নিয়ে নেওয়া হল। ডাকাতগুলো পুঁটলি বেঁধে সেগুলো নিয়ে উপরে উঠে যায়। যাবার আগে চারিদিকের তেরপলের পর্দাগুলো টেনে দিল যেন বাইরে থেকে কেউ ভিতরে দেখতে না পারে।
নসু ডাকাত যাবার আগে উপরে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা হুমকি দিল, “খবরদার কেউ কোনো রকম উল্টাপাল্টা কাজ করবা না। এইখানে সবাই চুপচাপ বসে থাকবা। কোনো কথাবার্তা নাই, কোনো গোলমাল নাই। আমরা উপরে আছি, যদি শুনি নিচে গোলমাল, কথাবার্তা তা হলে কিন্তু খুন করে ফেলব।”
সবাই চুপ করে রইল। নসু ডাকাত আবার বলল, “মনে থাকে যেন, আমি কোনো গোলমাল চাই না। ছোট পোলাপানরা যেন উঁ্যা ফুঁ না করে। আমি কিন্তু পোলাপানদের কান্নাকাটি সহ্য করি না।”
নসু ডাকাত সিঁড়ি দিয়ে আরও দুই পা উঠে আরও একবার দাঁড়াল, বলল, “এইখানে একজন বন্দুক নিয়ে পাহারায় থাকব। সাবধান।”
নসু ডাকাতের পিছু পিছু রাজাও উপরে উঠে যাবার চেষ্টা করছিল, অন্য ডাকাতগুলো তাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও নসু ডাকাত হাত নেড়ে তাকে আসতে অনুমতি দিল।
উপরে উঠে রাজা সাবধানে একবার চারদিক ঘুরে এলো। সারেং টিকেট মাস্টার খালাসি সবাইকে হাত-পা বেঁধে বিভিন্ন ঘরে তালা মেরে রেখেছে। কেবিনের প্রত্যেকটা রুম খোলা, ভিতরে সবকিছু তছনছ হয়ে আছে। ডাকাতের দল ডেকের মাঝামাঝি বসে নিচ থেকে কেড়ে নিয়ে আসা জিনিসপত্র, গয়নাগাটি, টাকা-পয়সার হিসাব করতে বসে।
নসু ডাকাত টাকাগুলো গুনল, গয়নাগুলো হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল, বস্তার ভিতর হাত দিয়ে মোবাইল টেলিফোনগুলো দেখার চেষ্টা করে না-সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “এত বড় একটা জাহাজ দখল করে মাত্র এই অল্প কয়টা জিনিস? পোষালো না।”
নসু ডাকাতের পাশে বসে থাকা কম বয়সী একটা ডাকাত বলল, “মাছ ধরার ট্রলার লুট করেই তো এর থেকে বেশি পাওয়া যায়।”
“সমস্যাটি কী বুঝেছিস?”
“কী?”
“বড়লোকেরা আজকাল পকেটে ক্যাশ টাকা রাখে না। প্রাস্টিকের একরকম কার্ড আছে, সেইটা দিয়ে টাকা-পয়সার লেনদেন করে।”
কম বয়সী ডাকাত বলল, “ক্রেডিট কার্ড।“
“হ্যাঁ। ক্রেডিট কার্ড।” নসু ডাকাত গাল চুলকে বলল, “বড়লোকের বেটিরা রাস্তাঘাটে গয়নাগাটিও পরে না। যদি মনে কর একটা বিয়াবাড়িতে ডাকাতি করতে পারতাম দেখতি তা হলে কী হত!”
“কিন্তু এইটা তো বিয়াবাড়ি না। এইটা জাহাজ।”
“মালসামান বোঝাই জাহাজ হলে একটা কথা ছিল–খালি জাহাজ!”
ডাকাতগুলো বিরক্ত হয়ে তাদের লুট করা জিনিসগুলো দেখতে থাকে। একজন আনসার গুলি খেয়েছে সেটাও ঝামেলা। পরের কয়দিন পুলিশ-কোস্টগার্ড বিরক্ত করবে। যদি মানুষটা মরে যায় তা হলে তো অনেকদিন জঙ্গল থেকেই বের হতে পারবে না।
নসু ডাকাত আবার হতাশভাবে মাথা নাড়ল, না একেবারেই পোষালো না।
কম বয়সী ডাকাতটা বলল, “ওস্তাদ। বেয়াদপি না নিলে একটা কথা বলি?”
নসু ভুরু কুঁচকে তাকালো ”কী বলবি?”
“ধরেন এই জাহাজে মালসামান, টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি না থাকতে পারে কিন্তু ধরেন একটা জিনিসের তো অভাব নেই।”
“কী?”
“বড়লোকের সুন্দর সুন্দর বেটাবেটি! ধরেন যদি তার কয়েকটারে ধরে নিয়ে যাই, তারপর যদি বলি বিশ লাখ, পঁচিশ লাখ টাকা না দিলে ছাড়মু না। তা হলেই তো এক কোটি হয়ে যায়।”
নসু ডাকাত তীক্ষ্ণ চোখে কম বয়সী ডাকাতটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “বদি।”
“জে ওস্তাদ।”
“তোর মাথাটা সবার চাইতে পরিষ্কার।”
বদি খুশি হয়ে উঠল, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আপনার দোয়া।”
“একেবারে ফার্স্ট ক্লাস বুদ্ধি।”
“জে।”
“আমাগো কোনো তাড়াহুড়া নাই, কোনো দৌড়াদৌড়ি নাই, খোঁজাখুঁজি নাই। সবগুলা আমাদের জন্যে নিচে অপেক্ষা করছে। আমরা শুধু নিচে যামু, তারপর বেছে বেছে কয়েকটারে তুলে নিয়ে আসমু।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মতোন একজন ডাকাত বলল, “সুন্দর সুন্দর মেয়েলোক দেখে–”
নসু ধমক দিল, “চোপ থাক কাউলা। খালি সুন্দর সুন্দর মেয়ে! সুন্দর সুন্দর মেয়ে। টাকা দিলে আমার কাছে সবই সুন্দর।”
কম বয়সী ডাকাত বদি বলল, “জোয়ার শুরু হতে ধরেন এখনও এক ঘণ্টা। আমাদের হাতে অনেক সময়।”