এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না।
নসু ডাকাত এবারে একটা হুংকার দিল, “বুঝেছ?”
এবারে ভয় পেয়ে সবাই মাথা নাড়ে। নসু ডাকাত সন্তুষ্টির মতো একটা শব্দ করে বলল, “খবরদার কেউ তেড়িবেড়ি করবা না। এই জাহাজ আমার দখলে, সারেং খালাসি গার্ড মাস্টার যা আছে সবাইরে দড়ি দিয়ে বেন্ধে তালা মেরে রেখেছি। জাহাজের বাকি প্যাসেঞ্জার এইখানে। দুইজন আনসার ছিল, তাদের তেজ বেশি। আরে ব্যাটা-মিলিটারি পুলিশ কোস্টগার্ড আমার সাথে পারে না। তুই আনসারের বাচ্চা আনসার আমাকে গুলি করিস? সেই ব্যাটাদের উচিত শিক্ষা হয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ে আছে। অচল।” নসু ডাকাত সুর পাল্টে বলল, “কাজেই তোমরা কোনো ধান্ধাবাজি করবা না। কোনো গোলমাল করবা না। বুঝেছ?”
কেউ কোনো কথা বলল না। নসু ডাকাত বলল, “সবাই বসে যাও। বস। বস।”
যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এবার তারা বসে গেল। নসু ডাকাত সন্তুষ্টির একটা ভাব করে বলল, “চমৎকার। আমি যা বলি তোমরা যদি সেই রকম কাজ কর তা হলে তোমাদের জন্যে ভালো, আমার জন্যেও ভালো। খবরদার কোনো রকম উনিশ-বিশ করবা না, যদি করো আমি কিন্তু সাথে সাথে ধাক্কা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিব। বুঝেছ?”
কেউ কোনো কথা বলল না। ঠিক সেই সময় রাজা একটা বেঞ্চের তলা থেকে বের হয়ে এলো, সে তার প্যান্ট টি-শার্ট পাল্টে তার শতচ্ছিন্ন পুরনো ময়লা কাপড় পরে ফেলেছে, মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে কালিঝুলি ময়লা। নসু ডাকাত ধমক দিয়ে বলল, “কে? কে? বেঞ্চের তলা থেকে কে বের হয়?”
রাজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ওস্তাদ।”
“তুই কে?”
”আমার নাম রাজা।”
নসু ডাকাত হা হা করে হাসল, “চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না তুই রাজা। দেখে তো মনে হচ্ছে তুই ফকিরনীর বাচ্চা।”
রাজা দাঁত বের করে হাসল। নসু ডাকাত জিজ্ঞেস করল, “তুই বেঞ্চের তলায় কী করিস?”
“ঘুমাই ওস্তাদ।” রাজা বসে থাকা সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই স্যারেরা আমাকে দেখলে খুবই রাগ হয়, বিরক্ত হয়। আমারে মারে। সেই জন্যে স্যার এই চিপার মাঝে শুয়ে থাকি।”
নসু ডাকাত মুখ শক্ত করে বলল, “বড়লোকের বাচ্চা হচ্ছে হারামির বাচ্চা।”
“জে স্যার। আমারে ঠিক করে খেতেও দেয় না।”
“খেতে দেয় না?”
“না স্যার। কোনো কিছু হারানো গেলেই আমারে দোষ দেয়। বলে আমি চুরি করেছি। আমারে মারে।”
এই প্রথম সে একটা কথা বলল, যেটা খানিকটা হলেও সত্যি। শারমিন অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসল। নসু ডাকাত চোখ লাল করে বলল, “কোন জন মারে? কোন হারামজাদা মারে? আমারে দেখা। লাথি মেরে সমুদ্রে ফেলে দেই।”
রাজা বসে থাকা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “এখন ওস্তাদ চিনতে পারমু। বড়লোকের ছাওয়ালদের সবাইকে একরকম লাগে।”
নসু ডাকাত বলল, “সে কথা সত্যি। বড়লোকদের চেহারা একরকম, স্বভাবচরিত্র একরকম।”
রাজা বলল, “ওস্তাদ।”
“কী?”
“আপনার যদি কিছু লাগে আমারে বলবেন।”
“তোকে বলব? তুই কী করবি?”
“এই ধরেন যদি চা-নাস্তা খেতে চান। এইখানে চা-নাস্তার খুব ভালো বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু আমারে খেতে দেয় না।”
“খা। খা। এখন তুই নিশ্চিন্ত মনে খা। কোনো কিছু চিন্তা নাই।”
“জে। খামু।”
নসু ডাকাত আবার অন্যদের দিকে মন দিল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটা ডাকাতের হাত থেকে একটা বস্তা আর দুইটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে বলল, “এখন আমার লোকজন মালসামান টাকা-পয়সা গয়নাপাতি নেওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে যাবে। এই বস্তাটা হচ্ছে মালসামানের বস্তা। মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ঘড়ি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, বাজনাবাদ্য শোনার ছোটবড় ক্যাসেট প্লেয়ার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যা আছে সব এই বস্তার মাঝে দিবা। খবরদার কেউ কিছু লুকায়া রাখবা না। যদি আমি টের পাই কেউ কিছু লুকায়া রাখছ সাথে সাথে গুলি। মনে থাকব?”
সবাই মাথা নাড়ল, জানাল যে মনে থাকবে। নসু ডাকাত তখন পলিথিনের দুইটা ব্যাগ তুলে বলল, “এই দুইটা হচ্ছে সোনাদানা আর টাকা-পয়সার ব্যাগ। মা-বোন তোমরা তোমাদের গয়নাপাতি এখানে দিবা। হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার নেকলেস কিছুই বাদ দিবা না। আজকাল অবশ্যি পুরুষ মানুষেও গয়না পরে। গলায় মালা দেয়, কানে দুল পরে। তোমাদের মাঝে যারা পুরুষ মানুষ গয়না পরে আছ গয়না খুলে দিবা।” নসু ডাকাত তখন আরেকটা ব্যাগ দেখিয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে ক্যাশ টাকার ব্যাগ। যার পকেটে মানি ব্যাগে যত টাকা আছে সব এই ব্যাগে। ঠিক আছে?”
কেউ কোনো কথা বলল না, নসু ডাকাত সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। তিনজন ডাকাত একটা বস্তা আর দুইটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে জিনিসপত্র, সোনা গহনা আর মানিব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা নিতে শুরু করল। মহিলারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাদের কানের দুল, হাতের চুড়ি খুলে দিতে লাগলেন, ছোট একটা বাচ্চা মেয়ের গলা থেকে মালাটা খুলে নেওয়ার সময় সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শামসের দামি ক্যামেরাটা নেবার সময় ডাকাতগুলো খুশি হয়ে উঠল, নসু ডাকাতকে দেখিয়ে বলল, “ওস্তাদ! মালদার পার্টি। দামি ক্যামেরা।”
নসু ডাকাত বলল, “ছবি ওঠে?”
শামস মাথা নাড়ল। নসু ডাকাত জিজ্ঞেস করল, “ছবি দেখা যায়?” শামস আবার মাথা নাড়ল। নসু ডাকাত তখন তার কাটা রাইফেলটা ঘাড়ে নিয়ে বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, “তোল আমার ছবি, ভালো না হলে কিন্তু জবাই করে ফেলমু।”