বয়স্ক মানুষটা যন্ত্রণায় শব্দ করে মাথা নাড়ল। ডাকাতটা বলল, “এখন আমি আপনার মাথায় গুলি করি?” হঠাৎ সে ভয়ংকর গলায় চিৎকার করে উঠল, “করি গুলি?”
বয়স্ক মানুষটা এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে ডাকাতটার দিকে তাকিয়ে রইল, রাতুলের মনে হল ডাকাতটা সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে। সে নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, ডাকাতটি শেষ পর্যন্ত গুলি করল না, উঠে দাঁড়িয়ে মনে হল। প্রথমবার রাতুলকে দেখতে পেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কে?”
রাতুল ঢোক গিলে বলল, “আমি কেউ না।”
“কেউ না আবার কী?”
“না মানে, আমি জাহাজের প্যাসেঞ্জার।”
“জাহাজের প্যাসেঞ্জার ছাদে কী করিস?”
“কিছু করি না।”
ডাকাতটা কিছুক্ষণ তার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর খপ করে তাকে ধরে টেনে দাঁড়া করিয়ে বলল, “যা নিচে যা। সবাইরে এক জায়গায় হাজির হতে বল। একজনও যদি অন্য জায়গায় থাকে তা হলে তোর জান শেষ।” কথা শেষ করে ডাকাতটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
এই লোকটা নিশ্চয়ই ডাকাতের সর্দার, সে অন্য ডাকাতগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “যা তোরা জাহাজ দখল নে। কেউ যদি কোনো উনিশ-বিশ করে তা হলে গুলি। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“কেবিনের প্যাসেঞ্জারদেরও নিচে পাঠা, সেইখানে পাহারায় থাক দুজন।”
“ঠিক আছে।”
রাতুল যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো দেখল সবাই আতঙ্কিত হয়ে জাহাজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। রাতুলকে দেখে তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রাতুল?”
“ডাকাত।”
“আনসার দুজন কী করছে?”
“একজন গুলি খেয়েছে, অন্যজনকে আটকে ফেলেছে। রাইফেল দুটি নিয়ে গেছে।”
“পুলিশ-কোস্টগার্ডকে কী খবর দেওয়া যায় না?”
কে একজন বলল, “আমরা সমুদ্রের অনেক ভেতরে। এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই।”
“এখন কী হবে?”
রাতুল বলল, “আমি জানি না।”
ঠিক তখন ওরা শুনতে পেল ছাদে ধুপধাপ করে কারা দৌড়াচ্ছে, কয়েকটা গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার শোনা গেল। তারপর দেখল সিঁড়ি দিয়ে আতঙ্কিত মুখে কেবিনের যাত্রীরা নেমে আসছে। শারমিন, তার মা, শামস, আজাদ, বাতিউল্লাহ, অন্যরা এবং সবার শেষে শাহরিয়ার মাজিদ। শাহরিয়ার মাজিদ একটা লুঙি পরে আছেন, লুঙিটা খুলে যাচ্ছিল। কোমরের কাছে হাত দিয়ে ধরে রেখে ভাঙা গলায় বললেন, “ডাকাইত! জাহাজের মইধ্যে ডাকাইত পড়ছে। ডাকাইত!”
এত বিপদের মাঝেও রাতুল লক্ষ করল এই মানুষটা সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে, কিন্তু এখন এই প্রথমবার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। এটা হচ্ছে। তার সত্যিকারের রূপ-অন্য সময় যেটা দেখে সেটা হচ্ছে ভান।
ঘরের মাঝখানে সবাই একত্র হয়েছে, কেউ একজন হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, হাসি এবং কান্না দুটিই মনে হয় সংক্রামক, কান্নার শব্দ শুনে একসাথে অনেকে কেঁদে ওঠে।
রাতুল হঠাৎ লক্ষ করল, কেউ তার শার্টের কোনা ধরে টানছে। তাকিয়ে দেখে রাজা। রাতুল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই রাজা গলা নামিয়ে বলল, “স্যার! আমি কী ডাকাতের দলের সাথে ভাব করার চেষ্টা করমু?”
“ডাকাত দলের সাথে?”
“জে।”
“কেমন করে?”
“আপনি যদি বলেন, তা হলে চেষ্টা করি।”
“তোমার কোনো বিপদ হবে না তো?”
“না স্যার। আমাগো কখনো কোনো বিপদ হয় না।”
রাতুল কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “ঠিক আছে।”
রাজা অদৃশ্য হয়ে গেল আর ঠিক তখন বিভিন্ন সিঁড়ি দিয়ে ওপর থেকে ডাকাতগুলো নামতে থাকে। ভেতরে যারা ছিল তারা হঠাৎ করে চুপ করে গেল।
ডাকাতগুলো তাদের বন্দুক নিয়ে বিভিন্ন কোনায় দাঁড়িয়ে যায়, শুধু ডাকাতের সর্দারটি হেঁটে হেঁটে সবার খুব কাছাকাছি আসে। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখ খুব কাছে থেকে দেখে, তারপর হেঁটে হেঁটে আবার একটু পিছিয়ে যায়। কাছাকাছি একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে আনে কিন্তু সেখানে না বসে সেখানে একটা পা তুলে দাঁড়ায়, তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ বের করে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, “আমার নাম নসু। যারা খারাপ লোক তারা আমারে ডাকে নসু ডাকাত! যারা ভদ্রলোক তারা আমারে ডাকে জলদস্যু নসু। আমি আসলে এর কোনোটাই না। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, ন্যায্য কথার মানুষ, ন্যায্য কামের মানুষ, ন্যায্য বিচারের মানুষ!–”
নসু ডাকাত খুব একটা নাটকীয় ভাব করে সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে, তোমাদের দিকে তাকিয়ে দেখ। তোমাদের চেহারায় কী চেকনাই। গায়ের রং কত সুন্দর, সবাই নাদুস-নুদুস গোলগাল। পোশাক কত সুন্দর। সবাই বড়লোকের বাচ্চা। বাড়িতে এয়ারকন্ডিশন, টেলিভিশন। ফ্রিজের ভিতরে কত রকম খাবার। ব্যাংকভর্তি টাকা। গাড়ি করে ঘুরে বেড়াও। হ্যাঁ। আর আমরা? লেখাপড়া করতে পারি নাই। রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি। এক বেলা খাই তো আরেক বেলা না খেয়ে থাকি। আমাদের চেহারা দেখ। দেখ? বল এইটা কোন বিচার? কেন তোমাদের সবকিছু আছে, আমাদের কিছু নাই?”
নসু ডাকাতকে দেখে মনে হল সে আশা করে আছে কেউ তার এই প্রশ্নের উত্তর দিবে, কেউ কথা বলল না, তখন সে নিজেই বলল, “সেই জন্যে আমি একটা ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা করেছি। তোমাদের যে বেশি বেশি মালসামান আছে, গয়নাগাটি আছে, টাকা-পয়সা আছে আমি সেইগুলো নিব, নিয়ে একটু ন্যায্য বিচার করব। বুঝেছ?”