“কী হয়েছে?”
রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “না কিছু না।”
“বল কী হয়েছে?”
“না। বলার মতো কিছু হয়নি। আমি তো একটু গাধা টাইপের মানুষ সেটাই হচ্ছে সমস্যা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি।”
রাতুল সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যায়, তৃষা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে গেল।
.
ছাদের এক কোনায় আনসার দুজন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুখে এক ধরনের উদ্বেগের চিহ্ন। রাতুল কাছে গিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”
কম বয়সী আনসারটি বলল, “ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না।”
আনসার মানুষটির গলার স্বর শুনে রাতুলের বুকটা কেমন জানি ধক করে ওঠে, জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”
মানুষটি হাত তুলে বহুদূরে দেখিয়ে বলল, “ওই দেখেন?”
“কী?” রাতুল কিছু দেখতে পেল না।”
একটা ট্রলার।”
রাতুল এবারে দেখতে পেল। বহুদূরে একটা ট্রলার কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আসছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এই ট্রলারের?”
“এই দিকে আসছে।”
“এই দিকে আসলে কী হবে?”
“ট্রলারে কারা আছে জানি না।”
“কারা আছে মানে? কারা থাকবে?”
আনসার মানুষটি বলল, “বুঝতে পারছেন না? একটা জাহাজ ডুবোচরে আটকে আছে জাহাজভর্তি বড়লোক মানুষ, তাদের বউ-বাচ্চা! ডাকাতি করার জন্যে এর থেকে সোজা জিনিস কী আছে?”
রাতুল চমকে উঠল, “ডাকাত?”
“হতে পারে।”
“আপনারা আছেন না? আপনাদের রাইফেল আছে না?”
আনসার তার রাইফেলটা হাতে নিয়ে বলল, “এইটা আসলে রাইফেল না। এইটা হচ্ছে একটা ডাণ্ডা। এইটা দিয়ে মানুষের মাথায় বাড়ি দেওয়া যায়, গুলি করা যায় না।”
“মানে?”
“মানে আবার কী!” আনসার মানুষটা হাত নেড়ে বলল, “ডাকাতদের কাছে এখন অটোমেটিক রাইফেল থাকে! আমাদের এই রাইফেল দেখে ডাকাতেরা হাসাহাসি করে।”
বয়স্ক আনসারটা এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার সে মুখ খুলল, বলল, “তুমি খামোখা কেন ভয় দেখাচ্ছ? ডাকাত তো নাও হতে পারে। মাছ ধরা ট্রলার হতে পারে।”
“হতে পারে। আমিও তাই চাই। দোয়া করছি তাই যেন হয়। শুধু বলছি–”
“কী বলছ?”
“বলছি নিশানাটা ভালো লাগছে না। সোজা আমাদের দিকে আসছে।”
মধ্য বয়স্ক আনসারটা একটা নিশ্বাস ফেলে তার কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে হাতে নেয়, ম্যাগাজিনটা খুলে ভেতরে দেখে তারপর ম্যাগাজিনটা রাইফেলে লাগিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতুল দেখল এই শীতের মাঝেও মানুষটা কুলকুল করে ঘামছে। রাতুল হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, তার বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডটা ধক ধক করে শব্দ করতে থাকে, যদি সত্যিই এটি ডাকাতের ট্রলার হয় তা হলে কী হবে?
ট্রলারটি কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ তার ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দেয়, নিঃশব্দে সেটা তখন জাহাজের দিকে এগোতে থাকে। একজন মানুষ হাল ধরে আছে, ট্রলারের ছাদে একজন মানুষ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বয়স্ক আনসারটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে চাপা স্বরে বলল, “সর্বনাশ! নসু ডাকাত!” তারপর হঠাৎ করে রাইফেল তাক করে চিৎকার করে বলল, “খবরদার জাহাজের কাছে আসবে না। চলে যাও। ইঞ্জিন চালু করে চলে যাও।”
ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, “কী বলেন ওস্তাদ শুনতে পাই না।”
আনসারটি ধমক দিয়ে বলল, “খুব ভালো করে শুনতে পেয়েছ আমি কী বলেছি। যাও। যাও এখান থেকে। ভাগো। না হলে কিন্তু গুলি করে দেব।”
“গুলি করবেন? গুলি করবেন কেন? আমি কী করেছি?”
রাতুল দেখল ট্রলারটা ভাসতে ভাসতে একেবারে জাহাজের কাছে চলে এসেছে।
আনসারটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার।” তারপর সত্যি সত্যি রাইফেল তুলে গুলি করল।
ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে সরে যায়, হঠাৎ করে হাত পিছনে নিয়ে কোথা থেকে টান দিয়ে একটা কাটা রাইফেল এনে গুলি করতে থাকে, রাতুলের কানের কাছ দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে কিছু একটা ছুটে গেল, তখন সে এক লাফে ছাদে শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না।
আনসার দুজন রাইফেল দিয়ে গুলি করছে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায় এবং তার মাঝে বয়স্ক আনসারটি হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে পেছন দিকে ছিটকে পড়ল। রাতুল দেখল সে ডান হাত দিয়ে কাঁধের কাছে ধরে রেখেছে এবং সেখান দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।
রাতুল হঠাৎ ধুপ ধাপ শব্দ শুনল এবং পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ছয় সাতজন ভয়ংকর দর্শন মানুষ ছাদে লাফিয়ে উঠে এসেছে। মানুষগুলোর সারা শরীর ভেজা, শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, তাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র। বন্দুক হাতে একজন ছুটে এসে কম বয়সী আনসারটার মাথায় আঘাত করে, সঙ্গে সঙ্গে কাতর শব্দ করে মানুষটা নিচে পড়ে গেল। ট্রলার থেকে এরা আগেই পানিতে নেমে গেছে, সাঁতরে পিছন থেকে এসে উঠেছে।
রাতুল মাথা তুলে দেখল ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিও রেলিং বেয়ে ছাদে উঠে এসেছে, কাটা রাইফেলটা ধরে রেখে সে আনসারদের রাইফেল দুটি নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর বয়স্ক আনসারের কাছে গিয়ে তার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে বলল, “ওস্তাদ আমি আপনাকে বলেছিলাম গুলি করবেন না। বলেছিলাম কি না?”
বয়স্ক মানুষটা তার ক্ষতস্থানটা ধরে রেখে দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল এ ডাকাতটা বলল, “আপনি আমার কথা শুনেন নাই। শুনেছেন?”