রাতুল এবারেও কোনো কথা বলল না। শামস হাসার ভঙ্গি করে বলল, “এই ছবিগুলো রেখে দিও। তোমার গার্লফ্রেন্ডকে ইমপ্রেসড করতে পারবে।”
রাতুল এবার ঘুরে শামসের দিকে তাকাল, শীতল গলায় বলল, “আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে ইমপ্রেস করার জন্যে ছাদ থেকে পানিতে লাফ দেই নাই। বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্যে লাফ দিয়েছিলাম। এ ছবিগুলো আপনি আপনার কাছে রেখে দেন। আপনার গার্লফ্রেন্ডকে দেখাবেন আপনি কত সুন্দর ছবি তুলতে পারেন।”
রাতুল যখন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে গেল তখন শামস দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে বলল, “বেয়াদপ ছেলে!” রাতুল অবশ্যি কথাটি শুনতে পেল না।
রাতুলকে সজল একটা ট্রাউজার দিল। গীতি দিল একটা টি-শার্ট। ভেজা কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে রাতুল তার বিছানার চাদরটা গায়ে দিয়ে নিচে গিয়ে দেখতে পেল সেখানে প্রচণ্ড উত্তেজনা। নাট্যকার বাতিউল্লাহ আর কবি শাহরিয়ার মাজিদ প্রচণ্ড ঝগড়া করছেন। ঝগড়াটা শুরু হয়েছে এভাবে : শাহরিয়ার মাজিদ বাতিউল্লাহকে বলেছেন, “অনেকদিন পর আজকে একটা ভালো কবিতা লিখেছি।”
বাতিউল্লাহ কোনো উত্তর দিলেন না। শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “প্রত্যেকটা শব্দ সুষম, একটার সাথে আরেকটা সুবিন্যস্ত।”
বাতিউল্লাহ তখনও কোনো কথা বলেননি। শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “এই জাহাজে আমার কবিতা অনুধাবন করার কেউ নেই। আপনি হয়তো একটু বুঝতে পারবেন। পড়ে শোনাব?”
বাতিউল্লাহ তখন বলেছেন, “আপনার কবিতা পাকিয়ে সরু পেন্সিলের মতো করে আপনার ইয়ে দিয়ে ঢুকিয়ে দেন।”
তারপরই ঝগড়ার সূত্রপাত। শাহরিয়ার মাজিদ বাতিউল্লাহকে ডেকেছেন অশ্লীল, ইতর, অভদ্র এবং বর্বর। বাতিউল্লাহ শাহরিয়ার মাজিদকে ডেকেছেন উম্মাদ, বালখিল্য, প্রতারক এবং ভুয়া, তার জন্যে পুরো জাহাজ ডুবোচরে বাঁকা হয়ে আটকে আছে এবং এখান থেকে কখন তারা ছুটতে পারবেন তার কোনো গ্যারান্টি নাই। বাতিউল্লাহ মনে করিয়ে দিলেন শুধু যে জাহাজ আটকা পড়েছে তা নয়, আরেকটু হলে একটা বাচ্চা পানিতে ডুবে ভেসে যেত। রাতুলকে দেখিয়ে বললেন, “এই ছেলেটা ছিল বলে বাচ্চাটি জানে বেঁচে গেছে।”
রাতুল ঝগড়াটা খুবই উপভোগ করছিল কিন্তু সবাই মিলে দুজনকে আলাদা করে দিল। রাতুল তখন শান্তকে খুঁজে বের করল, দোতলার ডেকে সে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। মৌটুসি, টুম্পা, টুবলু এবং অন্য সব বাচ্চা তাকে ঘিরে বসে আছে। তুষাও সেখানে আছে, শান্ত ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে, তৃষা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
শান্ত ফাঁস ফাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাসায় যাব। আম্মুর কাছে যাব।”
তৃষা বলল, “এই তো আর একদিন, তারপর বাসায় পৌঁছে যাব।”
শান্ত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “জাহাজ আটকে গেছে। আমরা আর কোনোদিন বাসায় যেতে পারব না।”
তৃষা বলল, “কে বলেছে পারব না? শুনছ না জাহাজের ইঞ্জিন চলছে। চেষ্টা করছে ডুবোচর থেকে ছুটিয়ে আনতে?”
“পারবে না। কোনোদিন পারবে না।” শান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের সারাজীবন এইখানে থাকতে হবে।”
তৃষা বলল, “না শান্ত। সারাজীবন থাকতে হবে না।”
রাতুল বলল, “জাহাজের ইঞ্জিন যদি ছোটাতে না পারে তা হলে আমাদের শুধু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যখন জোয়ার আসবে তখন জাহাজ এমনিতেই ছুটে যাবে।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
রাতুল হাসল, বলল, “আমি কি কখনও তোমাদের মিথ্যা বলেছি?”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “না। বল নাই।”
“তা হলে?”
শান্তর মুখে এবারে একটু ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। টুম্পা রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া।”
“বল।”
“তুমি যখন জাহাজ থেকে ডাইভ দিয়েছ আমি সেটা দেখি নাই।”
অন্য সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “আমরা দেখেছি! আমরা দেখেছি!”
টুম্পা বলল, “তুমি আরেকবার ডাইভ দেবে? প্লীজ! প্লীজ! মাত্র একবার।”
রাতুল হাসতে থাকে, “বলে, ধুর! এত উঁচু থেকে ডাইভ দেওয়া সোজা না কি? আর পানি কী ঠাণ্ডা, তাই না শান্ত?”
শান্ত মাথা নাড়ল। টুম্পা বলল, “শান্তকে তোলার জন্যে তো ডাইভ দিয়েছ।”
“তখন কী এতকিছু চিন্তা করেছি না কি?”
মৌটুসি টুম্পাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “তুই যদি পানিতে পড়ে যাস তা হলে স্পাইডার ভাইয়া আবার ডাইভ দেবে। তাই না ভাইয়া?”
রাতুল চোখ কপালে তুলে বলল, “রক্ষা কর। কারও পানিতে পড়ে যাওয়ার দরকার নেই, আমার ডাইভ দেওয়ারও দরকার নেই। পানিতে না পড়েও একশ রকম মজা করা যায়। বুঝেছ?”
তৃষা উঠে দাঁড়াল, রাতুল তখন হাঁটতে শুরু করে। তৃষা পিছন থেকে ডাকল”রাতুল।”
রাতুল দাঁড়াল, “কী?”
“থ্যাংকু রাতুল।”
“কেন?”
“শান্তকে পানি থেকে তুলে আনার জন্যে।”
রাতুল কোনো কথা বলল না। তৃষা বলল, “তুই না থাকলে কী হত?”
“অন্য কেউ তুলে আনত। এই জাহাজেই অনেক এক্সপার্ট সুইমার আছে তারা অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুলে অনেক উপর থেকে ডাইভ দিতে পারে।”
“কে?”
“তারা আমার মতো ফালতু মানুষ না। তারা সেলিব্রেটি।”
তৃষা কিছুক্ষণ স্থির চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, “রাতুল তুই একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? তুই আমাকে খোঁচা না দিয়ে কথা বলতে পারিস না।”
রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আই অ্যাম সরি তৃষা। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আর কখনও তোকে খোঁচা দিব না। আসলে হয়েছে কী–”