জাহাজটা তার ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বামদিকে বহু দূরে সুন্দরবনের বনভূমি ডানদিকে সমুদ্র। সূর্যটা পিছন দিকে হেলে পড়েছে। শীতের বিকেলের একটা হিমেল হাওয়া। জাহাজের ছাদে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, মাঝামাঝি জায়গায় রাতুল বসেছে, তার কোলে একটা গিটার। কেউ একজন তার কাছে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। সে টুং টাং শব্দ করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে বাচ্চাদের দিকে চোখ রাখছে। ছাদের বেশি কিনারে চলে গেলে সে হালকা হুংকার দিয়ে বলছে, “কেউ কিনারায় যাবে না, মাঝখানে, সবাই মাঝখানে।”
হুংকার শোনার পর কিছুক্ষণের জন্যে সবাই মাঝখানে আসছে, কিছুক্ষণের মাঝে ভুলে গিয়ে আবার কিনারায় চলে যাচ্ছে। মৌটুসি খানিকক্ষণ ছোটাছুটি করে রাতুলের পাশে এসে বসে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া।”
“বল।”
“তুমি কী গান গাইতে পার?”
“নাহ।”
“পার। পার নিশ্চয়ই পার।” মৌটুসি বলল, “আমি জানি।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“তুমি বলেছ নাহ্! নাহ্ মানে একটু একটু পারি।”
“তাই না কি?”
“হ্যাঁ।”
“আর যারা আসলেই গাইতে পারে না তারা কী বলবে?”
“তারা বলবে,, পারি না!”
মৌটুসির কথা শুনে রাতুল একটু হাসল, বলল, “ভালোই বলেছ।”
“গাও না ভাইয়া। একটুখানি। এই এতটুকু।”
রাতুল গিটারে টোকা দিয়ে তার জানা গানের একটা লাইন নিচু গলায় গাইতে মাত্র শুরু করেছে, ঠিক তক্ষুনি ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ করে পুরো জাহাজটি দুলে উঠল, বিকট একটা শব্দ হল এবং পুরো জাহাজটি থেমে কাত হয়ে গেল। রাতুল শুধু দেখতে পেল জাহাজের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো ছিটকে উপরে উঠে জাহাজের ছাদে আছাড় খেয়ে পড়েছে। শুধু একজন–সেটি কে রাতুল জানে না, জাহাজের ছাদ থেকে প্রায় উড়ে গিয়ে সমুদ্রের পানিতে পড়েছে। রাতুল ছুটে গিয়ে দেখল বাচ্চাটি আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে সমুদ্রের নীল পানিতে ডুবে গেল।
রাতুল চিন্তা করার জন্যে কোনো সময় নিল না। হাতের গিটারটি নিচে ফেলে জাহাজের ছাদ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানিতে পড়ে সে ডুবে যায়, হাত-পা নেড়ে তখন সে উপরে উঠতে থাকে, পায়ে জুতো থাকার জন্যে সাঁতার কাটতে সমস্যা হচ্ছিল, পা দিয়ে ধাক্কা মেরে সে জুতোজোড়া খুলে ফেলল। দুই হাত দিয়ে পানি কেটে সে উপরে উঠতে উঠতে বাচ্চাটিকে খুঁজতে থাকে, কাউকে খুঁজে পায় না। উপরে একবার মাথাটা বের করে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে চারদিকে তাকাল, জাহাজ থেকে অনেকে চিৎকার করছে কিন্তু তার সেগুলো শোনার সময় নেই। সামনে পানিতে একটুখানি আলোড়ন দেখতে পেয়ে সে আবার ডুব দিয়ে এগিয়ে যায়। স্বচ্ছ পানিতে অনেক দূরে দেখা যায়। কিন্তু কোথাও বাচ্চাটির চিহ্ন নেই। রাতুল বুকে সাঁতার কেটে আরও একটু এগিয়ে গেল আর তখন সে বাচ্চাটিকে দেখতে পেল, হাত-পা নাড়তে নাড়তে সে ডুবে যাচ্ছে। রাতুল ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল–বাচ্চাটির এখন বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাকে টেনে সে উপরে নিয়ে যায়, ধাক্কা দিয়ে পানির উপরে তুলে আনে।
রাতুল শুনতে পেল জাহাজ থেকে সবাই চিৎকার করছে তবে এই চিৎকারটি আতঙ্কের নয়, উল্লাসের। রাতুল বাচ্চাটির দিকে তাকাল, সে এখনও বুঝতে পারছে না কী হয়েছে, খক খক করে কাশতে থাকে তারপর বুক ভরে কয়েকটি নিশ্বাস নেয়–তারপর রাতুলকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
রাতুল এখন বাচ্চাটিকে চিনতে পারল, শান্ত নামের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটি। এই মুহূর্তে তার মাঝে দুরন্তপনার কোনো চিহ্ন নেই, আর চোখে-মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক। রাতুল বাচ্চাটিকে ধরে রেখে বলল, “কোনো ভয় নেই শান্ত, কোনো ভয় নেই। আমি আছি, আমি আছি।”
রাতুল শান্তকে এক হাতে ধরে রেখে সাঁতরে জাহাজের দিকে এগোতে থাকে। তখন সে টের পেল জাহাজটির ইঞ্জিন চলছে, প্রপেলার ঘুরছে কিন্তু জাহাজটি এগোচ্ছে না! সেটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো একটি ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি আটকে গেছে।
জাহাজের কাছাকাছি আসার পর অনেকে মিলে প্রথমে শান্তকে তারপর রাতুলকে টেনে তুলল। রাতুল এই প্রথম টের পেল সমুদ্রের পানিটা কনকনে ঠাণ্ডা, সে হি হি করে কাঁপছে। কয়েকজন মিলে শান্তকে ধরে নিয়ে যায়, অন্যরা এগিয়ে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে কথা বলছে, সব কথা সে ভালো করে শুনতে পাচ্ছে।, যেটুকু শুনতে পাচ্ছে তার সবটুকু সে বুঝতে পারছে না। চোখের কোনা দিয়ে সে তৃষাকে খুঁজল, দেখতে পেল না। শামসকে দেখল, তার দামি ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে আসছে। উৎসাহে টগবগ করতে করতে বলল, “আমি তোমার রেসকু অপারেশনের ফ্যান্টাস্টিক কয়েকটি ছবি তুলেছি। তোমাকে কপি দেব। তুমি তোমার কাছে রাখতে পারবে।”
রাতুল কথার উত্তর দিল না, তার এখন ভেজা কাপড়গুলো বদলানো দরকার। সমস্যা হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে এসেছে সঙ্গে পরিষ্কার দূরে থাকুক, যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় নেই।
“জাহাজের ওপর থেকে ডাইভ দিয়েছ–” রাতুল শুনল শামস বলছে, “কত ফিট হবে মনে হয়? তিরিশ ফুট? আমার পারসোনাল রেকর্ড পঁয়ত্রিশ ফুট। আমার ইউনিভার্সিটিতে অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুল আছে সেখানে আমি ডাইভিং প্র্যাকটিস করি।”
রাতুল এবারেও কথা বলল না, সে টের পেতে শুরু করেছে এই মানুষটির কিছু মৌলিক সমস্যা আছে। সে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উপরে উঠতে থাকে। শামসও পিছন পিছন আসে, “তোমার ই-মেইল অ্যাড্রেস দিও, আমি মেল করে দেব। হাই রিজোলিউশন ছবি, বারো মেগা পিক্সেল।”