রাতুল একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “জাহাজের সবাই অপেক্ষা করছে। আপনি গেলে জাহাজ ছেড়ে দেবে। ভাটা শুরু হয়ে গেছে–এই মুহূর্তে রওনা না দিলে আমরা আটকে যাব।”
শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “উঁ।” তারপর তার নোট বইয়ে কয়েকটা শব্দ লিখলেন, দেখে মনে হল না জাহাজ ছাড়া নিয়ে তার কোনো চিন্তা আছে।
রাতুল আবার ডাকল, “স্যার।”
শাহরিয়ার মাজিদ এই প্রথমবার রাতুলের দিকে তাকালেন, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন আমাকে বিরক্ত করছ। তুমি দেখছ না আমি একটা কবিতা লিখছি?”
রাতুল কী বলবে বুঝতে পারল না। একজন মানুষ যে এ রকম হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে না। মরিয়া হয়ে বলল, “আপনি জাহাজে গিয়ে লিখেন–”
শাহরিয়ার মাজিদ চোখ পাকিয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছেলে, আমি তোমার ঔদ্ধত্য দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি কবি শাহরিয়ার মাজিদকে বলছ সে কোথায় কবিতা লিখবে?”
রাতুল দুই হাত তুলে পিছিয়ে গেল, শাহরিয়ার মাজিদ আবার তার নোট বইয়ের ওপর ঝুঁকে একটা শব্দ লিখলেন, তার মুখে একটা সম্ভষ্টির ছাপ পড়ল।
আনসার মানুষটি রাতুলের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল, “কী হচ্ছে?”
রাতুল ইঙ্গিতে জানাল–সে কিছু জানে না।
আনসার মানুষটি তখন রাতুলকে ডেকে এক পাশে নিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “মাথায় গোলমাল আছে?”
রাতুল ফিসফিস করে বলল, “বিখ্যাত কবি। কবিতা লেখার ভাব এসেছে।”
“জাহাজে যাবে না?”
“মনে হয় না।”
“জোর করে ধরে নিয়ে যাই? আমি একদিকে ধরি, আপনি অন্যদিকে ধরেন।”
“মাথা খারাপ? এরা সেলিব্রেটি মানুষ, এদেরকে ঘাটাতে হয় না।”
“কিন্তু—কিন্তু–” আনসার মানুষটি কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল।
রাতুলের সাথে আরও দুজন এসেছে। তারা রাতুলের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এখন কী করি?”
“আমি জানি না। এরা সেলিব্রেটি মানুষ, আমি এর মাঝে দুইজনকে ঘাঁটিয়ে বিপদের মাঝে আছি। তিন নম্বরকে ঘাঁটাতে পারব না।”
“তা হলে?”
“তোমরা গিয়ে বলে দেখো।”
“বলব?”
“আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি এর মাঝে নেই।” বলে রাতুল অন্য একটা ঝাউগাছে হেলান দিয়ে বসে গেল। সামনে বালুবেলা, দূরে সমুদ্র, পরিষ্কার নীল আকাশ। সেখানে কয়েকটা গাঙচিল উড়ছে। এ রকম একটা জায়গায় এসে কবি শাহরিয়ার মাজিদের ভাব এসে যাবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?
ছেলেটি শাহরিয়ার মাজিদকে ওঠার কথা বলে একটা রাম ধমক খেয়ে মুখ কালো করে ফিরে এসে বলল, “চলো ফিরে যাই।”
“ফিরে যাব?” রাতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “না নিয়ে?”
“হ্যাঁ, যেতে না চাইলে তো আর জোর করে নিতে পারি না।”
“তোমাদের কারও কাছে মোবাইল আছে? থাকলে তৃষাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো এখন কী করব? আমার মোবাইলে চার্জ নেই।”
একজনের মোবাইলে নেটওয়ার্কের হালকা একটা চিহ্ন দেখা গেল। কয়েকবার চেষ্টা করার পর তৃষা ফোন ধরল, ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “হ্যালো, কী হয়েছে? পাওয়া যায় নাই?”
“পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার আসতে চাইছেন না।”
তৃষা অবাক হয়ে বলল, “আসতে চাইছেন না মানে?”
“আসতে চাইছেন না মানে আসতে চাইছেন না!”
“কেন?”
“স্যার কবিতা লিখছেন। মনে হয় কবিতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসবেন।”
তৃষা অধৈর্য হয়ে বলল, “তোরা বুঝিয়ে বলিসনি?”
“বলা হয়েছে। রাতুল অনেক চেষ্টা করেছে–”
“রাতুল কোথায়? ফোনটা রাতুলকে দে।”
রাতুল ফোন ধরে বলল, “বল তুষা।”
“তুই টের পাচ্ছিস কী হচ্ছে? আমাদের ছাড়তে দেরি হলে ভেতরে ঢুকতে পারব না। সমুদ্রে আটকা পড়ব।”
“জানি।”
“তা হলে? ওনাকে নিয়ে আসছিস না কেন?”
“আমি চেষ্টা করেছি। লাভ হয় নাই। আমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি যেহেতু ফালতু ভলান্টিয়ার সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।”
“তা হলে?”
“এখন একটা উপায়।”
“কী?”
“জোর করে ধরে আনা। কিন্তু আমাকে লিখিতভাবে ইনস্ট্রাকশন দিতে হবে। পরে আমাকে বলবি ফালতু ভলান্টিয়ার হয়ে তোদের সেলিব্রেটি গেস্টদের অপমান করেছি।”
“বাজে কথা বলিস না।”
রাতুল গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি একটাও বাজে কথা বলছি না।”
“আমি কি শাহরিয়ার মাজিদের সাথে কথা বলতে পারি?”
“যদি উনি রাজি হন। আমি চেষ্টা করতে পারি।” রাতুল টেলিফোনটা নিয়ে শাহরিয়ার মাজিদের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার।”
শাহরিয়ার মাজিদ তার দিকে ঘুরে তাকালেন না। রাতুল আবার ডাকল, “স্যার।”
কোনো উত্তর নেই। রাতুল তখন টেলিফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তৃষা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে।”
শাহরিয়ার মাজিদ টেলিফোনটা হাতে নিয়ে সেটাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে খানিকটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে তার নোট বইয়ে আরও দুটো শব্দ লিখলেন।
এই প্রথম রাতুল পুরো ব্যাপারটার হাস্যকর দিকটা দেখতে পেল, সে টেলিফোনটা তুলে হাসতে হাসতে দূরে আরেকটা ঝাউগাছের নিচে গিয়ে বসল। টেলিফোনে তৃষা বলছে, “হ্যালো হ্যালো।”
রাতুল বলল, “বল।”
“কী হয়েছে?”
রাতুল হাসতে হাসতে বলল, “তোদের সেলিব্রেটি কবি শাহরিয়ার মাজিদ টেলিফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।”
“তুই হাসছিস?”
“কী করব? কাঁদব? এ রকম কমিক দৃশ্য আমি খুব বেশি দেখি নাই।”
.
কবি শাহরিয়ার মাজিদের কারণে জাহাজটা ছাড়তে দুই ঘণ্টা দেরি হল। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজেই সরু চ্যানেলটা দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না। করে সমুদ্র দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। জাহাজে যারা আছে তাদের বেশির ভাগই অবশ্যি বিষয়টা জানতেও পারল না, যারা জানতে পারল তারা সে রকম গুরুত্ব দিল না। সবাই সারাক্ষণ জাহাজের ভেতর আছে, খিদে পেলে খেতে পাচ্ছে, ঘুমানোর সময় ঘুমাতে পারছে। কাজেই জাহাজটি কোন পথে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে রাজি না। ঘণ্টা দুয়েক পর সবাইকে অবশ্যি মাথা ঘামাতে হল এবং সেটা ঘটল খুবই নাটকীয়ভাবে।