রাতুল হতবুদ্ধি হয়ে জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়িগঙ্গার কুচকুচে কালো পানিতে আলোড়ন তৈরি করে দুটি লঞ্চের মাঝখান থেকে জাহাজটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। রাতুল লঞ্চ দুটির দিকে তাকাল, তার হঠাৎ মনে হল, সেগুলোর কোনো একটা থেকে হয়তো এখনও লাফিয়ে জাহাজটাতে ওঠা সম্ভব।
রাতুল চিন্তা করে সময় নষ্ট করল না। ডান পাশের লঞ্চে উঠে সে পেছনের দিকে ছুটতে থাকে। একতলা থেকে লাফ দেওয়া সম্ভব নয়, তাই মানুষজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে দোতলায় উঠে যায়। জাহাজটা এখন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে। লঞ্চ থেকে সেটা অনেকখানি সরে গেছে, শুধু পেছনের অংশটুকু এখনও কাছাকাছি আছে। রাতুল ছুটতে ছুটতে লঞ্চের পেছনে এসে দাঁড়াল। জাহাজটার মাঝামাঝি অংশ তার সামনে, সে যদি ঠিক করে লাফ দিতে পারে তা হলে হয়তো জাহাজটার রেলিংটা ধরে ফেলতে পারবে। যদি না পারে তা হলে–রাতুল মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, এখন চিন্তা করে নষ্ট করার সময় নেই। যদি সে লাফ দিয়ে জাহাজটা ধরতে চায় তা হলে এখনই লাফ দিতে হবে, কোনো ভালো-মন্দ, সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা না করেই।
রাতুল লাফ দিল, অসংখ্য মানুষের চিৎকার শুনতে পেল সে, সেটা সত্যি না কী মনের ভুল বুঝতে পারল না। যে রেলিংটা ধরার কথা সেটা সে ধরতে পারল, হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছিল, নিচে কুচকুচে কালো পানিতে বিপজ্জনক আলোড়ন, এক্ষুনি সে সেখানে ডুবে যাবে, ঠিক তখন তার হাতে কিছু একটা আটকে গেল। রাতুল খপ করে সেটাই ধরে ফেলল। কী ধরেছে সেটা সে জানে
কিন্তু আপাতত সে রক্ষা পেয়েছে, বুক থেকে সে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। শরীরের কোথায় জানি খুব চোট লেগেছে জায়গাটা সে ধরতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে মাথা না ঘামালেও চলবে। যে রেলিংটা তার ধরার কথা ছিল রাতুল হাত বাড়িয়ে সেটা ধরল এবং নিজেকে টেনে খানিকটা ওপরে তুলে আনল। জাহাজটার গতি অনেক বেড়ে গিয়েছে, বাড়ক, তার কোনো সমস্যা নেই–সে এখনও রেলিং ধরে ঝুলে আছে সত্যি কিন্তু সে আর পড়ে যাবে না।
রাতুল প্রথমবার লক্ষ করল রেলিংয়ের অন্য পাশে অনেকগুলো বাচ্চা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুল বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা খুব কাজ করল বলে মনে হল না, বাচ্চাগুলো হাসির উত্তর না দিয়ে এখনও ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতুল এবার সাবধানে রেলিংয়ের ওপর নিজেকে টেনে তুলে জাহাজের শক্ত মেঝেতে পা দিয়ে বুকের ভেতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়।
আট-দশ বছরের একটা ছেলে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্পাইডারম্যান।”
অন্য সবাই তখন মাথা নাড়ল, বলল, “স্পাইডারম্যান।”
ছোট একটা মেয়ে বলল, “স্পাইডারম্যান, তোমার হাত কেটে গেছে।”
রাতুল দেখল তার কনুইয়ের কাছে সত্যি সত্যি বেশ খানিকটা জায়গা থেকে ছাল উঠে গিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। সে হাত দিয়ে রক্তটা মোছার চেষ্টা করে বলল, “স্পাইডার রাড।”
বাচ্চাদের মুখে এবার হাসি ফুটে ওঠে, তারা মাথা নেড়ে বলল, “স্পাইডার ব্লাড। স্পাইডার ব্লাড।”
“উঁহু স্পাইডার ব্লাড না।” গলার স্বর শুনে রাতুল পিছন ফিরে তাকাল, কখন সেখানে তৃষা এসে দাঁড়িয়েছে সে জানে না। কটকটে কমলা রঙের একটা টি-শার্ট, মাথায় নীল রঙের বেসবল ক্যাপ, হাতে একটা ফাইল এবং মুখে কামড়ে ধরা একটা বলপয়েন্ট কলম। তৃষা বলপয়েন্ট কলমটা মুখ থেকে সরিয়ে কানের ওপর খুঁজে নিয়ে বলল, “স্পাইডার ব্লাড লাল রঙের হয় না, স্পাইডার ব্লাড হয় সাদা।”
রাতুল হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তৃষা!”
তৃষা মুখ শক্ত করে বলল, “তোর এখানে আসার কথা ছিল সকাল আটটায়। যখন সবাই জাহাজে উঠতে থাকে তখন। তখন ভলান্টিয়ারদের দরকার হয়। তুই একজন ভলান্টিয়ার–”
“আসলে হয়েছে কী–”
“সকাল সাতটা থেকে আমি তোকে ফোন করছি। তোর ফোন বন্ধ”আসলে, ইয়ে মানে ফোনের চার্জ-”
“আসার কথা আটটার সময়, আর তুই এসেছিস দশটার সময়।” রাতুল দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, “এখনও দশটা বাজেনি।”
তৃষা রাতুলের কথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “শুধু যে দশটার সময় এসেছিস তা নয়, এসে একটা মহা কেরানি দেখালি। এক জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে অন্য জাহাজে উঠে গেলি–আমাদের রিয়েল লাইফ স্পাইডারম্যান।”
“আসলে ঠিক তখন জাহাজটা ছেড়ে দিল–”
“জাহাজ তো ছেড়ে দিবেই। জাহাজ তোর জন্যে বসে থাকবে না। আর যদি জাহাজ ছেড়ে দেয় তা হলে তোর উচিত ছিল জেটিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের গুডবাই বলা। তোর স্পাইডারম্যান হয়ে এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে লাফ দেবার কথা না। যদি কিছু একটা হত? যদি পানিতে পড়ে যেতি”
“আমি খুব ভালো সাঁতার জানি। বুড়িগঙ্গার পানিতে এত পলিউশান যে, সাঁতার না জানলেও ভেসে থাকার কথা।”
“ফাজলেমি করবি না। সাঁতার জানা না জানার কথা হচ্ছে না। কাছাকাছি এতগুলো লঞ্চ, জাহাজ–তাদের প্রপেলার ঘুরছে। পানির টানে যদি প্রপেলারে ঢুকে যাস তা হলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবি। মানুষ বোকা না হলে এরকম রিস্ক নেয়?”
রাতুল হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি তো কখনও দাবি করিনি আমি বুদ্ধিমান।”
“তাই বলে এত বোকা–”
“আসলে, আসলে–”
“আসলে কী?”