বাচ্চাদের কয়েকজন হঠাৎ করে রাতুলকে দেখতে পেল এবং সমস্বরে চিৎকার করে তার দিকে ছুটে তাকে নাচের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টানাটানি। করতে থাকে।
রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমি নাচতে পারি না।”
মৌটুসি হাসতে হাসতে বলল, “আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব ভাইয়া। খুব সোজা।”
“তুমি শিখালেও আমি পারব না মৌটুসি। তা ছাড়া আমি সাউন্ড সিস্টেম থেকে চলে গেলে এটা চালাবে কে?”
বাচ্চারা যুক্তিতর্কের ধারেকাছে গেল না, বলল, “কিছু হবে না। তুমি চলো।”
রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু, আমি যাব না।”
“কেন যাবে না?”
“আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। বুঝেছ?”
“ও।” মৌটুসি কিছুক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নাচের আসরে শামস আর তৃষার দিকে তাকাল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে চলে গেল।
রাতুল একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। একটু পরে সে আবিষ্কার করে তাকিয়ে থেকেও সে কিছু দেখছে না। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকেও যে সেটি না দেখা সম্ভব সেটা সে আগে কখনো লক্ষ করেনি।
৩. ট্রলারটা জাহাজের পাশে
ট্রলারটা জাহাজের পাশে এসে থামল, তখন একজন একজন করে সবাই জাহাজে উঠতে থাকে। আলমগীর ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “সবাই এসেছে?”
তৃষা বলল, “হ্যাঁ এসেছে। এটা লাস্ট ট্রিপ।”
ভোরবেলা সমুদ্রের মোহনায় জাহাজটা নোঙর করেছে। তখন ট্রলারে করে সবাইকে কাছাকাছি একটা দ্বীপে নামানো হয়েছে। এখানে চমৎকার একটা বালুবেলা আছে, বালুবেলার পাশে গহিন জঙ্গল। সবাই সেখানে সময় কাটিয়ে জাহাজে ফিরে এসেছে, সবাইকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাড়াহুড়া ছিল। কারণ একটু পরেই ভাটা শুরু হবে। তারা যে পথ দিয়ে ফিরে যাবে সেটা সরু একটা চ্যানেল, ভাটার সময় সেখানে পানি কমতে থাকে। পানি বেশি কমে গেলে সেই পথ দিয়ে যাওয়া যায় না। যারা জাহাজে আছে তারা সবাই আবিষ্কার করেছে, নদী আর সমুদ্র যেখানে একে অন্যের সাথে মিলে একাকার হয়ে যায় সেখানে সবাইকে প্রতি মুহূর্তে এই জোয়ার-ভাটা নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। এখানকার মানুষের জীবন জোয়ার আর ভাটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলে।
জাহাজের একজন মানুষ জিজ্ঞেস করল, “জাহাজটা তা হলে ছেড়ে দিই।”
আলমগীর ভাই মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ ছেড়ে দেন।”
তৃষা বলল, “এক সেকেন্ড। শেষবারের মতো নিশ্চিত হয়ে নিই, সবাই এসেছে কি না। কাউকে এই দ্বীপে ফেলে এলে সেটা ভালো হবে না।”
সে এদিক-সেদিক তাকায়, রাতুল কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, তৃষা জিজ্ঞেস করল, “সব বাচ্চারা এসেছে?”
“এসেছে।”
“বড়রা?”
“জানি না, আমি খেয়াল করিনি। একটু খেয়াল করে সবাই সবাইকে দেখে নিলেই হয়।”
কাজেই সবাই সবাইকে দেখতে শুরু করল। হঠাৎ নাট্যকার বাতিউল্লাহ বললেন, “শাহরিয়ার মাজিদকে দেখছি না। তার কেবিনে আছেন?”
দেখা গেল কেবিনে নেই। কোনো বাথরুমে নেই। জাহাজের ছাদেও নেই। বাতিউল্লাহ বললেন, “শাহরিয়ার মাজিদ দ্বীপে গিয়েই কেমন যেন উড়া উড়া হয়ে গেল। আমাকে বলল, আমি এখানেই বসত করব।”
“এখানে বসত করবেন মানে?”
“কবি মানুষ, কখন মাথায় কী আসে কে বলবে?”
খানিকক্ষণ খোজাখুঁজি করে সবার সাথে কথা বলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হল, জাহাজ থেকে দ্বীপে যাওয়ার সময় অনেকেই তাকে দেখেছে। আসার সময় কেউ দেখেনি। যার অর্থ, কবি শাহরিয়ার মাজিদ দ্বীপটাতে রয়ে গেছেন–কে জানে হয়তো বসত করে ফেলেছেন।
তৃষা বলল, “গিয়ে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে। কে যাবি?”
রাতুল বলল, “ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।”
রাতুলের সাথে একজন আনসার এবং আরও কয়েকজন দ্বীপটিতে শাহরিয়ার মাজিদকে খুঁজতে রাজি হয়ে গেল। তাকে শেষবার দ্বীপের কোন অংশে দেখা গেছে সেটা শুনে তারা ট্রলারে উঠে বসে। জাহাজের মানুষজন খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “আমাদের কিন্তু খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি যদি রওনা না দিই, পৌঁছাতে পারব না। তখন সমুদ্র ঘুরে যেতে হবে।”
আলমগীর ভাই বললেন, “কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নাই। একজন মানুষকে তো ফেলে রেখে যেতে পারি না।”
“আপনি বুঝতে পারছেন, পুরা ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে।”
“কেন, বিপজ্জনক কেন?”
“সমুদ্রে ডুবোচর থাকে। যদি আটকে যাই তা হলে মহাবিপদ। এমনিতেও জায়গা ভালো না–”
“ভালো না মানে?”
“বলতে চাচ্ছিলাম না। খামোখা ভয় পাবেন। সুন্দরবনে ডাকাতের উৎপাত থাকে।”
“ডাকাত?”
“জে।”
আলমগীর ভাই দুশ্চিন্তিত মুখে গাল চুলকালেন।
তৃষা বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। রাতুল গিয়েছে তো, সে খুঁজে বের করে নিয়ে আসবে।”
.
রাতুল খুব সহজেই শাহরিয়ার মাজিদকে খুঁজে বের করে ফেলল। সমুদ্রের তীরে একটা ঝাউগাছের নিচে একটা নোট বই আর একটা বল পয়েন্ট কলম নিয়ে বসে আছেন। তারা সবাই মিলে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে। কিন্তু এই মানুষটি এত কাছে বসে থেকেও না শোনার ভান করে বসে আছে। রাতুল শাহরিয়ার মাজিদের কাছে গিয়ে তাকে ডাকল, “স্যার।”
শাহরিয়ার মাজিদ তার দিকে না তাকিয়ে বললেন, “উঁ।”
“আমরা আপনাকে খুঁজছি। আপনাকে ডাকছিলাম, আপনি শোনেননি?”
“শুনব না কেন? শুনেছি।”
“তা হলে উত্তর দিলেন না কেন? সবাই ভাবছে কিছু না কিছু হয়ে গেছে।”
শাহরিয়ার মাজিদ তার কথার উত্তর না দিয়ে বল পয়েন্ট কলমটার গোড়া কামড়াতে কামড়াতে নোট বইয়ের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।