দূর থেকে রাতুল আর মৌটুসি লক্ষ করল দলটির একটা বড় অংশ বাঘের পায়ের ছাপটি না দেখেই সামনে এগিয়ে গেল, তখন হঠাৎ এটি একজনের চোখে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে সবাই বাঘের পায়ের ছাপকে ঘিরে দাঁড়াল। রাতুল আর মৌটুসি দেখল, আনসারটি তার ঘাড় থেকে রাইফেল হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।
মাঝবয়সী আনসারটিও তখন এগিয়ে যায়, রাতুল আর মৌটুসিও তার সাথে সাথে সামনে হাঁটতে থাকে। রাতুল মৌটুসির হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার মৌটুসি, হাসবে না কিন্তু।”
“না, হাসব না।” বলে মৌটুসি একবার ফিক করে হেসে ফেলল।
বাঘের পায়ের ছাপের কাছে গিয়ে রাতুল আবিষ্কার করল, সবাই মিলে বাঘের পায়ের ছাপের ছবি নিচ্ছে। শামস তৃষাকে বসিয়ে তার ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে বলল, “তৃষা, তুমি মুখটা আরেকটু গম্ভীর করো। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন হবে খানিকটা কৌতূহল, খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকটুকু আতঙ্ক।”
তৃষা তার মুখে কৌতূহল, বিস্ময় আর আতঙ্কের একটা মিশ্রণ তৈরি করার চেষ্টা করল, সেটা হল অনেকটা অতি নাটকীয় এবং শামস তার দামি ক্যামেরায় ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে তৃষার অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলল।
বয়স্ক আনসারটা বাঘের পায়ের ছাপটা দেখে মাথা চুলকে বলল, “খুবই আজিব।”
আলমগীর ভাই বললেন, “কী আজিব?”
“এই যে বাঘের পায়ের ছাপ।”
শামস জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বাঘের পায়ের ছাপে?”
“আমি ধরেন অনেক বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি। কিন্তু এ রকম পায়ের ছাপ কখনো দেখি নাই।”
“কেন?”
“এইখানে যে রকম মাটি সেইখানে এই রকম একটা পায়ের ছাপের জন্যে বাঘের সাইজটা হওয়া দরকার হাতির মতোন। এই মাটিতে এত গভীর ছাপ পড়ার কথা না।”
শামস গম্ভীর হয়ে বলল, “পড়ার কথা না বলে তো লাভ নেই–আপনি নিজের চোখে দেখেছেন পড়েছে। হয়তো বাঘটা আসলেই বিশাল ছিল।”
“শুধু যে সাইজ বড় হওয়ার কথা তা না”, আনসারটা আবার মাথা চুলকালো। ”বাঘের ধরেন চার পা, সে চার পা দিয়ে হাঁটে। এইখানে খালি দুই পায়ের ছাপ। মনে হচ্ছে—”
“কী মনে হচ্ছে?”
“এই বাঘ দুই পা দিয়ে মানুষের মতো হেঁটে গেছে।” কথা শেষ করে সে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না। শুধু শামস কাঁধ
ঝাঁকিয়ে বলল, “যত্তোসব রাবিশ!”
রাতুল আর মৌটুসি একজনের দিকে আরেকজন তাকিয়ে গোপনে মুখ টিপে হাসল।
আলমগীর ভাই বললেন, “এখন মুখ থেকে খুব হাসি বের হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বের হয়ে আসত তা হলে দেখতাম মুখে কত হাসি বের হয়।”
তৃষা রাতুলকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে বিচে দেখলাম না।”
“না, আমি যাইনি। আমি আর মৌটুসি এখানে ছিলাম।”
“তোমরা কিছু দেখেছ না কি?”
“নাহ্। শুধু দেখলাম হঠাৎ অনেকগুলো হরিণ ছুটে গেল।” রাতুল মুখ গম্ভীর করে বলল, “তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি, বাঘটা তখন মনে হয় হরিণগুলোকে তাড়া করেছিল।”
মৌটুসি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, তাড়া করেছিল।
তৃষা দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, “তা হলে বাঘটা হয়তো আশেপাশে আছে, আমাদের তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরে যাওয়া দরকার।”
“হ্যাঁ।” আলমগীর ভাই বললেন, “চলো, জাহাজে চলো সবাই।”
সবাই যখন হাঁটতে শুরু করে তখন শামস তৃষাকে বলল, “তৃষা, তুমি এখানে দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলি।”
তৃষা দাঁড়াল, তার মুখে একটা ব্ৰিত ভাব। শামস কয়েকটা ছবি তুলে ক্যামেরাটা রাতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দেবে?”
রাতুল কোনো কথা না বলে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তৃষা আর শামসের দিকে তাকাল। ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি দুজনের হাসিমুখ দেখে তার বুকের ভেতর কেমন যেন জ্বলে-পুড়ে যেতে থাকে। সে নিঃশব্দে তাদের অনেকগুলো ছবি তুলে দিল।
.
রাতে খাওয়ার পর নিচতলায় বাচ্চাদের জন্যে রাতুল ডিসকো নাচের ব্যবস্থা করল। তাদেরকে কথা দিয়েছিল কথা না রেখে উপায় নেই। সারাদিন ধুমধাড়াক্কা ধরনের যে কয়টা গান সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো ল্যাপটপ থেকে বাজানোর ব্যবস্থা করা হল। সাউন্ড সিস্টেমের খুঁটিনাটি ঠিক করে রাতুল গানগুলো বাজাতে থাকে। স্পিকারে বিকট সুরে সেই গান বাজতে থাকে এবং বাচ্চাগুলো সেই গানের সাথে নাচানাচি শুরু করে দেয়। প্রথমে তাদের একটু একটু লজ্জা লাগছিল, তখন রাজা এসে অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে। তার বিচিত্র নাচ দেখে অনেকেরই লজ্জা ভেঙে যায় এবং তখন সবাই একসাথে লাফালাফি শুরু করে দেয়।
গানের বিকট সুরই হোক আর বাচ্চাদের আনন্দোল্লাসই হোক, জাহাজের অনেকেই নিচে নেমে তাদের দেখতে থাকে। প্রথমে মৌটুসি তার মা-বাবাকে টেনে নাচের আসরে নামিয়ে দেয়। তারা নাচের ভঙ্গি করে একটু নড়াচড়া করলেন। তখন বাচ্চারা একে একে সবাইকে টেনে আনতে লাগল। কেউ কেউ বেশ আগ্রহ নিয়ে নাচার চেষ্টা করল কেউ কেউ একটু হাত-পা নাড়িয়ে সরে গেল। রাতুল সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজাতে বাজাতে লক্ষ করল, বাচ্চারা শামস এবং শারমিনকেও ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছে। শারমিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে একসময় সরে গেল, শামস আর গেল না, বেশ দক্ষ নৃত্যশিল্পীর মতো নাচতে থাকে। রাতুল লক্ষ করল, শামস নাচতে নাচতে তৃষাকে ডাকছে এবং বাচ্চারা প্রচণ্ড উৎসাহে তৃষাকে টেনে নিয়ে এসেছে। শামস তৃষার হাত ধরল এবং দুজন বেশ সহজভাবে নাচতে লাগল।