.
রাতুল সবাইকে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যায়, বনের গাছগাছালির ভেতর দিয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর হঠাৎ তারা একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হয়। বিশাল একটা মাঠ, দেখে মনে হয় তেপান্তরে চলে এসেছে। বহুদূরে গাছগাছালির সবুজ রেখা, মাঝখানে সবুজ আর শুকনো ঘাসের উঁচু-নিচু প্রান্তর। মাঝে মাঝে ছোট বড় একটি-দুটি গাছ নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝামাঝি পাতাবিহীন একটা শুকনো গাছ সম্ভবত বাজ পড়ে পুড়ে গেছে।
রাইফেল হাতে মাঝবয়সী আনসারটি একটা ঢিবির উপর বসে সিগারেট টানতে থাকে। একটা মেঠোপথ বনভূমির দিকে এগিয়ে গেছে, কমবয়সী আনসারটি সেই দিকে এগিয়ে যায়। তার পিছু পিছু উৎসাহী মানুষজন হাঁটতে থাকে।
রাতুল ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অবসন্ন অনুভব করে। সে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে রইল। নিজের অজান্তেই সে তৃষাকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে খুঁজে পেল না। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খেলছে। সে অন্যমনস্কভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মৌটুসি এসে জিজ্ঞেস করল, “স্পাইডার ভাইয়া, সবাই বিচের দিকে যাচ্ছে, তুমি যাবে না?”
“নাহ্।”
“তা হলে আমিও যাব না।”
“কেন, তুমি যাবে না কেন? যাও।”
“যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“ঠিক আছে তা হলে। বসো।”
মৌটুসি রাতুলের কাছে বসে একটা ছোট কাঠি দিয়ে মাটি খোঁচাতে থাকে। একটু পর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া–”
“বলো।”
“তোমার কী মন খারাপ?”
“না না, মন খারাপ না, মন খারাপ কেন হবে–” বলতে গিয়ে রাতুল থেমে গেল। সে মৌটুসির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “হ্যাঁ মৌটুসি, আমার একটু মন খারাপ।”
মৌটুসি বড় মানুষের মতো বলল, “আমি বুঝতে পারছিলাম। তোমার কেন মন খারাপ ভাইয়া?”
রাতুল বলল, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে এ রকম হয়। হঠাৎ করে একদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখি কেন জানি মন খারাপ। কোনো কারণ নাই, তবু মন খারাপ।”
মৌটুসি বলল, “আমারও মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। যখন আব্বু আমাকে বকা দেয় তখন আমার মন খারাপ হয়। যখন আম্মু আর আব্বু ঝগড়া করে তখন আমার মন খারাপ হয়। যখন স্কুলে আমার বন্ধুরা আমাকে খেলতে নেয় না তখন আমার মন খারাপ হয়।”
“মন খারাপ হলে তুমি কী করো?”
“কিছু করি না। মাঝে মধ্যে একটু কাঁদি। তারপর যখন আম্মু আমাকে আদর করে না হয় আম্মু-আব্বু আর ঝগড়া করে না, আর বন্ধুরা যখন খেলতে নেয় তখন আবার মন ভালো হয়ে যায়।” মৌটুসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি চিন্তা করো না স্পাইডার ভাইয়া, দেখবে আবার তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”
রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ কোনো কারণ ছাড়া যখন মন খারাপ হয় তখন আবার কোনো কারণ ছাড়াই মন ভালো হয়ে যায়।”
কথাটা মৌটুসির খুব পছন্দ হল। সে অনেকক্ষণ হি হি করে হাসল। রাতুল এক ধরনের হিংসার চোখে এই বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে–কত সহজে এরা কত আনন্দ পেয়ে যায়।
ঠিক তখন তাদের সামনে দিয়ে অনেকগুলো হরিণ ছুটে যেতে শুরু করে।
দেখে মৌটুসি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, “হরিণ! হরিণ!”
“হ্যাঁ, হরিণ!”
“কী সুন্দর হরিণ!”
রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হরিণ খুব সুন্দর। যখন দৌড়ায় তখন আরও সুন্দর দেখায়।”
“হরিণগুলো কেন দৌড়াচ্ছে স্পাইডার ভাইয়া?”
“আমাদের দেখে মনে হয় ভয় পেয়েছে।”
“আমরা তো কিছু করি নাই। করেছি?”
“না। কিছু করি নাই। কিন্তু বনের পশু তো–তাই মানুষ থেকে দূরে থাকে।”
মৌটুসি হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, “মনে হয় একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধাওয়া করেছে।”
রাতুল হাসল, বলল, “হতে পারে।”
মৌটুসি আঙুলে গুনে গুনে বলল, “আমরা কুমির দেখেছি, বানর দেখেছি, অনেক রকম পাখি দেখেছি, গুইসাপ দেখেছি, শুশুক দেখেছি, হরিণ দেখেছি। কিন্তু এখনও কোনো বাঘ দেখিনি।”
“বাঘ দেখা সোজা না। তারা তোমার সামনে আসবে না।” রাতুল দূরে রাইফেল হাতে বসে থাকা আনসারটিকে দেখিয়ে বলল, “দেখছ না, সবসময় একজন মানুষ রাইফেল নিয়ে বসে আছে। বাঘ তো বোকা না!”
“সুন্দরবন এসে বাঘ না দেখে চলে যাব?”
“মনে হয় না দেখেই যেতে হবে। রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “খুব বেশি হলে তুমি বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পারো।”
“পায়ের ছাপ? কোথায়?”
“যেখানে বাঘ পানি খেতে আসে সেখানে।” হঠাৎ রাতুলের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে।
মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে স্পাইডার ভাইয়া?”
“চলো আমরা একটা কাজ করি।”
“কী কাজ?”
“এখানে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করে রাখি। সবাই যখন আসবে তারা বাঘের পায়ের ছাপ দেখে হইচই শুরু করে দেবে। ভাববে সত্যি বাঘ এসেছে!”
মৌটুসির মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল, “তুমি বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করতে পারবে? কেমন হয় বাঘের পায়ের ছাপ?”
“সেটা তো জানি না। কিন্তু কেউই তো জানে না! তাই আমরা যেটা তৈরি করব সেটাই হবে বাঘের পায়ের ছাপ।”
রাতুল তখন মৌটুসিকে নিয়ে একটু সরে গেল। সবাই যে পথ দিয়ে আসছে সেখানে খুঁজে খুঁজে খানিকটা নরম মাটি বের করল। তারপর সেখানে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করতে বসে গেল। রাতুল বাঘের পায়ের ছাপ দেখেনি। কিন্তু ধরেই নিল সেটা হবে বিড়ালের থাবার মতো। তবে তার থেকে অনেক বড়। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টার পর যেটা তৈরি হল সেটা দেখতে খারাপ হল না। যারা চেনে না তাদের কাছে বাঘের পায়ের ছাপ হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যাবে। শুধু একটা ছাপ হলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কাজেই আরও কয়েকটা পায়ের ছাপ তৈরি হল, দেখে যেন মনে হয় বাঘটা এই পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। তাদের কাজ যখন শেষের দিকে তখন রাতুল আর মৌটুসি দেখতে পেল তাদের দলটি ফিরে আসছে। তারা দুজন সেখান থেকে সরে গিয়ে আগের জায়গায় বসে গেল। এত কষ্ট করে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করেছে, এখন কেউ যদি লক্ষ না করে সেটা হবে রীতিমতো হৃদয়বিদারক!