রাতুল আবার রাজার দিকে তাকাল, ছেলেটির মুখে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক।
ঠিক এই সময় শারমিনের মা ভিড় ঠেলে এসে ঢুকলেন, “কী হয়েছে?”
“দেখো আম্মু, এই হারামজাদা আমার ব্ল্যাকবেরি” শারমিন কথা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেল। সবাই দেখতে পেল শারমিনের মায়ের হাতে একটা দামি মোবাইল ফোন, এটাই নিশ্চয়ই সেই বিখ্যাত ব্ল্যাকবেরি। শারমিনের মা কিছু একটা অনুমান করে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুই ঘুমাচ্ছিলি তাই তোকে ডাকিনি। গাছে একটা বানরের বাচ্চার ছবি তোলার জন্যে তোর ব্ল্যাকবেরিটা নিয়েছি।”
শারমিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তার মায়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। রাতুলের মাথায় হঠাৎ করে রক্ত উঠে যায়, সে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “এইটা আপনার সেই ব্ল্যাকবেরি?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে এটা আসলে রাজা চুরি করেনি, আপনার মা নিয়ে গিয়েছিলেন?”
শারমিন কোনো কথা বলল না। রাতুল সরু চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আপনি ধরেই নিলেন রাজা চুরি করেছে? রাজার গায়ে হাত তুললেন?”
শারমিন এবারেও কোনো কথা বলল না। রাতুল শীতল গলায় বলল, “আপনি কী এখন এই ছেলেটির কাছে মাফ চাইবেন?”
শারমিনের মুখ লাল হয়ে ওঠে, “আপনার কত বড় সাহস আমাকে এর কাছে মাফ চাইতে বলেন? এই ছেলে এখন চুরি করে নাই তো কী হয়েছে? এর পরে যখন সুযোগ পাবে তখন চুরি করবে।”
রাতুল কিছু একটা বলতে চাইছিল, তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে শারমিন ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কেবিনের সামনে জটলাটা তখন ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে শুরু করে।
রাজা চোখ মুছে রাতুলকে বলল, “দেখলেন তো ভাই আমি চুরি করি নাই।”
“হ্যাঁ দেখেছি।” রাতুল গম্ভীর গলায় বলল, “আর তুমি দেখেছ তো এই জাহাজে কোনো কিছু হারিয়ে গেলে, চুরি হলেই তোমাকে ধরবে?”
“জে। দেখেছি।”
“কাজেই খুব সাবধান। কেউ যেন তোমাকে কিছু বলতে না পারে।”
“জে ভাই। কেউ কিছু বলতে পারবে না।”
কিছুক্ষণের মাঝেই আবার বাচ্চাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়, তাদের মাঝে রাজাও আছে, তাকে দেখে মনেই হয় না কোনো কিছু ঘটেছে। কত সহজে কত বড় একটা ঘটনা ভুলে যেতে পারে!
.
ট্রলারে করে দুইজন আনসার জাহাজে ওঠার পর জাহাজটা আবার ছেড়ে দিল। আনসার দুইজনের কাছে দুটো থ্রি নট থ্রি রাইফেল, মানুষ দুজন সাদাসিধে গোবেচারা ধরনের–কখনও দরকার হলে এই রাইফেল দিয়ে গুলি করতে পারবে বলে মনে হয় না। একজন একটু বয়স্ক, অন্যজন কম বয়সী। তবে দুজনই স্থানীয় বলে সুন্দরবনের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানে। রাতুল তাদের সাথে কথা বলে নদীর নাম, গাছের নাম, পাখির নাম থেকে শুরু করে রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা কোথায় থাকে, কী করে, কী খায় এগুলোও জেনে নিল। বাঘকে এখানকার মানুষেরা যে মামা বলে ডাকে সেটাও সে এই দুইজন আনসারের কাছে জানতে পারল।
বড় একটা নদী থেকে তাদের জাহাজটা ছোট একটা নদীতে ঢুকে গেল। দুইপাশে ঘন জঙ্গল, গাছগাছালিতে ভরা। ভাটা শুরু হয়েছে। তাই নদীর পানি কমে কাদা দিয়ে ঢাকা নদীর তীর ভেসে উঠছে। সেখানে নানা ধরনের গাছের শাসমূল সুঁচালো ছুরির মতো বের হয়ে আসছে। রাতুল জাহাজের ছাদে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। জন্মের পর থেকে সে সুন্দরবনের কথা শুনে আসছে। কিন্তু সেই বনভূমি যে এত বিচিত্র কখনও কল্পনা করেনি। একা একা এত সুন্দর আর এত গহিন জঙ্গলটা দেখতে মন চাইছিল না। তাই সে তৃষাকে খুঁজতে বের হল। নিচতলায় তার সাথে দেখা হল। চা বানানোর জন্যে গরম পানির ফ্লাস্ক থেকে সে প্লাস্টিকের কাপে পানি ঢালছে, রাতুলকে দেখে তৃষা গম্ভীর হয়ে বলল, “এখন কার সাথে ঝগড়া করে এসেছিস?”
“ঝগড়া? ঝগড়া করব কেন?”
“তাই তো দেখছি।”
“কখন আমাকে ঝগড়া করতে দেখলি?”
“প্রথমে ঝগড়া করলি শামস ভাইয়ের সাথে, তারপর ঝগড়া করলি শারমিনের সাথে।”
“আমি ঝগড়া করেছি?” রাতুল অবাক হয়ে বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। তুই ভুলে যাচ্ছিস, এরা আমাদের ইনভাইটেড গেস্ট। এরা সেলিব্রেটি, এরা আমাদের সাথে আছে বলে আমরা আমাদের ফেস্টিভ্যালগুলো করতে পারি।”
“তার মানে তুই বলছিস তোর ওই শামস ভাইয়ের কোনো কথা পছন্দ না হলে আমি সেটা বলতে পারব না? শারমিন একটা বাচ্চা ছেলেকে মিথ্যা দোষ দিয়ে চড় মেরে দেবে আর আমাকে সেটা দেখতে হবে?”
“না তোকে দেখতে হবে না। কিন্তু তার মানে না তুই তাকে পাল্টা অপমান করবি। এরা দেশের সেলিব্রেটি। তুই সেলিব্রেটি না। তুই একজন ফালতু ভলান্টিয়ার।”
“ফালতু ভলান্টিয়ার?” রাতুল প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “তুই আমাকে ফালতু ভলান্টিয়ার বলতে পারলি?”
তৃষা গরম হয়ে বলল, “কেন পারব না? তুই ভুলে যাচ্ছিস যে, তুই এই অরগানাইজেশনের কেউ না। আমি তোর কথা বলেছি আর আমার কথাকে বিশ্বাস। করে তোকে এখানে আসতে দেওয়া হয়েছে। আর তুই এসে বড় বড় বোলচাল শুরু করেছিস, আর ধাক্কাটা সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। বুঝেছিস?”
অপমানে রাতুলের কান লাল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বুঝেছি।”
“মাত্রাজ্ঞান খুব ইম্পর্ট্যান্ট। ঠিক কখন থামতে হয় সেটা জানতে হয়, সেটা না জানলে খুব মুশকিল। তোর কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই, কার সাথে কী রকম ব্যবহার করতে হয় তুই জানিস না। বুঝেছিস?”