।রাতুল অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না শুধু ভুরু কুঁচকে শামসের দিকে তাকিয়ে রইল।
শামস বলল, “আমি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি। তারা খারাপ না।”
রাতুলের আবার মেজাজ খারাপ হল। খারাপ না কথাটার মাঝে এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে, কথাটা খুব সুন্দর হত যদি শামস বলত, “আমি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি। তারা চমৎকার–” কিন্তু শামস সেটা বলছে না। রাতুল শুনল, শামস বলছে, “আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের বিষয়বস্তু মোটামুটি জানে কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এরেনাতে তারা ভালো করে না–তার কারণ তারা টিমিড, তারা যথেষ্ট পরিমাণ এগ্রেসিভ না, তারা আউটম্পোকেন না।”
রাতুলের যেরকম মেজাজ গরম হচ্ছে অন্যদের মোটেও সেরকম মেজাজ গরম হচ্ছে না, তারা শামসের কথার সাথে সাথে মাথা নাড়ছে। রাতুল চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করল তুষার চোখে এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময়, আর সেটা দেখে সে নিজের ভিতরে কেমন জানি এক ধরনের জ্বালা অনুভব করে।
শামস বলল, “গ্লোবালাইজেশনের কারণে এখন তোমাদের সবার সাথে কমপিট করতে হবে। টেকনোলজি পৃথিবীটাকে ছোট করে ফেলেছে। এখন তোমরা শুধু নিজেদের সাথে কমপিট কর না, তোমরা সারা পৃথিবীর সাথে কমপিট কর। অন্যেরা ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে, তোমরা কিন্তু পিছিয়ে পড়ছ।”
একজন গদগদ গলায় বলল, “আমাদের কী করা উচিত শামস ভাই?”
“কী করতে হবে সেটা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আমাদেরকে গ্লোবাল সিটিজেন হতে হবে, গ্লোবালি সবার সাথে ফাইট করতে হবে। আমাদের কমপিট করতে হবে। সেটা করার জন্যে আমাদের প্রতিযোগিতা করা শিখতে হবে–সব ফিল্ডে কম্পিটিশানের আয়োজন করতে হবে–”
রাতুল বলল, “আমি আপনার সাথে একমত নই।”
সবাই চমকে উঠল আর শামসকে দেখে মনে হল কেউ তার নাকে একটা ঘুষি মেরেছে। সরু চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী বললে?”
“আমি বলেছি আমি আপনার সাথে একমত নই।”
শামসের ফর্সা মুখটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠল। সে চিন্তাও করতে পারেনি কেউ তার কথার বিরোধিতা করতে পারে। জিজ্ঞেস করল, “কোন বিষয়টাতে একমত না?”
“কম্পিটিশানের ব্যাপারে। আমি কম্পিটিশানের বিরুদ্ধে।”
“কম্পিটিশানের বিরুদ্ধে?”
“হ্যাঁ, সত্যিকার জীবনে আমরা একের সাথে অন্যে কম্পিটিশান করি না, আমরা সবাই মিলে কাজ করি, কো-অপারেশান করি। প্রতিযোগিতা দিয়ে পৃথিবীর কোনো বড় কাজ হয় নাই, সব বড় কাজ হয়েছে সবার সহযোগিতা দিয়ে, তা হলে আমি কেন সবাইকে প্রতিযোগিতা করতে শেখাব? কেন একে অন্যকে কনুই দিয়ে ঠেলে এগিয়ে যাবে?”
রাতুলের কথাটা এত চাঁচাছোলা আর এতো তীক্ষ্ণ যে শামস থতমত খেয়ে গেল, চট করে উত্তর দেবার মতো কিছু খুঁজে পেল না। সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করছিল কিন্তু তার কপাল ভালো ঠিক তখন জাহাজের বাচ্চাগুলো ছুটতে ছুটতে তাদের কাছে এল। একজনের হাতে একটা কাগজ সেটা সবাই মিলে দেখছে। তারা সবার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তারপর ছুটতে ছুটতে চলে যেতে শুরু করে। তৃষা ডেকে জিজ্ঞেস করল, বলল, “কী দেখছিস?”
মৌটুসি বলল, “তোমাদের কারো জোড়া ভুরু আছে কি না।”
“জোড়া ভুরু?”
“হ্যাঁ।”
“জোড়া ভুরু থাকলে কী হবে?”
“আমাদের গুপ্তধনের পরের ক্ল তার কাছে–”
“গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন?”
বাচ্চারা খুব ব্যস্ত, তাদের তৃষার সাথে কথা বলার সময় নেই। মৌটুসি ছুটতে ছুটতে বলল, “পরে বলব।”
তৃষা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকাল, “কী করছে ওরা?”
রাতুল হাসল, বলল, “একটা খেলা। জাহাজটা যতক্ষণ চলে বাচ্চারা ততক্ষণ বাইরে তাকিয়ে সময় কাটাতে পারে। দুই পাশে সুন্দরবন শুরু হয়ে গেছে কখনো গাছে বানর দেখছে, কখনো হরিণ, কখনো কুমির। সবাই রয়েল বেঙ্গল টাইগার খুঁজছে। কিন্তু এখন যখন জাহাজটা থেমেছে তখন তাদের সময় আর কাটছে না। অধৈর্য হয়ে গেছে।”
তৃষা বলল, “এখান থেকে দুজন আনসার তুলবে। রাইফেলওয়ালা আনসার। সেই জন্যে থেমেছি।”
রাতুল বলল, “জানি।”
“ট্রলার করে ভিতরে যেতে হয়েছে সেই জন্যে সময় লাগছে।”
“সেটা জানি, বাচ্চারাও জানে। জেনেও তারা অধৈর্য হয়ে যায়। সেই জন্যে তারা বাচ্চা আর আমরা বড় মানুষ।”
গীতি বলল, “এখন তো তাদের মোটেও অধৈর্য মনে হল না, সবাই দেখি খুবই উত্তেজিত। কী খেলা খেলছে?”
“ট্রেজার হান্ট। গুপ্তধন খুঁজে বের করা। জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের কাছে আমি কু লুকিয়ে রেখেছি। একটা কুয়ের মাঝে পরের কুটা সম্পর্কে লেখা থাকে। মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হয়। মোট বারোটা আছে, এর মাঝে সাত নম্বরে পৌঁছে গেছে।”
“গুপ্তধনটা কী?”
“এই জাহাজে গুপ্তধন আর কী পাব? তাই গুপ্তধনটা হচ্ছে একটা অঙ্গীকার।”
“কী অঙ্গীকার?”
“আজ রাতে ডিসকো নাইট হবে।”
“ডিসকো নাইট?”
“হ্যাঁ। সবাই মিলে নাচানাচি। এখন নাচানাচি করার জন্যে কিছু ধুমধাড়াক্কা গান দরকার। চেষ্টা করছি ডাউনলোড করতে। নেটওয়ার্ক এতো দুর্বল–”
“আছে এই তত বেশি।”
রাতুল মাথা নাড়াল, বলল, “হ্যাঁ সমুদ্রের দিকে গেলে না কী নেটওয়ার্ক থাকে। এখানে আছে।”
শামস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেখানে সে থাকবে সেখানে সে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, সে মোটামুটি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই তাকে বাদ দিয়ে রাতুলের সাথে কথাবার্তাটাতে সে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া তৃষা তার সাথে ঠিক করেছে সে সবার সাথে কথা বলবে, অন্য কেউ নয়। শামস তাই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথাটা যে সত্যি তোমরা দেখেছ?”