মানুষটা বলল, “তোমার জানার দরকার নেই। তুমি হাঁট। সোজা আমার পিছনে পিছনে হাঁট।”
মানুষটা তখন দুই পা হেঁটে গেল। প্রচণ্ড ভয়ে আমি তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। ভাঙা গলায় বললাম, “আমাকে নিয়ে যান প্লীজ। আমাকে রেখে যাবেন না। আমার খুব ভয় করছে।”
“তুমি আমার সাথে আস। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
মানুষটা তখন হাঁটতে থাকে। আমি পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকি। আর তখন আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম–”
এইটুকু বলে রাতুল একটু থামল। বাচ্চাগুলো ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলে?”
“দেখলাম সামনে যে মানুষটা যাচ্ছে তার পা দুটো মানুষের পায়ের মতো না। ঘোড়ার পায়ের মতো। পায়ে খুর, পুরো পা কুচকুচে কালো লোমে ঢাকা। করিডোরে সেই খুর দিয়ে খুট খুট শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে।
আমি তখন কী করেছিলাম মনে নেই। মনে হয় রেলিংয়ের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছি। সেখান থেকে ছুটে গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজে অবশ্য কিছুই জানি না। আমার যখন জ্ঞান হয়েছে তখন আমি হাসপাতালে। আমার এক পাশে হলের হাউস টিউটর, অন্য পাশে আমার এক বন্ধু।
.
রাতুল হাত নেড়ে বলল, “পরে শুনেছি আমি যেই রুমটাতে ঢুকেছিলাম সেখানে কেউ থাকে না। একটা ছেলে সেখানে সুইসাইড করেছিল। যাই হোক সেটা অন্য গল্প। ভূতের গল্প এটুকুই।”
মৌটুসি শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বলল, “তোমার অনেক সাহস!”
রাতুল উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমার মোটেও বেশি সাহস নেই। আসলে আমি একটু বোকা টাইপের, সেটাই হচ্ছে আমার সমস্যা। না বুঝে আমি বিপদের মাঝে পড়ে যাই।”
গীতি বলল, “আজ রাতে ঘুমাতে পারব না।”
তৃষা উঠে দাঁড়াল, বলল, “দিলি তো ভয় দেখিয়ে। এখন আমার পুরো জাহাজ চক্কর দেবার কথা–ভয় করছে।”
রাতুল হাসল, বলল, “ভয় কীসের। আয় আমি তোর সাথে যাই।”
“চল।”
ডেকে সবাই শুয়ে পড়েছে। তাদের মাঝ দিয়ে তৃষা আর রাতুল হেঁটে যায়। তৃষা জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা রাতুল। তুই সত্যি করে বল দেখি–আসলেই হলে তোর ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল?”
রাতুল হেসে ফেলল, বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? এরকম ঘটনা ঘটা সম্ভব?”
তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, “তার মানে তুই বসে বসে এরকম চাপাবাজি করে এসেছিস? মিথ্যা কথা বলে এসেছিস?”
“আমি মোটেও মিথ্যা কথা বলিনি। চাপাবাজি করিনি। আমি গল্প বলেছি। ভূতের গল্প মানুষ শুনে ভয় পাওয়ার জন্যে-ভয়টা অনেক অনেক বেশি হয় যদি সেটা পার্সোনাল গল্প হয়, সত্যি গল্প হয়। তাই একটা ভাব সৃষ্টি করতে হয় যেন গল্পটা সত্যি। তার বেশি কিছু না।”
“তাই বলে এভাবে?”
“কেন সমস্যা কী?”
“সবাইকে এতো ভয় দেখিয়ে দিলি!”
“শোন। ভূত বলে কিছু নেই কিন্তু ভূতের গল্প আছে। আমাদের মতো সৃজনশীল মানুষেরা যদি বানিয়ে বানিয়ে এই গল্প না বানায় তা হলে ভূতের গল্প তৈরি হবে কেমন করে?”
তৃষা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দুজনে হেঁটে যখন রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়েছে তখন শুনতে পেল কোথায় যেন কে গান গাইছে। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে সেই গানের সুর ভেসে আসছে। দুজনে গানের শব্দ খুঁজে খুঁজে নিচে হাজির হল, এক কোনায় কিছু মানুষের জটলা, মাঝখানে একজন খালাসি হারমোনিয়াম দিয়ে গান গাইছে, পাশে একজন একটা অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি উল্টো করে তাল দিচ্ছে। তাকে ঘিরে জাহাজের অন্য মানুষজন।
তৃষা বলল, “কী সুন্দর গলা দেখেছিস?”
“হ্যাঁ। হারমোনিয়াম দিয়ে গাইছে তার মানে লোকটা রীতিমতো চর্চা করে।”
“আয় একটু শুনে যাই।”
দুজনে এগিয়ে যেতেই সবাই তাদের বসার জন্যে জায়গা করে দিল। যে গাইছিল সে থেমে গেল, তৃষা বলল, “থামলেন কেন? প্লীজ গাইতে থাকেন।”
লোকটা তখন আবার গাইতে শুরু করল, প্রিয়াকে দূর দ্বীপে ফেলে রেখে ঝাবিক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দেওয়া সংক্রান্ত একটি গান। গান শেষ হবার পর শুনতে পেল, কে যেন বলছে, “কোথায় তুমি কী খুঁজে পাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কে জানত এখানে এরকম একজন গায়ক পেয়ে যাব।”
তৃষা আর রাতুল ঘুরে তাকাল, নাট্যকার বাতিউল্লাহ কাছাকাছি বসে গান শুনছেন। তৃষা জিজ্ঞেস করল, “ঘুমাতে যাননি এখনো?”
“ঘুম?” বাতিউল্লাহ এমনভাবে কথা বললেন যেন ঘুম অত্যন্ত অশ্লীল একটা শব্দ।
“হ্যাঁ।” তৃষা বলল, “ঘুমাবেন না?”
বাতিউল্লাহ মাথা নাড়লেন, “আমার ঘুম আসে না।”
“ঘুম আসে না?”
“নাহ্। ইনসোমনিয়া। ঘুমের ওষুধ খেলে একটু ঝিমুনির মতো হয়, এর বেশি কিছু না।” বাতিউল্লাহ পকেট থেকে এক গাদা ওষুধ বের করে দেখালেন, “এই দেখ। ঘুমের ওষুধ।” একটা ট্যাবলেট দেখিয়ে বললেন, “এই একটা ট্যাবলেট খেলে ঘোড়া ঘুমিয়ে যাবে। আমি দুইটা খাই তারপরেও ঘুম আসে না।”
রাতুল জিজ্ঞেস করল, “আপনি এই ওষুধ পকেটে নিয়ে ঘুরেন?”
“হ্যাঁ। সব ওষুধ আছে আমার কাছে। পকেটে থাকে। পকেটে ওষুধ না থাকলে কেমন জানি অসহায় অসহায় লাগে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ওষুধগুলো নাড়াচাড়া করি তখন ভালো লাগে। সাহস হয়।” কথা শেষ করে বাতিউল্লাহ হা হা করে হাসলেন।
রাতুল আর তৃষা একটু অবাক হয়ে বাতিউল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকে। গায়ক ঠিক এই সময় আরেকটা গান শুরু করল তাই কথা আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। সবই মিলে গুটিশুটি মেরে গান শুনতে থাকে।
২. আত্মবিশ্বাসের অভাব
“আমার মনে হয় তোমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব।” রাতুল ভুরু কুঁচকে শামসের দিকে তাকিয়ে রইল, রাতুল টের পেল কথাটা শুনে তার একটু মেজাজ গরম হয়েছে। শামস যদি বলত আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, তা হলে তার মেজাজ এতো গরম হত না। শামস নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে, সে একদিকে আর এখানে যারা আছে তারা সবাই অন্য একদিকে। রাতুলের মেজাজটা একটু বেশি খারাপ হল কারণ শামস তাদেরকে তুমি তুমি করে বলছে, সে তো এমন কিছু বয়স্ক মানুষ নয়, তা হলে তাদেরকে তুমি করে কেন বলবে? এখন রাতুলও কী শামসকে তুমি করে বলবে? জিজ্ঞেস করবে, কেন তুমি মনে কর আমাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে?