বোতল থেকে যখন গ্লাসে পানি ঢালছি ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে যেন বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে। আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ আমি জানি হলে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। পায়ের শব্দ যখন ঠিক আমার রুমের সামনে এসেছে। আমি তখন দরজা খুলে বের হলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। বারান্দার এ মাথা থেকে ওই মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ আমার মনে হল বাইরে যেন কনকনে ঠাণ্ডা। আমার সারা শরীরে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন আমার মাঝে প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক এসে ভর করল, আমি তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সেটা অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা অনুভূতি, মনে হতে থাকে আশেপাশে যেন কোনো একটা কিছু আছে, মনে হতে থাকে যেন আমাকে কিছু একটা দেখছে, মনে হতে থাকে কেউ যেন পেছন থেকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার মনে হতে থাকে কেউ যেন খুব কাছে থেকে ফিস ফিস করে কথা বলছে। মনে হয় কেউ যেন নিশ্বাস ফেলছে। আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বিছানায় বসেছি। গ্লাসে পানি ঢেলে রেখেছিলাম, সেটা ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। ঠিক তখন আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। এবারে একজনের পায়ের শব্দ নয় বেশ কয়েকজনের। শুধু পায়ের শব্দ নয়, এবার গলার স্বরও শুনতে পেলাম। বেশ কয়েকজন কথা বলতে বলতে আসছে। আমার তখন বুকের মাঝে সাহস ফিরে এল। গেটের দারোয়ান নিশ্চয়ই অন্য কয়েকজনকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখছে। আমি ঠিক করলাম একা একা আর থেকে কাজ নেই, আমি দারোয়ানের সঙ্গে বের হয়ে যাব।
যখন পায়ের শব্দ আর গলার আওয়াজ আমার দরজার সামনে এসেছে আমি তখন দরজা খুলেছি। দেখি বাইরে কেউ নেই। শুধু যে কেউ নেই তা নয়। একটা শব্দও নেই। পুরোপুরি নিঃশব্দ। আমি আতঙ্কে একেবারে জমে গেলাম। অনেক কষ্ট করে কোনোভাবে তখন নিজেকে শান্ত করেছি। নিজেকে বোঝালাম, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ হলে এসেছে। তারা আমার ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে আমার পাশের কোনো একটা রুমে ঢুকে গেছে। আমার আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নিজেকে নিশ্চিত করার জন্যে আমি বারান্দা দিয়ে কয়েক পা হেঁটে গেলাম, বারান্দায় টিমটিমে একটা লাইটের আবছা আলোতে হলের ঘরের দরজাগুলো লক্ষ করলাম। কোনো একটা ঘরের নিশ্চয়ই তালা খোলা। ভেতরে নিশ্চয়ই মানুষগুলো আছে।
আমি ঠিক তখন আবার নিচু গলার মানুষের কথা শুনতে পেলাম। আমার অনুমান সত্যি। সামনে কোনো একটা ঘর থেকে গলার শব্দ আসছে। আমি কয়েক পা এগিয়ে গেলাম এবং হঠাৎ করে আতঙ্কে পুরোপুরি পাথর হয়ে গেলাম। সামনে সত্যি সত্যি একটা ঘরের দরজায় তালা নেই। দরজার নিচ দিয়ে রক্তের একটা ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে বের হয়ে আসছে।
আমি ঘরের সামনে দাঁড়ালাম আর ভেতরে হঠাৎ করে গলার শব্দ থেমে গেল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাথার ভিতরে সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছি না। ছুটে পালিয়ে যাবার কথা কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি পুরোপুরি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম, কাঁচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, বারান্দার আলো ঘরের ভেতরে পড়েছে, সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘরের মেঝেতে একটা কিছু শুয়ে আছে। চাদর দিয়ে পুরোটা ঢাকা-চাঁদরের নিচে কী আছে জানি না কিন্তু সেটা নড়ছে। নড়া না বলে বলা উচিত ছটফট করছে। চাঁদরে ছোপ ছোপ রক্ত। সেখান থেকে রক্তের একটা ধারা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। তারপর এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম। পায়ের নিচে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। আমি তখন আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। ঘর থেকে বের হয়ে আমি একটা দৌড় দেব তখন হঠাৎ আমার মনে হল, আমি এটা কী করছি? আমি তো ভীতু মানুষ না। কিন্তু আজ আমি জন্মের মতো ভীতু হয়ে যাব। হয়তো এখানে একজন মানুষের সাহায্য দরকার। আমি তাকে সাহায্য না করে পালিয়ে যাচ্ছি। এই কাজটা তো ঠিক হচ্ছে
। তখন আমি আবার ঘরের ভেতর এসে ঢুকলাম। নিচু হয়ে চাদরটা ধরেছি, প্রচণ্ড ভয় করছে। সেই ভয়ের মাঝেই যখন চারদরটাকে একটা টান দেব ঠিক তখন কে যেন প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিল।
“এই ছেলে–কী করছ তুমি?”
আমি চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ঘরের দরজায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে মানুষটার মুখে কুচকুচে কালো লম্বা দাড়ি।
মানুষটা আবার বলল, “কী করছ এখানে? কী করছ?”
এতক্ষণ আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে সাহস দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম–হঠাৎ করে আমার পুরো সাহস উবে গেল। ভয়ে-আতঙ্কে আমি থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছি। আমি বললাম, “আমার খুব ভয় করছে।”
মানুষটা বলল, “ভয় তো করবেই, তুমি জান এটা কি?”
“না, জানি না। এটা কী?”
“সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি বের হয়ে আস। এই মুহূর্তে বের হয়ে আস।”
আমি তখন কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আবার হঠাৎ করে মনে হল আমার ডানে-বামে অনেক ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় আছে আবার তাকালে মনে হয় নাই। তাদের নিশ্বাসের এক ধরনের শব্দ শোনা যায়, অনেক লম্বা লম্বা নিশ্বাস। আমি মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এরা কারা?”