তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই না কী? কীসের গল্প?”
একজন চিৎকার করে বলল, “ভূতের।” সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই চিৎকার করতে থাকে, “ভূতের, ভূতের।”
“তা হলে তো আমারও শুনতে হয়।”
রাতুল বলল, “আমি মোটেও গল্প বলতে পারি না।”
“মিথ্যা কথা বলবি না। তোর মতো গুলপট্টি আর কেউ মারতে পারে না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প করার মাঝে তুই হচ্ছিস এক্সপার্ট। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন।”
বাচ্চারা এবার টেনে রাতুলকে বসিয়ে দিল, কিছু বোঝার আগে সবাই তাকে ঘিরে বসে যায়। শুধু বাচ্চারা না-আশেপাশে থাকা অন্যরাও চলে আসে। এমন কী তৃষাও রাতুলের পাশে বসে গেল।
রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে সবার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি শুনতে চাও?”
“হ্যাঁ। হা।”
“ভূতের গল্প?”
“হ্যাঁ।”
“ভয় পাবে না তো?”
“না। না।”
রাতুল কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি তখন মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।”
গীতি তাকে থামাল, “তুমি তোমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলবে?”
“অবশ্যই।”
“তুমি ভূত দেখেছ?”
“আমি ঘটনাটি বলি-তোমরাই বলো, এটা ভূত না অন্য কিছু?”
“তার মানে তুমি ভূতে বিশ্বাস কর?”
“তুমি কর না?”
গীতি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু।”
তৃষা বলল, “যদি ভূত বলে কিছু থাকত তা হলে বৈজ্ঞানিকরা এত দিনে সেটাকে ধরে একটা বোতলে ভরে হাই ভোল্টেজ ডিসচার্জ করে বের করে ফেলত ভূত কী দিয়ে তৈরি!”
গীতি মাথা নাড়ল, “জেনেটিক কোডিং বের করে ফ্যামিলি হিস্ট্রিও বের করে ফেলত।”
বাচ্চারা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা শুনতে চাইছিল না, তারা রাতুলকে তাড়া দিল, “বলল, গল্প বলো।”
রাতুল আবার শুরু করল, “আমি তখন মাত্র ইউনিভার্সিতে ভর্তি হয়েছি। হলে জায়গা পাচ্ছি না তাই–”
এরপর রাতুল কীভাবে হলে জায়গা পেল এবং অত্যন্ত বিচিত্র একজন রুমমেট তাকে প্ল্যানচেট করা শেখাল এবং কীভাবে এক অমাবস্যার রাতে মৃত মানুষের আত্মা আনতে গিয়ে ভয়াবহ বিপদের মাঝে পড়েছিল তার একটা অত্যন্ত নিখুঁত বর্ণনা দিল। গল্প শুনতে গিয়ে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল এবং গল্প শেষ হবার পর সবাই চুপ করে রইল। বেশ খানিকক্ষণ পর তৃষা বলল, “গুলপট্টি। চাপাবাজি। পরিষ্কার চাপাবাজি–এটা হতেই পারে না।”
কিন্তু ততক্ষণে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে এবং সজল নামে ভলান্টিয়ারদের একজন তার বড় বোনের অভিজ্ঞতাটি সবিস্তারে বর্ণনা করল। এরপর গীতির আরেকটা ছোট ঘটনা। তারপর আবার রাতুলের গল্প, পরপর তিনটি। যে গল্পটা শুনে সবার হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে গেল সেটা এ রকম :
“দুই বছর আগের ঘটনা। রোজার ঈদের ঠিক আগে আগে আমার নানার হার্ট অ্যাটাক হল। সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা সিপিআর করে কোনোমতে নানাকে বাঁচিয়ে তুললেন। এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল হার্টে পাঁচটা ব্লক, সার্জারি করতে হবে। সবাই মিলে ঠিক করল, নানাকে অপারেশন করার জন্যে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে। নানা ভীতু মানুষ তাই সাথে যাবেন আমার মা। আমার মা একা একা কোথাও যান না তাই বাবাকে সাথে যেতে হবে। বাবার ছুটি নিয়ে ঝামেলা তাই ঠিক হল ঈদের ছুটিতে যাওয়া হবে। আমার আর একটি মাত্র বোন, তার বিয়ে হয়ে গেছে, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ দুজনেই ডাক্তার। দুটি বাচ্চাকে নিয়ে সিলেট থাকেন। তাই ঈদের আগে আমি আবিষ্কার করলাম, ঈদের ছুটিতে আমার যাওয়ার জায়গা নেই–ঠিক করলাম হলেই থেকে যাব। এটা এমন কিছু ব্যাপার না। পরীক্ষার আগে অনেকেই বাড়িতে যায় না, হলে থেকে যায়। তা ছাড়া কিছু ছাত্র আছে এরা পরীক্ষা থাকুক না থাকুক, ছুটিছাটা থাকুক না থাকুক সবসময়ই হলে থাকে।
রোজা যতই শেষ হতে থাকল, হল খালি হতে থাকল। ২৭ রোজার পর মনে হল হল বুঝি একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি যখন হল থেকে বের হই কিংবা ঢুকি তখন দারোয়ান জিজ্ঞেস করে, “স্যার, বাড়ি যাবেন না?” আমি যখন মাথা নেড়ে বলি”নাহ্!” তখন দারোয়ানের মুখটা ভোতা হয়ে যায়। হলে কেউ না থাকলে সে গেটে তালা মেরে চলে যেতে পারে। কিন্তু একজনও যদি ভেতরে থাকে তা হলেই তার গেটে ডিউটি করতে হয়। তাই তার মেজাজ খারাপ হতেই পারে।
যাই হোক, ঈদের আগে আগে ঢাকা শহর ফাঁকা হতে শুরু করে। কিন্তু দোকানপাটে মানুষের ভিড়। আমার কোনো কাজকর্ম নেই, তাই শপিং মলে ঘুরে বেড়িয়ে রাতে কোনো হোটেলে খেয়ে হলে ফিরে আসি। ঢাকা শহরে আমার যে বন্ধুবান্ধবরা থাকে তারা আমাকে তাদের বাসায় থাকার জন্যে বলেছে। কিন্তু ঈদ একটা পারিবারিক উৎসব, ফ্যামিলির সবাই একসঙ্গে থেকে ঈদ করবে, আমি বাইরের একজন মানুষ অন্যের ফ্যামিলিতে ঢুকে যাই কেমন করে?
ঈদের দিনটা ভালোই কাটল, ঈদের পরদিন ঢাকা শহরে আমার যাওয়ার জায়গা নেই। বিকেল পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগে আগে হলে ফিরে এসেছি। গেটে কেউ নেই, অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষ পর্যন্ত দারোয়ানকে পাওয়া গেল। সে এসে গোমড়া মুখে গেট খুলে দিল। আমি এসে রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিচিত্র স্বপ্ন দেখছি–অসময়ে ঘুমালে যা হয়। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভাঙল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, আমি কোথায়। যখন সবকিছু মনে পড়ল তখন আমি উঠে বসেছি, প্রথম আমার যে কথাটা মনে হল, সেটা হচ্ছে চারদিক আশ্চর্য রকম নীরব। আমি এতদিন এখানে আছি কখনও মনে হয়নি এ রকম নিঃশব্দ একটা রাত দেখেছি। আমি বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি দেখলাম, রাত এগারোটা। রাতে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসার কথা ছিল, এত রাতে আর কোথায় যাব? ঈদ উপলক্ষে গত দুদিনে এত খাওয়া হয়েছে, সপ্তাহখানেক না খেলেও কিছু হওয়ার কথা নয়। আমি ঠিক করলাম দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।