রাজু ভয় পাওয়া গলায় বলল, “মামা, যদি কোনোকিছু পাওয়া না যায়?”
“না পাওয়া গেলে নাই।”
“তখন কী হবে?”
মামা চোখ নাচিয়ে হাসলেন, “তা হলে তো মজাটা হবে! রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গান গাইতে গাইতে যাব। ধুলার মাঝে পা ডুবিয়ে হেঁটে যেতে কী মজা–কখনও হেঁটেছিল?”
রাজু মাথা নাড়ল, সে হাঁটেনি।
মামা জিব দিয়ে এরকম শব্দ করলেন, “ফাস্ট ক্লাস।”
রাজুর প্রথমে একটু সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু একটু পরে দেখল সত্যি সত্যি মামার মাঝে দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটা নেই। কোথায় যাবেন কী করবেন সেটা যেন ব্যাপারই না, উলটো তার মাঝে একটা ফূর্তির ভাব চলে এসেছে। ফূর্তি জিনিসটা মনে হয় সংক্রামক, একটু পরে রাজু আর সাগরের ফূর্তি লাগতে লাগল।
মাইলখানেক হেঁটেই একটা ছোট নদী এবং নদীর উপরে একটা ব্রিজ পাওয়া গেল, ব্রিজের সামনে দুটো মালগাড়ি রেললাইনের উপর কাত হয়ে পড়ে আছে। মালগাড়িকে ঘিরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছে। তাদের দেখে মনে হল না ব্যাপারটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা আছে। মামা তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলেন ক্রেন আনার জন্যে খবর পাঠানো হয়েছে, এখনও চার-পাঁচ ঘণ্টার ধাক্কা।
আজগর মামা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নদীর তীরে নেমে এলেন। সেখানে কিছু নৌকা বাঁধা ছিল, মামা গিয়ে নৌকার মাঝিদের সাথে এমনভাবে গল্পগুজব করতে শুরু করলেন যেন কতদিন থেকে তাদের সাথে পরিচয়। মাঝিদের কাছে খবর পাওয়া গেল নদী পার হয়ে অন্য তীরে গেলে ছোট রাস্তা আছে, কপাল ভালো থাকলে রিকশা পাওয়া যায়–সেই রাস্তা ধরে পাঁচ-ছয় মাইল গেলে বাস পাওয়া যাবে। শুনে মামা রাজুর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন, দেখলি, বলেছিলাম না, কিছু-একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে!
আজগর মামা নদী পার হওয়ার জন্যে একটা নৌকা ভাড়া করলেন। সেই নৌকায় বসে জুতা খুলে পা ডুবিয়ে দিলেন নদীর পানিতে। মামার দেখাদেখি রাজু আর সাগরও চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের পা ছোট বলে পানি নাগাল পেল না, শুধু নৌকার দুলুনিতে ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিতে লাগল। নদীটা দেখতে খুব ছোট মনে হচ্ছিল, কিন্তু পার হতে গিয়ে দেখা গেল সেটা খুব ছোট নয়। নদীর মাঝামাঝি বেশ স্রোত, পানিতে কেমন জানি কালচে সবুজ রং, তাকালে কেমন জানি ভয়-ভয় করে, মনে হয় পানির নিচে বুঝি রহস্যময় কিছু লুকিয়ে আছে।
নদী পার হয়ে মামার মনে হয় বেশ ফূর্তি হল। যখন দেখলেন ওপারে কোনো রিকশা নেই তখন ফূর্তিটা আরও বেড়ে গেল–পুরো রাস্তাটা হেঁটে হেঁটে যেতে পারবেন। মামা তখন তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গান ধরলেন। আজগর মামার অনেকগুণ, তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই, কিন্তু গানের ব্যাপারটিতে খোদা তাঁকে ছিটেফোঁটা কিছু দেননি। তার গলায় কোনো সুর নেই, চড়া জায়গায় এলেই তার স্বর চিরে যায় এবং হঠাৎ করে তার গলা মোটা হয়ে যায়। তবে মামার দরদের কোনো অভাব নেই–শুধু দরদের কারণেই রাজু মামার গান শুনে হেসে ফেলল না, বরং নিজেও তাঁর সাথে গাইতে শুরু করল। রাজুর দেখাদেখি সাগরও। তাদের গান শুনেই হোক আর যে-কারণেই হোক, কিছুক্ষণের মাঝেই গ্রামের রাস্তায় তাদের পিছুপিছু ছোট বাচ্চাদের একটা দল হাঁটতে শুরু করে, রাজু একা হলে লজ্জায় মাথা কাটা যেত, কিন্তু আজগর মামার কোনো জক্ষেপ নেই।
ঘণ্টাখানেক হেঁটে সাগর বলল, সে আর পারছে না–ট্রেনে করে সে আম্মার কাছে ফিরে যেতে চায়। শুনে আজগর মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, “সে কী! এখনও তো মজার কিছু শুরুই করলাম না!”
সাগর বলল, তার আর মজা করার ইচ্ছে করছে না, পা ব্যথা করছে। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। আজগর মামা তখন তাকে কাঁধে তুলে নিলেন। কাঁধে উঠে সাগরের মতো একটু ভালো হল, চোখ মুছে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল।
সাগরকে ততক্ষণ ঘাড়ে করে নিতে হত কে জানে, কিন্তু ঠিক তখন টুনটুন করে একটা রিকশা হাজির হল। আজগর মামা মনে হয় একটু ব্যাজার হয়েই রিকশায় উঠলেন। গ্রামের রাস্তায় রিকশা অবিশ্যি খুব আরামের ব্যাপার নয়–হাঁটতে হয় না সত্যি, কিন্তু ঝাঁকুনিতে জীবন বের হয়ে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত যখন বড় রাস্তা পৌঁছাল তখন যেন জানে পানি এল সবার। রাস্তার মোড়ে একটা বটগাছ, তার নিচে একটা ছোট দোকান, এটাই হচ্ছে বাসস্টেশন। দোকানটি একই সাথে মুদির দোকান, একই সাথে পান-সিগারেটের দোকান, আবার একই সাথে চায়ের দোকান। সামনে একটা ছোট বেঞ্চ। মামা বেঞ্চে পা তুলে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন। মামাকে দেখেই কি না কে জানে, দোকানি চায়ের কাপ গরম পানিতে থোয়া শুরু করল।
চা খেতে খেতে আজগর মামা দোকানির সাথে গল্প শুরু করলেন। তার কাছেই জানা গেল একটু পরপরেই বাস আসে, কাজেই তাদের যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। দোকানির কথা সত্যি, কারণ চা খেতে খেতেই একটা বাস এসে হাজির। বাসের কন্ডাক্টর নিচে নেমে বাসের গায়ে থাবা দিতে দিতে তারস্বরে চাচাতে শুরু করল। মামা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা তিনজন যেতে পারব?”
কন্ডাক্টর মামার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “কোনো অসুবিধা নাই, উঠেন।”
‘সাথে বাচ্চা ছেলে আছে, বসার জায়গা দরকার।”
“বসার জায়গা করে দেব। কোনো অসুবিধা নাই।”