- বইয়ের নামঃ যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কক্সবাজার
প্রতি রাতেই এই বাসার বাচ্চা-কাচ্চারা তাদের লেখাপড়া শেষ করে দাদির (কিংবা নানির) ঘরে হাজির হয়। দাদি সাধারণত গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে কোনো একটা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, সেখান থেকে এক সেকেন্ডের জন্যে চোখ সরিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, লেখাপড়া হয়েছে ঠিকমতো?’ বাচ্চারা আসলে লেখাপড়া করে থাকুক আর নাই করে থাকুক চিৎকার করে বলে, হয়েছে দাদি (কিংবা নানি) দাদি তখন বলেন, “খবরদার কোনো গোলমাল চেঁচামেচি নাই। আমাকে নাটকটা দেখতে দে ঠিকমতো। বাচ্চারা চিৎকার করে বলে, “ঠিক আছে দাদি (কিংবা নানি) তারপর গোলমাল চেঁচামেচি চিৎকার শুরু করে দেয়।
আজকেও ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটছিল তখন ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। বাচ্চারা তাদের অভ্যাসমতো তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি গোলমাল থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তার হাতে কোনো খাবারের প্যাকেট নাই দেখে তারা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল, একজন বলল, “ছোটাচ্চু, আজকেও তুমি কিছু আন নাই?”
ছোটাচ্চু মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “কে বলেছে আনি নাই। অবশ্যই এনেছি।”
বাচ্চারা তখন এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? তোমার হাতে তো কোনো প্যাকেট নাই।”
ছোটাচ্চু তার মুখের হাসিটা আরো বাড়িয়ে রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, “আমি যেটা এনেছি সেটা আনতে কোনো প্যাকেটের দরকার হয় না।”
এবারে সবাই যথেষ্ট কৌতূহলী হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? কী এনেছ? কী?”
ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে খুব কায়দা করে তার মোবাইল টেলিফোনটা বের করে এনে বলল, “একটা এসএমএস।”
“এসএমএস?” বাচ্চারা এবারে অবাক হবে না হতাশ হবে বুঝতে পারল না।
“হ্যাঁ, একটা এসএমএস।” ছোটাছুর আরো বেশি রহস্যের মত ভঙ্গি করে বলল, “আমি কী পড়ে শোনাব এসএমএসটা?”
বাচ্চারা একটু সন্দেহের ভঙ্গি করে বলল, “পড়।”
ছোটাচ্চু মুখটা গম্ভীর করে বলল, “এসএমএস-টা পাঠিয়েছে আমার বন্ধু জয়ন্ত। সে লিখেছে, দোস্ত, আমি তোর বাসার বাচ্চাদের বলেছিলাম তাদেরকে কক্সবাজার না হয় রাঙামাটি বান্দরবান পাঠাব। তারা কী রেডি? সামনের ছুটিতে কী যেতে পারবে? আমি কী আমার সেক্রেটারিকে বলব তোদের সাথে কথা বলে প্লেনের টিকিট কিনতে? হোটেল রিজার্ভেশন করতে?”
ছোটাচ্চু এসএমএসটা পড়ে শেষ করতে পারেনি তার আগেই বাচ্চারা এমনই গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল যে রান্নাঘর থেকে ঝুমু খালা ওপর থেকে বড় চাচা, মেজো চাচা এবং ছোট ফুপু ছুটে এলেন দেখার জন্যে কী হয়েছে। দাদির (কিংবা নানির) সিরিয়ালে খুবই একটা জটিল মুহূর্ত চলছিল, বাড়ির বউ শ্বাশুরির অত্যাচারে বাড়ির ছাদের কার্নিশে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কিছু একটা বলছিল, বাচ্চাদের চিৎকারে সেটা দাদি শুনতে পেলেন না। সেই চিৎকার শুনে ফুটফুটে বউটি চমকে উঠে কার্নিশ থেকে পড়ে না যায় দাদির সেরকম আশঙ্কা হতে লাগল।
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত কাকু বাসায় সব বাচ্চাদের কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে শোনার পর সবাই মেনে নিল এরকম একটা কথা শোনার পর এ ধরনের বিকট চিৎকার দেওয়াই যেতে পারে। সত্যিই জয়ন্ত কাকু এটা লিখেছে নাকি ছোটাচ্চু বাচ্চাদের সাথে রসিকতা করছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সবাই একজন একজন করে এসএমএসটা পড়ল। বাসের টিকিট কিংবা ট্রেনের টিকিট লিখতে গিয়ে ভুলে প্লেনের টিকিট লিখে ফেলেছে কী না সেটা নিয়েও একটু আলোচনা হলো। শান্ত তখন সবাইকে মনে করিয়ে দিল জয়ন্ত কাকু ইচ্ছা করলে আস্ত প্লেনটাই রিজার্ভ করে ফেলতে পারে! তার জন্য আট-দশটা প্লেনের টিকিট কেনা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার মতো একটা ব্যাপার।
তখন তখনই কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সাথে কী কী নিতে হবে তার লিস্ট তৈরি করতে সবাই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল। প্রথম লিস্ট যেটা তৈরি হলো সেটা দেখে ছোটাচ্চু বলল যে এত মালপত্র নিয়ে প্লেনটা উড়তে পারবে না। তখন সবাই দ্বিতীয় লিস্ট তৈরি করতে বসে গেল, কিন্তু পরদিন সকালে স্কুলে যেতে হবে সেজন্যে সবাইকে রীতিমতো জোর করে ঘুমাতে পাঠানো হলো। বিছানায় শুয়েও তাদের চোখে ঘুম আসতে চায় না, কক্সবাজার গিয়ে কী করবে সেটা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সবাই ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে।
.
পরদিন থেকে কক্সবাজার যাবার প্রস্তুতি পুরো উদ্যমে শুরু হয়ে গেল। সবার আগে ঠিক করতে হবে কে কে যাবে। এই বাসার কেউ ঝুমু খালাকে ছাড়া নড়তেও পারে না তাই তাকে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো। ঝুমু খালা যখন জানতে পারল দাদি যাবেন না শুধু বাচ্চা কাচ্চারা যাবে তখন সে যেতে রাজী হলো না। মায়েরা যেভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের বুক আগলে রাখে ঝুমু খালাও অনেকটা সেইভাবে দাদিকে বাচ্চার মতো বুক আগলে রাখে। প্রমি ঝুমু খালাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সমুদ্র দেখেছ ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা বলল, “না দেখি নাই।”
প্রমি বলল, “তুমি যদি আমাদের সাথে যাও তাহলে সমুদ্র দেখতে পারবে।”
“সমুদ্রে আছে কী?” “পানি আর পানি।”
ঝুমু খালা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমার পানি দেখার জন্যে কক্সবাজার যাইতে হবে? পাকঘরে ট্যাপ খুললেই তো আমি পানি দেখবার পারি। পানি আর পানি–যতক্ষণ খোলা ততক্ষণ পানি।”
ঝুমু খালার এই যুক্তি শুনে প্রমি এতই ঘাবড়ে গেল যে সে আর কোনো কথাই বলতে পারল না।
ঝুমু খালা যেহেতু যাবে না তাই বড় মানুষদের মাঝে ছোটাচ্চুকে নেওয়া হলো। শান্ত বেশ খোলামেলাভাবে ছোটাচ্চুকে জানাল যে এটা শুধু বাচ্চাদের ট্রিপ হওয়ার কথা। তারা যে ছোটাচ্চুকে সাথে নিচ্ছে সেটা তার প্রতি এক ধরনের দয়া দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। ছোটাচ্চু যেন সেটা মনে রাখে এবং কক্সবাজার পৌঁছানোর পর ছোটাচ্চু যেন বাচ্চা-কাচ্চাদের স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে বাধা না দেয়।
ঠিক কী কারণ জানা নেই শান্তর কথা শুনে ছোটাচ্চু রেগে উঠল, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “তোদের লেজ বেশি মোটা হয়েছে? (শান্ত বুঝতে পারল না লেজের বিষয়টা কোথা থেকে এসেছে) তোরা জানিস আমি যদি ফোন করে জয়ন্তকে শুধু একবার বলি বাচ্চাগুলোর লেজ বেশি মোটা হয়েছে, ওদের ট্রিপ ক্যান্সেল করে দে সাথে সাথে জয়ন্ত তোদের পুরো ট্রিপ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। সেটা জানিস?”
শান্ত ছোটাচ্চুর ব্যবহারে খুবই অবাক হলো–অন্যেরা অবশ্যি সেরকম অবাক হলো না, তাই সবাই মিলে ছোটাচ্চুকে শান্ত করে ফেলল।
বাসায় সবচেয়ে ছোটদের ভেতরে মুনিয়ার কক্সবাজার যাওয়ার অনুমতি হলো, এর আগে সে তার আবু-আম্মু ছাড়া কখনো কোথাও থাকেনি কিন্তু মুনিয়া বারবার সবাইকে জানাল সে যেহেতু এখন বড় হয়ে গেছে আন্ধু-আম্মু ছাড়া তার থাকতে কোনোই সমস্যা হবে না। ট্রিপের সবচেয়ে বড় সদস্য শাহানা, সে সার্টিফিকেট দিল যে সে মুনিয়াকে দেখে-শুনে রাখবে তখন মুনিয়ার আম্মু তাকে যেতে দিতে রাজি হলেন।
মুনিয়ার ছোট আর তিনজন আছে তাদের একজন একেবারেই ছোট, এখনো বেশির ভাগ সময় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। অন্য দুজন একটু বড় হয়েছে কথা-বার্তা বুঝতে শিখেছে তারাও কক্সবাজার যাবার জন্যে রেডি হয়ে গেল।
শান্ত সবাইকে অভয় দিয়ে বলল, সে এই দুজনকে সামলে নেবে যেন তারা কক্সবাজার যেতে না চায়। সত্যি সত্যি শান্ত তাদের কী বোঝাল কে জানে হঠাৎ করে তারা কক্সবাজার যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। যে পদ্ধতিতে এই দুজনকে শান্ত সামলে নিয়েছে সেটা অবশ্যি খুব প্রশংসা করার মতো পদ্ধতি নয়। কারণ শান্ত দুজনকে একটা অন্ধকার ঘরে ডেকে নিয়ে বলল, “কক্সবাজারে কী আছে তোরা জানিস, সেখানে যে যেতে চাচ্ছিস?”
বাচ্চা দুজন ভয়ে ভয়ে বলল, “কী আছে?”
“জঙ্গল। খালি কাটা কাটা গাছ। গাছের ওপর কন্ধ কাটা ভূত।”
বাচ্চা দুজন ফ্যাকাশে মুখে বলল, “কন্ধ কাটা ভূত কী?”
“যে ভূতের মাথা কাটা। মাথাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।”
বাচ্চা দুজন শিউরে উঠল। একজন বলল, “কিন্তু সবাই যে বলছে কক্সবাজারে সমুদ্র?”
শান্ত বলল, “সমুদ্রও আছে, কিন্তু সেইখানে লোনা পানি মুখে গেলেই ওয়াক ওয়াক করে বমি।”
“তাহলে সবাই যে যাচ্ছে?”
“সবাই যাচ্ছে কারণ যেন বমি না হয় সেইজন্যে প্রত্যেক বেলা সবার দুই হাতে দুইটা ইনজেকশান দেবে। এই মোটা সুই–” শান্ত সুইয়ের যে সাইজ দেখালো সেটা দেখেই দুজনের কক্সবাজার যাওয়ার সব সখ মিটে গেল!
যেদিন কক্সবাজার যাওয়ার কথা তার আগের রাতে বাচ্চাদের ঘুমাতে অনেক দেরি হলো কারোই ঘুম আসছিল না। তবে পরদিন সকালে কারোই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো না। সকাল দশটায় ফ্লাইট কিন্তু অনেক আগেই সবাই গোসল করে জামা-কাপড় পরে রেডি হয়ে থাকল। জয়ন্ত কাকুর বড় ভ্যান আটটার সময় বাসায় পৌঁছে গেল, সবাই যখন ভ্যানে উঠছে তখন মুনিয়ার চোখ এক দুইবার ছল ছল করে উঠেছে কিন্তু কেউ সেটা দেখার আগেই মুনিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলেছে। ভ্যানে ড্রাইভারের পাশে মোটা সোটা একজন মানুষ বসেছে, মেটাসোটা মানুষেরা সাধারণত হাসি-খুশি হয় কিন্তু এই মানুষটা গোমড়ামুখী। শুধু যে গোমড়ামুখী তা নয় দেখে মনে হয় একটু হাবাগোবা টাইপ। সামনের সিটে বসে লম্বা লম্বা হাই তুলে সে সবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল।
বাসার বারান্দায় বড়রা সবাই দাঁড়িয়ে আছে, দাদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সবার হাত ধরে বললেন, ‘ফি আমানিল্লাহ’ তারপর কী একটা দোয়া পড়ে ভ্যানের ভেতর ফুঁ দিয়ে দিলেন। ঝুমু খালা কক্সবাজার নিয়ে সবাইকে উপদেশ দিল, যে কেউ শুনলে সে মনে করবে ঝুমু খালা বুঝি কক্সবাজারে তার জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়েছে। চাচা-চাচি খালা-খালু ফুপু-ফুপা সবাই হাত নেড়ে বাচ্চাদের বিদায় দিল, ঠিক ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে কোথা থেকে জানি জয়ন্ত কাকু হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে বলল, “জয়ন্ত কাকু। তুমি যাবে আমাদের সাথে?”
জয়ন্ত কাকু মাথা নেড়ে বলল, “না, না! তোমাদের শুধু এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে আসি।”
ভ্যান ছেড়ে দিল। বাচ্চারা আনন্দে গান গাইতে থাকে চিৎকার করতে থাকে এবং এর মাঝেই মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ভ্যানটা এয়ারপোর্টের দিকে যেতে শুরু করে।
এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পর যখন সবাই ভ্যান থেকে নামছে, নিজের জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করছে তখন জয়ন্তকাকু ছোটাচ্চুকে এক পাশে টেনে নিয়ে বলল, “তোদের সাথে যাবার জন্যে আমি কাজেম আলীকে দিয়ে দিলাম।”
ছোটাচ্চু বলল, “মোটাসোটা বেজার মানুষটার নাম কাজেম আলী?”
জয়ন্ত কাকু হাসল, বলল, “হ্যাঁ। খুব কম কথা বলে কিন্তু কাজেম আলী থেকে কাজের মানুষ দুনিয়াতে এখনো জন্ম হয় নাই। দেখে-শুনে মনে হবে কিছু বুঝেসুঝে না কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান। তোদের সব দায়িত্ব ওর হাতে। যেকোনো ক্রাইসিস সামাল দিতে পারবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “গুড। ক্রাইসিস হলে আমি তাল খুঁজে পাই না।”
বাচ্চাদের কেউই আগে কখনো প্লেনে উঠে নাই, তাই ছোটাচ্চু সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে আলাদা আলাদা ভাবে নিজের বোর্ডিং কার্ড নিতে বলল। কেউ স্বীকার করল না কিন্তু সবারই বুক ধুক ধুক করছিল যদি বোর্ডিং কার্ডের মহিলা হঠাৎ করে কাউকে বলে বসে যে তার টিকিটে গোলমাল আছে এবং সে যেতে পারবে না? তাহলে কী হবে? কিন্তু সেরকম কিছু হলো না সবাই একটা বোর্ডিং কার্ড পেয়ে গেল।
এক্স-রে মেশিনে তাদের ব্যাগ চেক করে সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। এখন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করা। একটু পরে পরে সবাই দেখছে প্লেনটা ঠিক সময়েই ছাড়বে নাকি ছাড়তে দেরি হবে। ভেতরে অপেক্ষা করার জায়গাটাতে অনেক মানুষ–একেকজন একেক জায়গায় যাবে। তবে বাচ্চাদের এই দলটার মতো আর কেউ নেই। বাচ্চারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে উত্তেজনাটা দমিয়ে রাখতে কিন্তু কোনোভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ার সময় হলো। একটা বাসে সবাইকে তুলে নিয়ে তাদেরকে প্লেনের কাছে নামিয়ে দিল। সিঁড়ি দিয়ে প্লেনের ভেতরে ঢুকে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। কী সুন্দর সারি সারি সিট, তারা দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের সিটে বসে এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করল শুধু অর্ধেকে জানালার কাছে সিট পেয়েছে। যারা জানালার পাশে সিট পায় নাই হঠাৎ করে তাদের মনে হলো এই জীবন বৃথা। যারা একটু ছোট তারা প্রায় কেঁদেই ফেলত, তখন ছোটাচ্চু সমাধান করে দিল। অর্ধেক সময় একজন জানালার কাছে বসবে, বাকি অর্ধেক সময় অন্যজন।
প্লেনে বসে সিট বেল্ট বেঁধে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। এয়ার হোস্টেস কখন কী করতে হবে সবকিছু বলে দিল। একটু পরেই গর্জন করে প্লেনটা নড়তে থাকে। যখন রানওয়ে দিয়ে প্লেনটা ছুটতে থাকে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, আর কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি এত বড় প্লেনটা দেখতে দেখতে আকাশে উঠে গেল। যারা একটু বড় হয়ে গেছে তার মুখটা গম্ভীর করে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু যারা ছোট তারা আনন্দে চিৎকার করে উঠে।
প্লেনের জানালা দিয়ে সবাই নিচে তাকিয়ে থাকে, প্রথমে শহরের দালান কোঠা, তারপর গ্রাম, নদী এক সময় সমুদ্র। একেবারে ঘড়ি ধরে মাঝামাঝি সময়ে জানালার পাশে যারা বসেছে তাদের সাথে সিট বদল করা হলো। শান্ত একটু গাই-গুই করছিল, ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে তার সিট বদল করাল।
দেখতে দেখতে তারা কক্সবাজার পৌঁছে যায়। এত তাড়াতাড়ি তাদের প্লেনের ভ্রমণ শেষ হয়ে যাবে কেউ আশা করে নাই। কক্সবাজার পৌঁছানোর পর যখন প্লেন থেকে নামার সময় হলো তারা অবাক হয়ে দেখল জয়ন্ত কাকু তাদের দেখভাল করার জন্য কাজেম আলী নামে যে মোটাসোটা বেজার মানুষটিকে দিয়েছেন সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্লেনে জানালার কাছে সিট পেয়েও একজন
পুরো সময়টা নাক ডেকে ঘুমাতে পারে সেটা তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না!
কাজেম আলী হঠাৎ ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠল। নিজের ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে সে সবার সাথে নামল। যেহেতু কারোই আলাদা লাগেজ নাই তাই তারা কাজেম আলী নামের মানুষটার পিছু পিছু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে তাদের নেওয়ার জন্যে হোটেলের বিশাল একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। তারা ওঠামাত্র সেটা ছুটে যেতে থাকে, খানিকদূর যেতেই তারা হঠাৎ করে দেখে সামনে সমুদ্র। কী আশ্চর্য ব্যাপার! মনে হচ্ছে একেবারে আকাশ থেকে বুঝি সমুদ্রটা নিচে নেমে আসছে।
এই বাচ্চাদের নিয়ে আগে যেটা কখনো ঘটেনি হঠাৎ করে সেটা ঘটে গেল, হঠাৎ করে সবাই চুপ হয়ে গেল। সমুদ্রের নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের ম্যাজিক আছে কারণ সবাই চুপ করে অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমবার সমুদ্র দেখলে সবাই কেন যে অবাক হয়ে যায়! এত বড় সমুদ্র? কোনো শুরু নেই, শেষ নেই যতদূর তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি? সেই পানিতে একটার পর একটা ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তীরে এসে লুটিয়ে পড়ছে।
হোটেলে পৌঁছানোর পর কাজেম আলী নামের মোটাসোটা মানুষটা রিসেপশান ডেস্কে কিছু কাগজপত্র সাইন করে অনেকগুলো প্লাস্টিকের কার্ড নিয়ে এলো। এগুলোই নাকি হোটেল রুমের চাবি। কী আশ্চর্য!
লিফটে করে সবাই ছয় তলায় উঠে যায় সেখানে সারি ধরে অনেকগুলো রুম তাদের। তাদের সাথে হোটেলের একজন মানুষ এসেছে সে কীভাবে প্লাস্টিকের কার্ড দিয়ে রুমের তালা খুলতে হয় শিখিয়ে দিল।
হোটেল রুমের ভেতর ঢুকে বাচ্চারা আবার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। বিশাল কাঁচের জানালা, সেই জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। তারা ছোটাচ্চুটি করে জানালার কাঁচ খুলে ফেলল, সাথে সমুদ্রের লোনা বাতাস হু হু করে রুমের ভেতরে ঢুকে যায়, তার সাথে সমুদ্রের গর্জন! মনে হচ্ছে সমুদ্রটা কাঁদছে। কী আশ্চর্য!
কোন রুমে কে থাকবে সেটা নিয়ে আবার ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা হতে দিল না। মোটামুটি ধমক দিয়ে রুম ভাগ করে দিল, প্রতিটা রুমে দুজনের জন্য দুটি বিছানা। একজন বড় এবং একজন ছোট। শাহানার সাথে মুনিয়া। টুনির সাথে টুম্পা। ছোটাচ্চুর সাথে শান্ত।
নিজেদের রুমে গিয়ে সবাই কাপড়-জামা বদলে তখন তখনই সমুদ্রে যাবার জন্যে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু তখন বলল লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে, তাই সমুদ্রে যাওয়ার আগে সবাইকে খেয়ে নিতে হবে। খাওয়ার কথা শুনে এক সাথে সবার খিদে পেয়ে যায়। হোটেলের দোতলায় রেস্টুরেন্ট সবাই মিলে যখন যাচ্ছে তখন পাশের একটা রুম থেকে একজন মানুষ ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে বের হলো। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন কাঁদছে কে জানে? মেয়েটা মুনিয়ার বয়সী, মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে মুনিয়ারও আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল আর তার চোখও ছল ছল করে উঠল।
রেস্টুরেন্টে কয়েকটা টেবিল এক সাথে লাগিয়ে তাদের সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। কে কার পাশে বসবে সেটা নিয়েও একটু ঝগড়াঝাটি হলো, তখন ছোটাচ্চুর একটা রাম ধমক খেয়ে সবাই ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে খেতে বসে গেল।
কাজেম আলী চাচা তখন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় বক্তৃতা দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, “সবাই আমার দিকে তাকাও, আমি কয়েকটা জিনিস তোমাদের সবাইকে জানিয়ে রাখি।”
তারা এই প্রথম কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনতে পেয়েছে। এই মানুষটা কথা বলতে পারে কী না সেটা নিয়েই তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছিল। সবাই কৌতূহল নিয়ে কাজেম আলী চাচার দিকে তাকাল তখন কাজেম আলী চাচা বলল, “সমুদ্রে যাওয়ার কিছু নিয়ম-কানুন আছে সেগুলো না জেনে কেউ সমুদ্রে নামতে পারবে না। একটা নিয়ম হচ্ছে ভাটার সময় কখনোই সমুদ্রে নামা যাবে না। সমুদ্রে নামতে হবে জোয়ারের সময়।”
বাচ্চারা তখন সবাই এক সাথে প্রশ্ন করতে শুরু করল, প্রশ্নগুলো হলো এরকম:
“কেন ভাটার সময় সমুদ্রে নামা যাবে না?” “ভাটা কী?”
“কতক্ষণ ভাটা হয় কতক্ষণ জোয়ার হয়?”
“আমরা কেমন করে বুঝব কখন ভাটা কখন জোয়ার?”
“ভাটার সময় আমি যদি সমুদ্রে নামি তাহলে কী হবে?”
কাজেম আলী চাচা একটা একটা করে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল:
“ভাটার সময় সমুদ্র সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়, তাই ভাটার সময় সমুদ্রে নামলে সমুদ্র কাউকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।”
“সমুদ্রের পানি যখন নেমে যেতে থাকে সেটা হচ্ছে ভাটা। সমুদ্রের পানি যখন বাড়তে থাকে সেটা জোয়ার।”
“ছয় ঘণ্টা ভাটা এবং ছয় ঘণ্টা জোয়ার থাকে।”
“ভাটার সময় হোটেলে সামনে একটা লাল ফ্ল্যাগ টানানো থাকে, এই ফ্ল্যাগ দেখেই বোঝা যাবে এখন ভাটা না জোয়ার।”
“আমার কথা না শুনে কেউ যদি ভাটার সময় সমুদ্রে নেমে যায় তাহলে আমি তাকে টেনে শুকনায় নিয়ে আসব। তারপর জোয়ার না আসা পর্যন্ত তাকে শুকনা বালুতে ঠেসে চেপে ধরে রাখব। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সবাইকে দেখে-শুনে রাখতে।
কথা শেষ করে কাজেম আলী চাচা জিজ্ঞাসা করল, “আর কোনো প্রশ্ন?
অনেকেরই প্রশ্ন ছিল কিন্তু কাজেম আলী চাচার চেহারা দেখে কেউ আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। কাজেম আলী চাচা থমথমে গলায় বলল, “টেবিলে মেনু রাখা আছে। মেনু দেখে সবাই ঠিক করো কে কী খাবে?”
শান্ত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারব? “হ্যাঁ। যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারবে।”
সবাই তখন খাবার অর্ডার করতে শুরু করল। বাসায় যে খাবার তারা জন্মেও মুখে দিতে চায় না এই হোটেলে এসে হঠাৎ করে সেই খাবারগুলোও তাদের কাছে সুস্বাদু মনে হতে থাকে। মনে হয় সমুদ্রের বাতাসের এই গুণ।
খাওয়া শেষ করে তারা যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন তারা আবার তাদের পাশের রুমের বাবা আর মেয়েটাকে দেখতে পেল। মেয়েটা তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বাবার মুখটা পাথরের মতো শক্ত।
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মুনিয়া দাঁড়িয়ে গেল। তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল, “আপু, তুমি কাঁদছ কেন?”
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আম্মুর কাছে যাব।”
মেয়েটার কথা শুনে তার বাবা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। বাবা মেয়েটাকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মেয়েটা চুপ করে না, বলতে থাকে, “আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।”
মুনিয়া জানতে চাইল, “তোমার আম্মু কোনখানে?”
“বাসায়।”
এবারে টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাসা কোথায়?”
মেয়েটা কিছু বলার আগেই বাবা মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়, মাথাটা জোর করে নিজের ঘাড়ে চাপা দিয়ে সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে টুনিকে বলল, “ওর মা মারা গেছে। কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছে না।”
মেয়েটা যেন না শুনতে পারে বাবা সেইভাবে কথাটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু তারপরেও মেয়েটা কথাটা শুনে ফেলল, তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল, “না, আম্মু মারা যায় নাই। তুমি মিথ্যা কথা বলছ। মিথ্যা কথা বলছ।”
বাবাটা তখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা আমি মিথ্যা কথা বলছি। তোমার আম্মু মারা যায় নাই।”
“আমি আম্মুর কাছে যাব।”
“ঠিক আছে মা, আমরা আম্মুর কাছে যাব।”
“এক্ষুনি যাব। এক্ষুনি”
“ঠিক আছে মা। এক্ষুনি তো যাওয়া যাবে না প্লেনের টিকিট কিনতে হবে তারপর যাব। ঠিক আছে? এখন মা এসো কিছু একটা খাও।”
“না, আমি খাব না, খাব না।” বলে মেয়েটা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।
মুনিয়া তবু হাল ছাড়ল না। বাচ্চা মেয়েটাকে ডেকে বলল, “আমরা সমুদ্রে গোসল করতে যাচ্ছি। তুমি আসবে আমাদের সাথে?”
মেয়েটা কিছু বলল কী না শোনা গেল না। ততক্ষণে বাবাটা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে গেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এত ছোট একটা মেয়ের মা মারা গেছে মেয়েটা কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারছে না, বেচারা বাবা মেয়েটাকে কোনোভাবে শান্ত করতে পারছে না, পুরো ব্যাপারটা দেখে সবারই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।
.
হোটেল থেকে বের হয়ে যখন তারা সমুদ্রের বালুবেলায় পা দিয়েছে তখন প্রমি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বেচারি মেয়েটা, আহারে। এত ছোট? এখনই মা মারা গিয়েছে।”
মুনিয়া কাছাকাছি ছিল, সে হঠাৎ করে চিৎকার করে বলল, “না মারা যায় নাই।”
“মারা যায় নাই?”
“না।” মুনিয়া মুখে শক্ত করে বলল, “শোন নাই তোমরা মেয়েটা বলেছে তার আম্মু মারা যায় নাই?”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “তুই বলছিস তার বাবা মিথ্যা কথা বলছে?”
“হ্যাঁ।” মুনিয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
“তাহলে তার মা কই?”
মুনিয়া বলল, “বাসায়। বাবা মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”
“কেন?”
“বাবাটা খারাপ মানুষ।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “খারাপ মানুষ?”
“হ্যাঁ।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
মুনিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আমি জানি চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বাবার চোখগুলো দেখো নাই, কী রকম জানি নিষ্ঠুর।”
শান্ত শব্দ করে হাসল, বলল, “মুনিয়া, তোর মাথায় গোলমাল আছে।”
মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “না, আমার মাথায় গোলমাল নাই।”
অন্যেরা তখন মুনিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমবার নিজের আম্মু-আব্বুকে রেখে একা একা এসেছে, তারই বয়সী একজন মেয়ের আম্মু নেই সেটা সে এখন চিন্তাই করতে পারে না!
গরম বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধু টুনি চিন্তা করতে থাকে, এমন কী হতে পারে মুনিয়ার ধারণাটাই সত্যি? বাবাটা আসলেই নিজের মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে জোর করে সরিয়ে এনেছে? আসলে মা মারা যায়নি। এটা এক ধরনের কিডন্যাপ? কিন্তু নিজের বাবা কী কখনো নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে? টুনি জোর করে মাথার ভেতর থেকে চিন্তাটা দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কেন জানি সেটা দূর হলো না। মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করতে লাগল।
সমুদ্রের তীরের বালু যথেষ্ট গরম তার ওপর দিয়ে সবাই তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে পানির কাছে চলে এলো। বড় বড় সমুদ্রের ঢেউ আসছে, তার মাঝে অনেকে ঝাপাঝাপি করছে। মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “আমরা কি পানিতে নামব?”
শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “পানিতে না নামলে সমুদ্রে এসেছি কেন?” তারপর জুতো-শার্ট খুলে হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে পানির দিকে ছুটে যেতে থাকে।
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “জোয়ার কী শুরু হয়েছে?”
কাজেম আলী বলল, “হ্যাঁ। জোয়ার শুরু হয়েছে। তোমরা পানিতে নামতে পার। তোমাদের জিনিসপত্র রেখে যাও। আমি দেখব।”
সবাই তখন হইচই করে জামা-জুতো খুলে ব্যাগ রেখে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেম আলী সমুদ্রের তীরে রাখা সারি সারি বিচ চেয়ারের একটার ওপর তাদের সবার জিনিসপত্র রেখে পাশের বিচ চেয়ারে শুয়ে পড়ে এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যায়। মনে হচ্ছে এই মানুষটা ঘুমানোর মাঝে এক্সপার্ট।
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে পানির কাছে এগিয়ে যায়। বড় বড় ঢেউ এসে তীরে ভেঙ্গে পড়ছে, মুনিয়া কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সেগুলো দেখে। ঢেউগুলো এসে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ঢেউগুলো ফিরে যাবার সময় পায়ের নিচ থেকে বালু সরিয়ে নিতে থাকে, তখন কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগতে থাকে। টুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “আরো একটু বেশি পানিতে যাবি?”
মুনিয়া রাজি হলো। টুনির হাত ধরে সে সাবধানে হাঁটু পানি থেকে কোমরে পানি, কোমর পানি থেকে বুক পানিতে নেমে এল। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি বিশাল একটা ঢেউ এসে মুনিয়ার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। টুনির হাত থেকে মুনিয়ার হাত ছুটে গেল, বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সে একেবারে তীরে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল। তার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে একেবারে বিতিকিচ্ছি অবস্থা–প্রথমে মনে হলো সে বুঝি মরেই গেছে, পানি সরে যাবার পর বুঝতে পারল আসলে মরে যায় নাই। তারপরও সে একটু কেঁদে ফেলবে কি না বুঝতে পারছিল না, শেষ পর্যন্ত কাঁদল না। কিন্তু পানি থেকে সরে এসে সে বালুর মাঝে বসে রইল। টুনি টুম্পা প্রমি সবাই এসে ডাকাডাকি করল কিন্তু সে আর পানিতে নামার সাহস পেল না।
বালুর মাঝেও কত কি দেখার আছে। কত রকম ঝিনুক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটা তারা মাছ তির তির করে নড়ছে। সবচেয়ে মজার জিনিস হচ্ছে ছোট ছোট কাকড়া, ছোট ছোট গর্ত থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয়, তারপর সাবধানে বের হয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। একটু ভয় দেখালেই সবগুলো আবার ছুটে গর্তে ঢুকে যায়! কী মজা লাগে দেখতে।
মুনিয়াকে একা বসে থাকতে দেখে টুনি তার পাশে এসে বসল। দুজনে মিলে ভিজে বালু দিয়ে খেলতে থাকে। বালু দিয়ে একটা ঘর বানাল। একটা কুমির বানাল, লম্বা একটা সাপ বানাল। ঢেউ এসে এক সময় সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। পানিতে ভিজে ভিজে সবার চোখ লাল, হাতের আঙুল শুকনো কিসমিসের মতো। বিকেল হয়ে আসছে তাই একটু একটু ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। কাজেম আলী চাচা এক সময় ঘুম থেকে উঠে সবাইকে ডাকল, বলল, “উঠে এসো সবাই। হোটেলে ফিরে নাশতা করবে, তারপর আবার সূর্যাস্ত দেখতে আসব।”
‘নাশতা নাশতা, সূর্যাস্ত সূর্যাস্ত’ বলে চিৎকার করতে করতে সবাই এবারে উঠে আসতে শুরু করে।
.
ঘণ্টাখানেক পরে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে তখন সবাই আবার সমুদ্রতীরে ফিরে এলো। পুরো জোয়ার এসেছে বলে পানি এসে বালুবেলাটা প্রায় ভরে ফেলেছে। দুপুরের তুলনায় এখন মানুষ অনেক বেশি এবং সবাই মোটামুটি সেজেগুঁজে আছে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে বলে খুব বেশি মানুষ পুরোপুরি পানিতে নামেনি। কাজেম আলী চাচা আবার একটা বিচ চেয়ারে বসেছে, কিছুক্ষণ পর সে সেখানে শুয়ে গেল এবং আরো কিছুক্ষণের মাঝে তার নাক ডাকতে লাগল! এই মানুষটার ঘুমানোর ক্ষমতা রীতিমতো অসাধারণ।
সূর্যটা আস্তে আস্তে আরো নিচে নামতে থাকে, এটাকে এখন ডিমের কুসুমের মতো দেখায়। শান্ত হা করে সেটা খেয়ে ফেলছে সেরকম একটা ছবি তোলার পর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে এরকম আরো ছবি তুলতে লাগল। মুনিয়া যখন তার ছবিটা তুলছে ঠিক তখন দেখল মারা যাওয়া ছোট মেয়েটি আর তার বাবা সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছে।
মেয়েটির চেহারায় একই সাথে দুঃখ আর ভয়। মুনিয়া খুবই মিশুক মেয়ে, সে ছবি তোলা বন্ধ করে সাথে সাথে মেয়েটার কাছে ছুটে গিয়ে কথা বলতে শুরু করে “আপু! তুমি এসেছ?”
মেয়েটি কোনো কথা না বলে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মুনিয়া বলল, “আমরা সূর্যটা খেয়ে ফেলছি এরকম ছবি তুলছি। তুমি তুলবে?”
মেয়েটি এবারেও কোনো কথা বলল না।
মুনিয়া বলল, “তুমি আসবে আমাদের সাথে? চল আমরা পানির ওপর দিয়ে হাঁটি?”
মেয়েটা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বাবা সাথে সাথে মুখটা কেমন যেন শক্ত করে ফেলল। সেটা দেখে মেয়েটার মুখটাও কেমন যেন হয়ে গেল। সে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। বাবা তখন মেয়েটার হাত ধরে একটু টান দিয়ে তাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল, সবাই দেখল তার চোখটা কেমন জানি ছল ছল করছে।
বাবা আর মেয়েটা মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সবাই একসাথে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুনিয়া বলল, “তোমরা দেখেছ বাবাটা কত খারাপ?”
শাহানা বলল, “হ্যাঁ। একটু রবোট টাইপ।”
প্রমি বলল, “রবোট না, পাষণ্ড টাইপ।”
মুনিয়া বলল, “মায়ের কাছ থেকে মেয়েটাকে কেড়ে এনেছে। কত খারাপ কত নিষ্ঠুর।”
সবাই মুনিয়ার দিকে তাকাল, আগেরবার যখন মুনিয়া এই কথা বলেছে। তখন কেউ সেটাকে গুরুত্ব দেয় নাই। এবারে কেন জানি অনেকেরই মনে হলো, হতেও তো পারে।
টুনি বলল, “ইচ্ছা করলে আমরা সেটা বের করতে পারি।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল “কী বের করবি?”
“বাবা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে কি না।”
শাহানা বলল, “ডিভোর্স হলে কোর্ট অনেক সময় বাচ্চা মা’কে দিয়ে দেয়, তখন বাবারা মাঝে মাঝে বাচ্চা কিডন্যাপ করে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যায়।”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “এই বাবাটাও তাই করছে?”
টুনি বলল, “আমরা জানি না। কিন্তু বের করে ফেলা যায়।”
এবারে প্রায় সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বের করবি?”
টুনি বলল, “যদি আসলেই মা বেঁচে আছে তাহলে মা নিশ্চয়ই অনেক খোজাখুজি করছে। খুঁজতে খুঁজতে যদি এখানে চলে আসে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই ঝামেলায় পড়বে।”
“কিন্তু মা জানবে কেমন করে যে বাচ্চাটা এখানে আছে?”
“জানবে না। কিন্তু যদি বাবাটাকে জানানো হয় যে ঢাকা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসে একজন বাবা আর তার সাথে ছোট একটা মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই অনেক ঘাবড়ে যাবে।”
কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মাথা নাড়ল।
টুনি বলল, “কিন্তু আসলেই যদি মা মারা গিয়ে থাকে তাহলে বাবা ঘাবড়ে যাবে না, মনে করবে অন্য কোনো মহিলা অন্য কাউকে খুঁজছে।”
এবারেও সবাই মাথা নাড়ল, টুম্পা বলল, “টুনি আপু তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি।”
টুনি বলল, “কিন্তু খালি বুদ্ধি দিয়ে তো হবে না। বাবাটাকে এই খবরটা কে দেবে? আমরা দিলে তো ঠিক হবে না বাবাটা আমাদের দেখেছে। বড় কোনো মানুষকে খবরটা দিতে হবে।”
সবাই ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাছু বলল, “বাবাটা আমাকে তোদের সাথে দেখেছে। তা ছাড়া জেনে-শুনে এভাবে মিথ্যা কথা বলা সোজা না।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কে বলবে?”
“আমি বলব। কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনে সবাই একেবারে চমকে উঠল। বিচ চেয়ারে যেখানে কাজেম আলী চাচা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল তারা তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কাজেম আলী চাচা যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাদের কথা শুনছে তারা সেটা চিন্তাও করে নাই।
শাহানা বলল, “আপনি বলবেন?”
কাজেম আলী চাচা চোখ খুলল, “হ্যাঁ। কেসটা আমার কাছে ভালো লাগছে। কিছু একটা করা দরকার।”
“কখন বলবেন?”
“এই তো আজকেই। মানুষটাকে হোটেলে পেলেই বলব।”
টুনি বলল, “থ্যাংকু কাজেম আলী চাচা। যখন ছোট মেয়েটা সাথে নাই তখন বলতে হবে।”
“সেভাবেই বলব।”
কাজেম আলী কিছু না বলে আবার ঘুমিয়ে গেল। একজন মানুষ যে এভাবে ঘুমাতে পারে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব কথা শুনতে পারে সেটা আগে কেউ কখনো দেখে নাই।
.
সন্ধ্যেবেলা বাবা ছোট মেয়েটাকে নিজের রুমে রেখে নিচে লবিতে এসে কাউন্টারে কিছু একটা বলে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন কাজেম আলী তাকে থামাল, বলল, “ভাই সাহেব, আপনার সাথে একটা ছোট মেয়ে আছে না?”
“একজন মা এসে তার মেয়ে আর মেয়ের বাবাকে খুঁজছে।”
মানুষটা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, দূরে সোফায় টুনি মুনিয়াকে নিয়ে বসেছিল, তারা কথা শুনতে পাচ্ছিল না কিন্তু মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল।
মানুষটার চেহারা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কাঁপা গলায় বলল, “মহিলা? আমাকে খুঁজছে?”
“আপনাকেই খুঁজছে কী না জানি না, কিন্তু আপনার সাথে যেহেতু ছোট একটা মেয়ে আছে তাই আপনাকে জানালাম।”
“কোথায়? এখন কোথায় সেই মহিলা?”
“বিচে দেখেছি। এখন কোথায় সেটা তো জানি না।” “কী রকম মহিলা?
কাজেম আলী হাসার ভঙ্গি করল, বলল, “সেটা তো বলতে পারব না–তবে মহিলাকে খুব দুশ্চিন্তার মাঝে আছেন মনে হল। আপনার ওয়াইফ নাকি?”
“আ-আ-আমার?” মানুষটা কথাটা শেষ করল না।
একটু দূরে সোফায় বসে থাকা টুনি মুনিয়াকে ফিস ফিস করে বলল, “মুনিয়া, তুই ঠিকই ধরেছিস। বাবাটা দুই নম্বুরী। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে।”
“এখন? এখন কী করব?”
“বাবাটাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমরা বুঝে গেছি।”
“কীভাবে করবে সেটা?”
“আয় আমার সাথে।” টুনি উঠে দাঁড়াল তারপর হেঁটে হেঁটে কাজেম আলী চাচা আর মানুষটাকে কাছে গিয়ে বলল, “কাজেম আলী চাচা–”
কাজেম আলী চাচা ঘুরে তাকাল, একটু অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার?”
“মনে আছে একটা মা তার মেয়ে আর বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল?”
কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে কাজেম আলী চাচা বলল, “হ্যাঁ। তার কী হয়েছে?”
“মা তার মেয়ে আর হাজব্যান্ডকে খুঁজে পেয়েছে।”
“খুঁজে পেয়েছে?”
“জী। একটু আগে দেখা হয়েছে। মেয়েটার আব্বুর মোবাইল হারিয়ে গেছে তো সেইজন্যে ফোন করতে পারছিল না।”
কাজেম আলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন হঠাৎ করে জীবন ফিরে পেল। বলল, “পেয়েছে? খুঁজে পেয়েছে?”
“জী।” বলে টুনি মুনিয়ার হাত ধরে টেনে বলল, “আয় মুনিয়া আমরা যাই।”
মানুষটার রক্তশূন্য মুখে ধীরে ধীরে রক্ত ফিরে আসতে থাকে, হাসি হাসি মুখে বলল, “এই সিজনে কক্সবাজারে এত মানুষ আসে যে সবসময় একজন আরেকজনকে হারিয়ে ফেলে।”
টুনি কিছু বলল না, মুনিয়াকে নিয়ে হোটেলের লিফটে ঢুকে গেল।
.
রাত্রে ডিনারের টেবিলে কাজেম আলী সবাইকে একটা খবর দিল। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে বাবা পরদিন হোটেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাত্রে লবিতে একটা মানুষের সাথে বাবাটাকে পাসপোর্ট নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। কাজেই মনে হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
মুনিয়া বলল, “না, যেতে দেব না।”
অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।”
শান্ত বলল, “পুলিশে খবর দেই?”
ছোটাচ্চু বলল, “পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে পুলিশকে বললে, অন্য ঝামেলা হতে পারে।”
“তাহলে? তাহলে কী করব?”
টুনি হাসিমুখে বলল, “কিডন্যাপ করা মেয়েটাকে আমরা কিডন্যাপ করব।”
সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, “কীভাবে?”
টুনি বলল, “কয়েকটা উপায় আছে। একটা হতে পারে এরকম–”
টুনি তখন তার প্ল্যানটা বলতে থাকে, অন্যেরা মন দিয়ে শুনে।
.
সকাল দশটার দিকে হোটেলের ফোন দিয়ে মানুষটার কাছে শান্ত ফোন করল। শান্ত ফোনের ওপর এক টুকরো কাপড় রেখে কীভাবে জানি গলা মোেটা করে কথা বলতে পারে।
অন্যপাশে ছোট মেয়েটার বাবা ফোন ধরল, বলল, “হ্যালো।”
“ইমতিয়াজ সাহেব?” (চেক ইন কাউন্টার থেকে কাজেম আলী চাচা মানুষটার নাম জোগার করে দিয়েছেন।)
“কথা বলছি।”
“আপনি একটু লবিতে আসতে পারবেন?”
“আমি? লবিতে? কেন?”
“আপনার মেয়ের পাসপোটটা নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। ভিসার তারিখ নিয়ে একটা সমস্যা আছে, দুই মিনিটের জন্য নিচে আসেন।”
“কী সমস্যা?”
“নিচে আসেন সামনাসামনি বলি।”
“আসছি। পাসপোর্ট নিয়ে আসব?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিয়ে আসেন।”
দুই মিনিটের ভেতর মানুষটা পাসপোর্ট নিয়ে নিচে নেমে গেল। সাথে সাথে টুনি মুনিয়াকে নিয়ে মানুষটার রুমের সামনে গিয়ে দরজার টোকা দিল।
ভেতর থেকে বাচ্চা মেয়েটার গলার স্বর শোনা গেল? “কে?”
“আমরা। দরজা খোলো। তাড়াতাড়ি।”
মেয়েটা দরজা খুলল, কেমন যেন ভয় ভয় চোখে তাকাল তাদের দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”
“পরে বলব। এখন আস আমাদের সাথে। “কোথায়?”
“আমাদের রুমে।”
“কেন?”
“তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাব।”
“সত্যি?”
টুনি বলল, “সত্যি।”
“দাঁড়াও জামাটা বদলে আসি।”
টুনি বলল, “না, না, কিছু বদলাতে হবে না। এইভাবে চলে এসো।”
টুনি মেয়েটার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে প্লাস্টিকের কার্ড ঢোকানোর সুটের মাঝে এক টুকরো টিস্যু ভাঁজ করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। মানুষটা ফিরে এসে তার ঘরটা সহজে খুলতে পারবে না। আগে খিমচে খিমচে টিস্যুগুলো বের করতে হবে।
মুনিয়া মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিতে থাকে। টুনি তাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। ভেতর অন্য সবাই অপেক্ষা করছে, ঢোকা মাত্র তারা দরজা বন্ধ করে ফেলল। শাহানার হাতে একটা কাঁচি, সে মেয়েটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী আপু?”
“রিমঝিম।”
“রিমঝিম কী সুন্দর নাম! আমরা তোমার চেহারাটা বদলে দিই, যেন তোমাকে তোমার আব্বু চিনতে না পারে।”
রিমঝিম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বদলাবে? আমার আম্মু যদি। আমাকে না চিনে?”
শাহানা হাসল, বলল, “আম্মুরা সব সময় তার ছেলে-মেয়েদের চিনতে পারে।”
টুনি দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রিমঝিমকে চুপ করতে বলল, তার আব্বু ফিরে আসছে।
নিচে কেউ নাই, তাই মানুষটা খুবই বিরক্ত মুখে উপরে উঠে এসেছে। দরজা খোলার জন্য পকেট থেকে প্রাস্টিকের কার্ডের চাবিটা বের করে স্লটে ঢোকানোর চেষ্টা করল, কার্ডটা ভেতরে পুরোপুরি ঢুকল না তাই দরজটাটা খুলল না। মানুষটা এবারে দরজাতে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “রিমঝিম! রিমঝিম!”
ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। মানুষটার চেহারায় কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ল। সে আরো কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিচে নেমে যায়।
এদিকে ঘরের ভেতরে শাহানা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে রিমঝিমের চুল কেটে তাকে ছেলের মতো বানিয়ে ফেলল। তারপর তার ফ্রক বদলে একটা শার্ট আর প্যান্ট পরিয়ে দিল। পায়ে টেনিস শু। চেহারাটায় আরো পরিবর্তন আনার জন্য তখন টুনির চশমাটা পরিয়ে দিল। চশমাটা একটু ঢলঢলে হলো কিন্তু চেহারাটার মাঝে পরিবর্তনটা ঠিকই এলো। ঘরের মাঝে একটু ফুটবল ছিল, ফুটবলটা রিমঝিমের হাতে দিয়ে সবাই তাকে পরীক্ষা করল। তাকে দেখে এখন চেনার কোনো উপায় নেই, খুব ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ তাকে চিনতে পারবে না।
টুনি দরজা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ভেতরে তাকিয়ে বলল, “এখন কেউ নেই। রিমঝিম, চলো এখান থেকে বের হয়ে যাই।”
রিমঝিম ভয়ে ভয়ে বলল, “আবু যদি দেখে ফেলে?”
“দেখলেও তোমাকে চিনবেন না। তুমি শুধু কোনো কথা বলো না।”
“ভয় করে।” “কোনো ভয় নাই। করিডরে কেউ নাই। এসো আমরা যাই।”
শাহানা বলল, “শুধু ছোটদের নিয়ে যা টুনি।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর মুনিয়া, টুম্পা আর রিমঝিমকে নিয়ে টুনি বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে মাত্র দুই পা গিয়েছে ঠিক তখন লিফটের দরজা খুলে গেল আর লিফটের ভেতর থেকে রিমঝিমের আব্বু বের হয়ে এলো। সাথে হোটেলের একজন মানুষ। দুজন একেবারে রিমঝিমের মুখোমুখি।
রিমঝিম ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল, সে আর নড়তে পারছে না।
টুনি তখন তার পেছন ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল, চল। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? টুর্নামেন্ট শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে।”
রিমঝিমের আব্বু ছোট দলটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়, সাথের মানুষটাকে বলল, “আমার রুমের তালা খুলতে পারছি না–মেয়েটাও ভেতর থেকে কোনো কথা বলে না। কী যে হয়েছে।”
রিমঝিমের আব্বু, রিমঝিমকে চিনতে পারেনি।
হোটেলের মানুষটা বলল, “দেখছি। আমি দেখছি।”
টুনি অন্য তিনজনকে নিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়াল। রিমঝিমের আব্বু আবার মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাল। এখন রিমঝিমকে পেছন থেকে দেখছে, চিনতে পারার কথা না।
লিফটের বোম টিপে চারজন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় লিফটটা আসতে বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লিফট এসে থামল, দরজা খুলল। চারজন শান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল তারপর দরজাটা বন্ধ হতেই সবাই একসাথে আনন্দে চিৎকার করে উঠে। রিমঝিমকে তার আব্বু আর ধরতে পারবে না।
লিফট থেকে বের হয়ে তারা ছুটতে ছুটতে সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে।
.
এদিকে অনেক কষ্ট করে রিমঝিমের আব্বুর রুমটা খোলা হলো। ভেতরে ঢুকে মানুষটা চারিদিকে তাকাল, বাথরুমের ভেতর উঁকি দিল, তারপর বলল, “আমার মেয়ে কোথায়?”
একজন মানুষের ছোট একটি মেয়ে যদি হারিয়ে যায় তাহলে তার যেরকম অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা, মানুষটি সেরকম অস্থির হলো না। কেমন যেন রাগী গলায় বলল, “মেয়েটিকে কে নিয়ে গেল?”
হোটেলের মানুষটা বলল, “নিচে চলেন, সিসি ক্যামেরাতে দেখি। হোটেলের বাইরে গেলে আমরা দেখে ফেলব।”
গত আধা ঘণ্টা সময়ে কারা কারা হোটেলে ঢুকছে কারা কারা বের হয়েছে। সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো কিন্তু রিমঝিমের কোনো হদিস নেই। হোটেলের মানুষটা অবাক হয়ে দেখল, এরকম অবস্থায় মানুষটার দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মানুষট দুশ্চিন্তিত না হয়ে আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠছে। রেগে উঠছে কেন?
সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় বাচ্চারা ছোটাচ্চুটি করে খেলছে। টুনির চশমা টুনিকে ফেরত দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিমঝিমের মনটা ভালো হয়েছে। তার আব্বু হঠাৎ করে এখানে চলে আসবে না কাজেই সে এখন কথাবার্তাও বলছে। শাহানা যেরকম বলেছিল তাই ঘটেছে। রিমঝিমের আম্মু আর আব্বুর মাঝে ডিভোর্স হয়ে গেছে, রিমঝিম তার আম্মুর সাথে থাকে। তার আব্বুর সেটা নিয়ে খুব রাগ। আম্মুকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকক না মালদ্বীপ কোথায় জানি যাবে।
ঠিক এরকম সময় দেখা গেল কাজেম আলী চাচা বালুতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। তার পেছনে শাড়ি পরা একজন ভদ্রমহিলা, উদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে হেঁটে আসছেন।
বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে রিমঝিম ‘আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করে মহিলার দিকে ছুটে যায়। মা বালুতে বসে দুই হাত বাড়িয়ে রাখলেন আর রিমঝিম ছুটতে ছুটতে তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার মেয়েটিকে এখন ছেলের মতো দেখাচ্ছে কিন্তু তার পরেও তার মায়ের চিনতে এতটুকু দেরি হলো না।
সবাই রিমঝিম আর তার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। টুনি বলল, “আপনি কেমন করে খবর পেলেন? এত তাড়াতাড়ি কেমন করে চলে এলেন?”
“আমি তো জানি না! একজন আমার বাসায় একটা প্লেনের টিকিট নিয়ে গেছে। বলেছে আমার মেয়েকে পাওয়া গেছে, এক্ষুনি আসতে হবে”
বাই কাজেম আলী চাচার দিকে তাকাল। কাজেম আলী চাচা বলল, “হ্যাঁ। আমি পাঠিয়েছি।”
“আপনি কেমন করে খুঁজে বের করলেন।”
“সবগুলো থানায় খোঁজ নিয়েছি, মেয়ে হারিয়ে গেছে এরকম জিডি আছে কী না। মোহাম্মদপুর থানায় পেয়ে গেলাম, সেখান থেকে ঠিকানা বের করে ম্যাডামকে খুঁজে বের করেছি। স্যারকে বলতেই স্যার টিকিটের ব্যবস্থা করলেন। আমি এখানে থানায় জানিয়ে দিলাম। খুবই সোজা।”
টুনি কাজেম আলী চাচাকে বলল, “আপনার নামটা একেবারে সঠিক।”
“মানে?”
“কাজের মানুষ–তাই নাম কাজেম আলী।”
কাজেম আলী চাচা একটু হাসল। তারপর ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, হোটেলে আপনার একটা রুম বুক করে রাখা আছে। ছয়তলার ছয় শ বারো। হোটেলের বিল নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমাদের স্যার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”
“সে কী? আমার হোটেলের বিল আমি দিতে পারব”
“অবশ্যই পারবেন। কিন্তু স্যার দিতে চাইছেন। এই বাচ্চাদের মাঝে বড় বড় ডিটেকটিভ আছে, স্যার তাদের সবাইকে নিয়ে এসেছেন। তাদের মাঝে রিমঝিমকেও ঢোকানো হয়েছে। রিমঝিমের গার্জিয়ান হিসেবে আপনি।”
ভদ্রমহিলা আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কাজেম আলী চাচা কোনো সুযোগ দিল না। বড় একটা হাই তুলে কাছাকাছি একটা বিচ চেয়ারের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে নেই।”
সবাই দেখল, কাজেম আলী চাচা একটা বিচ চেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই তার নাক ডাকতে থাকে।
টুম্পা বলল, “কাজেম আলী চাচার নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল ঘুমা ঘুমা আলী।”
টুনি বলল, “ঠিকই বলেছিস।”
অন্যেরাও তখন মাথা নাড়ল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকাল।
রিমঝিমের আম্মু রিমঝিমকে বুকে চেপে ধরে বালুতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে হাতটা একটু আলগা করলেই রিমঝিম বুঝি আবার হারিয়ে যাবে, তাই কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।
কিছুতেই না।
গুটলু
দাদি (কিংবা নানি) বসে বসে টেলিভিশন দেখছেন তখন তার টেলিফোনটা বাজল। প্রথম দুটো রিং দাদি খেয়াল করলেন না, তৃতীয় রিং শুনে ফোনটা খুঁজতে শুরু করলেন, খুঁজে খুঁজে বের করে টেলিফোনটা ধরতে ধরতে লাইন কেটে গেল। এটি অবশ্যি নতুন কিছু না, দাদি (কিংবা নানি) কখনোই একবারে ফোন ধরতে পারেন না। কমপক্ষে দুইবার চেষ্টা করতে হয়। টেলিফোনটা ধরার জন্য কোন বোতামটা টিপতে হয় সেটাও তার মনে থাকে না তাই বেশির ভাগ সময় ফোন ধরতে গিয়ে লাইন কেটে দেন।
ফোনটা খুঁজে পেয়ে তার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন, কে তাকে ফোন করার চেষ্টা করেছে পড়ার চেষ্টা করলেন। দাদি স্ক্রিনটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন না। কোনো কিছু ভালো করে দেখতে হলে সবাই সেটা চোখের কাছে আনে, দাদির বেলায় সেটা উল্টো। দাদি সেটাকে যতদূর সম্ভব দূরে নিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এবারেও সেভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন তখন টুম্পা বলল, “নানি, তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। আমাকে দাও, আমি পড়ে দিই।”
নানি তখন টেলিফোনটা টুম্পার হাতে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, দেখ দেখি কে টেলিফোন করেছে। মানুষের কোনো ধৈর্য নেই, ফোনটা ধরার আগেই লাইনটা কেটে দেয়।”
টুম্পা বলল, “না নানি। তুমি ফোন ধরতে এত দেরি করো যে লাইন কেটে যায়।”
“হয়েছে–আমাকে শিখতে হবে না। কে ফোন করেছে দেখ।”
টুম্পা খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “ঠিক বোঝা যাচ্ছে না নানি। মনে হয় লেখা দুষ্টু ছেলের মা
“দুষ্টু ছেলের মা? সর্বনাশ! দুষ্টু ছেলের মা কেন ফোন করছে? চলে আসবে তো?”
দুষ্টু ছেলের মাটি কে, সে ফোন করলে কেন সর্বনাশ, চলে আসলে কী হবে টুম্পা কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু তখন আবার টেলিফোন বেজে উঠল, দুষ্টু ছেলের মা আবার ফোন করছে। টুম্পা তাড়াতাড়ি ফোনটা তার নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও নানি! সর্বনাশ হয়ে গেছে। দুষ্টু ছেলের মা আবার ফোন করেছে।”
নানি ফোনটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভয়ে ভয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা ধরলেন, তারপর ভয়ে ভয়ে বললেন, “হ্যালো।”
দুষ্টু ছেলের মা মানুষটি কে টুম্পা জানে না কিন্তু তার গলার স্বরে যথেষ্ট জোর, টুম্পা কাছে বসে থেকেই তার কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। দুষ্ট ছেলের মা বলল, “চাচি! কেমন আছেন? কতদিন আপনার সাথে যোগাযোগ নাই।”
নানি ভয়ে ভয়ে বললেন, “কেন ওই যে চন্দনের বিয়েতে দেখা হলো–”বিয়েতে দেখা হলে ভিড়ের মাঝে কী কথা বলা যায়?”
নানি দুর্বল গলায় বললেন, “ইয়ে তা মানে আজকাল সবাই যেরকম ব্যস্ত এইভাবেই তো কথা বলতে হবে!”
দুষ্টু ছেলের মা তেজি গলায় বলল, “না, না চাচি, আমি এসে ভালো করে কথা বলতে চাই।”
নানি মিনমিন করে শোনা যায় না প্রায় সেইভাবে বললেন, “ঠিক আছে, এসো একবার—”
অন্যপাশ থেকে বলল, “আমার দেবরের বিয়ে। বিয়ের কার্ড দিতে আসব।”
নানি প্রায় হা হা করে উঠে বললেন, “আরে আজকাল কী আর কেউ কার্ড দিতে বাসায় আসে? কবে কোথায় বিয়ে ফোনে বলে দাও তাহলেই হবে! আমি চলে আসব।”
“না না না চাচি কী বলেন আপনি? আপনাকে নিজের হাতে কার্ড না দিলে কাকে দেব? আমি নিজে এসে দিয়ে যাব।”
নানি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না, না–তোমার এত কষ্ট করার কোনো দরকার নাই। তুমি কার্ডটা কুরিয়ার করে দাও। আমি পেয়ে যাব। আজকাল সবাই তাই করে।”
“সবাই করে দেখে আমিও করব? আপনার সাথে? কখনো না।”
“নানি হাল ছেড়ে দিয়ে দুর্বল গলায় বললেন, ঠিক আছে।”
“তা ছাড়া আপনি কত দিন গুটলুকে দেখেন নাই।”
নানি কেমন জানি আতকে উঠলেন, “শুটলু?”
“হ্যাঁ। গুটলু মনে নাই আপনার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। খুব ভালো করে মনে আছে।”
“একটু বেশি চঞ্চল হয়েছে। কিন্তু এই বয়সের বাচ্চারাতো একটু চঞ্চল হবেই। তাই না?”
নানি শুকনো মুখে ঢোক গিললেন। বললেন, “হ্যাঁ। একটু তো হবেই।”
“আমি কী ভাবছি জানেন চাচি?”
“কী ভাবছ?”
“গুটলুকে আপনার কাছে রেখে আমি এই এলাকায় সব বাসায় কার্ড দিয়ে ফেলি।”
নানি প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “না। না; আমার কাছে রেখো না। আমি ছোট বাচ্চাদের দেখে-শুনে রাখতে পারি না। বয়স হয়ে গেছে তো”
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মহিলাটি হা করে হাসির মতো শব্দ করে বলল, “কী বলছেন চাচি? আপনার বয়স হয়ে গেছে? আপনি হচ্ছেন চির তরুণ! আপনার বয়স হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব?”
“না মানে আজকাল আর ছোট বাচ্চাদের সামলাতে পারি না।”
“আপনাকে সামলাতে হবে না। আপনার বাসায় আরো বাচ্চা-কাচ্চা আছে। গুটুল ওদের সাথে খেলবে।” মহিলা হঠাৎ গলার সর পাল্টে বলল, “বুঝলেন চাচি, আপনার কাছে রেখে যেতে চাই তার কারণ আপনি বাচ্চাদের আদর করেন–আজকাল কী হয়েছে কে জানে, গুটলুকে নিয়ে যাব শুনেই একজন বলে বসল আসার দরকার নাই। চিন্তা করতে পারেন?”
নানি দুর্বল গলায় বললেন, “না। পারি না।”
মহিলা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিল, নানি সারাক্ষণ শুধু হু হাঁ বলে গেলেন। টেলিফোনে কথা শেষ করার পর নানি বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল এইমাত্র কোনো একটা মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন।
টুম্পা কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন টুনি এসে ঢুকল, নানিকে একনজর দেখে বলল, “নানি তোমার কী হয়েছে?”
নানি উত্তর দেওয়ার আগেই টুম্পা বলল, “গুটলুর মা ফোন করে বলেছে। গুটলুকে সারা দিনের জন্য নানির কাছে রেখে যাবে।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “গুটলু? মানে সেই ভয়ংকর দুষ্টু ছেলে?”
টুম্পা বলল, “তুমি গুটলুকে চেন?”
“উঁহু। শুধু গল্প শুনেছি।”
“আমাদের বাসায় কখনো এসেছে?”
“না। এখন পর্যন্ত যে যে বাসায় গেছে সেই বাসাগুলো ধসে গিয়েছে। তাই না দাদি?”
দাদি (কিংবা নানি) দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন।
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “গুটলু কী করে?”
“একজনের বাসায় ড্রইংরুমের কার্পেটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। “সর্বনাশ!”
“আরেকজনের বাসায় তাদের পোষা বিড়ালটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে গরম করার চেষ্টা করেছিল।”
টুম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, “হায় খোদা।”
“আরেকবার একজনের বাসায় গিয়ে তাদের ল্যাপটপের ওপর কোক ঢেলে দিয়েছিল।”
“কেন?”
“কোকে নাকি ঝাজ ছিল না, সেইজন্যে।”
“কী সর্বনাশ! তারপর–”
“তারপর আর কী! ল্যাপটপটা শেষ।”
টুম্পা বলল, “তার মানে গুটলু খালি দুষ্টু না অনেক ডেঞ্জারাস।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল “হ্যাঁ অনেক ডেঞ্জারাস। পকেটে চুইংগাম থাকে, সেইটা চাবায় তারপর সেটা এখানে সেখানে লাগিয়ে দেয়। ফেবারিট জায়গা মানুষের চুল-দাড়ি, মোছ।”
“হায় হায়।”
“একটা বাসায় গুটলু গিয়েছিল পরের দিন সেই বাসার প্রত্যেকটা মানুষের কারো এক মাথায় চুল নাই কারো একদিকের মোছ নাই কারো দাড়ি অর্ধেক নাই–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। কোনো বাসায় গিয়ে যদি মার্কার পায় তাহলেই গেল।”
“কেন?” “সেই মার্কার দিয়ে দেওয়ালে ছবি আঁকে। স্লোগান লিখে।”
“কিসের ছবি? কিসের স্লোগান?”
“কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং। আজেবাজে স্লোগান।”
টুম্পা খানিকক্ষণ মুখ হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই ছেলেটা আমাদের বাসায় আসবে? সারাদিন থাকবে?”
টুনি বলল, “সেটা তো জানি না। তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, সত্যি নাকি?”
দাদি দুর্বল গলায় বললেন, “তাইতো বলল। শুনে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ঝুমুকে ডেকে বলত বুকের মাঝে একটু তেল মালিশ করে দিতে। কেমন যেন লাগছে।”
টুনি দাদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “দাদি। তুমি চিন্তা করো না। তোমার গুটলুকে আমরা সামলাব।”
“ঐ ছেলেকে তোরা কীভাবে সামলাবি? এই ছেলে এখন পর্যন্ত যে বাসায় গেছে সেই বাসায় হয় আগুন ধরেছে, না হয় জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে না হয় কারো শরীর কেটেকুটে গেছে, না হয় বাসা পানিতে ভেসে গেছে–তোরা ওই বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবি?”
“টুনি বলল, দেখি চেষ্টা করে সামলানো যায় কিনা। দাদি, তুমি এখন আর কাউকে বলো না বাচ্চাটা দুষ্টু।”
“বলব না?”
“না দাদি শুধু শুধু সবাইকে আগে থেকে ভয় দেখিয়ে কী লাভ?”
দাদি (কিংবা নানি) দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে তুই যদি তাই চাস তাহলে বলব না। আমি আরো ভাবছিলাম আমার পরিচিত একজন পুলিশের এসআই আছে সাথে সবসময় পিস্তল থাকে, তাকে বলে রাখতাম।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু! পরে গুটলু ঐ পিস্তল দিয়ে কিছু একটা করে ফেলবে।”
দাদি মাথা নাড়লেন, বললেন, “সেটা অবশ্যি তুই খুব একটা ভুল বলিস নাই! গুটলুকে কোনো বিশ্বাস নাই।”
টুনি তখন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা, তুইও কাউকে বলিস না। এই বাসায় খালি আমরা তিনজন জানব যে গুটলু হচ্ছে সাংঘাতিক একটা দুষ্টু ছেলে।”
টুম্পা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে টুনিকে, সে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে টুনি আপু। বলব না।”
“আয় তাহলে আমরা একটা প্ল্যান করি, দেখি কীভাবে গুটলুকে সামলানো যায়।”
টুম্পা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, “চল টুনি আপু।”
.
গুটলুর মা গুটলুকে নিয়ে এলো পরের দিন দুপুর বেলা। দাদির (কিংবা নানির) কাছে প্রায়ই এরকম অনেকে দেখা করতে আসে। কাজেই গুটলুকে নিয়ে গুটলুর মায়ের দেখা করতে আসা যে বিশেষ কোনো ঘটনা হতে পারে সেটা কেউ টের পেল না। বাইরের ঘরের দরজা খুলে টুনি গুটলু আর গুটলুর মা’কে দাদির কাছে নিয়ে এলো। গুটলু টুনির বয়সী কিংবা তার থেকে এক-দুই বছর ছোট হতে পারে। মায়া কাড়া চেহারা, মাথায় এলোমেলো চুল দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এই ছেলেটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেগুলোর একজন। চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন নিষ্পাপ সরল একটা ভাব, তবে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ মাঝে মাঝে ঝিক করে ভেতর থেকে দুষ্টুমিটা উঁকি দেয়।
গুটলুর মা দাদির পায়ে ধরে সালাম করে গুটলুকে বলল, “গুটলু, চাচিকে সালাম কর।”
দাদি ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “না, না, না। সালাম করতে হবে না। সালাম করতে হবে না। আমি এমনিতেই দোয়া করে দেব।”
গুটলু তখন সালাম না করে একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। টুনি দাদির পায়ের কাছে বসে চোখের কোনা দিয়ে গুটলুকে লক্ষ করে। টুম্পা ধারে কাছে নেই। টুনি জানে যখন সময় হবে তখন চলে আসবে।
গুটলুর মা বেশ কিছুক্ষণ দাদির (কিংবা নানির) সাথে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করল। গল্পের বিষয়বস্তু খুবই একঘেঁয়ে। অমুক কেমন আছে তমুক কেমন আছে। অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে তমুকের ছেলের বিয়ে ভেঙে গেছে, অমুক মারা গেছে তমুক মারা যাবে যাবে অবস্থা–এরকম গল্প। পুরো সময়টাতে গুটলু পিঠ সোজা করে বসে রইল, টুনিও দাদির পায়ের কাছে বসে রইল। গুটলুর মা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সে গুটলুকে এখান থেকে সরাতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত গুটলুর মা উঠল, গুটলুকে রেখে দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। অনেকগুলো বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, এই এলাকায় সবার বাসায় সেগুলো দিয়ে গুটলুকে নিতে আসবে-টানা কয়েক ঘণ্টার ধাক্কা।
টুনি উঠে দাঁড়াল, গুটলুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী আমার সাথে আসবে?”
গুটলু মাথা নেড়ে টুনির সাথে সাথে ঘর থেকে বের হলো। টুনি ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র কোথা থেকে জানি টুম্পা পা টিপে টিপে এসে হাজির হলো। টুনির কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তিন তলায়।”
টুনিও এদিক-সেদিক তাকিয়ে সতর্ক গলায় বলল, “ঠিক তো?”
“হ্যাঁ ঠিক। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে এসেছি।”
“তোকে দেখেছে?”
“না দেখে নাই।”
“দোতলায় যাওয়া যাবে?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “এখন যাওয়া যাবে।”
“তাহলে আয় যাই।”
টুনি গুটলুর দিকে তাকাল, বলল “এসো। কোনো শব্দ করো না।”
গুটলু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“কাল রাতে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে।“
“কে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে?”
টুনি ঝট করে ঘুরে গুটলুর দিকে তাকাল। বলল, “তুমি জানো না?”
“কী জানি না?”
“আমার একজন কাজিন যে ম্যানিয়াক? চেইন দিয়ে অন্ধকারে ঘরের ভেতর বেঁধে রাখতে হয়? টোটাল সাইকোটিকা ডিসঅর্ডার?”
গুটলু মাথা নাড়ল, বলল, সে জানে না।
টুনি গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “এই জন্য আমি খুবই অবাক হয়েছি যখন দেখেছি তুমি আর তোমার আম্মু আজকে আমাদের বাসায় এসেছ। দাদি তোমাদের নিষেধ করে নাই?”
টুম্পা বলল, “টুনি আপু, দাদিকে তো বলে নাই। দাদির হার্টের সমস্যা সেইজন্যে খারাপ কিছু হলে এখন দাদিকে কেউ কিছু বলে না। শান্ত ভাইয়া যে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে দাদিকে কেউ বলে নাই।”
টুনি বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “সেইজন্যে দাদি তোমার আম্মুকে কিছু বলে নাই। অবস্থা খুব ডেঞ্জারাস হতে পারে।”
গুটলু শুকনো মুখে, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ডেঞ্জারাস?”
টুনি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্লাড গ্রুপ কী?”
গুটলু বলল, “ব্লাড গ্রুপ?”
“হ্যাঁ।”
“জানি না। কেন?”
“কখন কী দরকার হয় কে বলতে পারে। এর আগে তানজিম বেঁচে গেল কারণ তার রক্তের গ্রুপ জানত। হাসপাতালে নিয়ে তাকে সাথে সাথে রক্ত দেওয়া গেছে।”
গুটলু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তানজিম কে?”
“আগেরবার যখন এরকম অবস্থা হয়েছিল তখন যে ভাইয়া এসেছিল। এর পরে থেকে সবসময় বাসার সামনে একটা অ্যাম্বুল্যান্স রেডি রাখা হয়।” টুনি টুম্পাকে বলল, টুম্পা দেখ দেখি অ্যাম্বুল্যান্সটা আছে কী না।”
টুম্পা জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “না, দেখি না তো।”
টুনি বলল, “কী মুশকিল।”
টুম্পা বলল, “মনে হয় ওষুধ খাওয়ানো গিয়েছে সেই জন্যে দেরি করছে।”
টুনি বলল, “তা ঠিক। পুরো ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়ানো গেছে।”
গুটলু জিজ্ঞেস করল, “এইটা খেলে কী হয়?”
“ব্রেনের ভায়োলেন্সটা কন্ট্রোলের মাঝে আসে। তখন একেবারে নরমাল মানুষের মতো কথাবার্তা বলে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“নরমাল মানুষের মতো কথা বলে তার মানে কিন্তু নরমাল তা না। যেকোনো সময় ক্ষেপে উঠে। তানজিম ভাইয়ার–”
টুনি কথা বন্ধ করে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল।
টুম্পা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বলো না টুনি আপু। প্লিজ বলো না। আমার ভয় করে।”
টুনি পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, “আয় যাই।”
“চল।”
গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে টুনি আর টুম্পার পেছনে পেছনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যেতে থাকল। একটু শব্দ হলেই গুটল চমকে উঠছিল। দোতলায়। পৌঁছে পা টিপে টিপে তারা টুনির ঘরে ঢুকল। ঘরের দরজা বন্ধ করে গুটলু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “এখন তো আর ঢুকতে পারবে না। তাই না?”
টুম্পা হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “ঢুকতে পারবে না? শান্ত ভাইয়ার গায়ে অসম্ভব জোর। এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে ফেলবে।”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “দরজা ভাঙা তো পরের ব্যাপার। যদি দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা না খুলি তাহলেই খেপে উঠবে। আমাদের একেবারে নরমাল ব্যবহার করতে হবে, যেন কিছুই হয় নাই। সবাই একেবারে নরমাল ব্যবহার করবে। তুমি দেখলে বুঝতেই পারবে না যে শান্ত ভাইয়া সাইকোটিক ম্যানিয়াক। ভয়ংকর উন্মাদ চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। কথা শেষ করে টুনি শিউরে উঠল, টুনিকে দেখে টুম্পা আর টুম্পাকে দেখে গুটলু আরো জোরে শিউরে উঠল।
টুনির ঘরে গুটলু একটা চেয়ারে বসল। আর টুম্পা টুনির বিছানায় পা তুলে বসল। টুনির ঘরটা টুনি সব সময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, ঘরের ভেতরে বেশির ভাগই হচ্ছে বই কাজেই সাজিয়ে রাখা সোজা। গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না একটা বাসায় এসে এরকম একটা বিপদে পড়বে।
টুনি বলল, “তুমি চাইলে একটা বই পড়তে পারো। আমার ঘরে অনেক বই। সব রকম বই আছে–”
গুটলু বলল, “আমি বই পড়ি না।”
টুনি প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “বই পড় না? কোনো বই পড় না?”
“খালি পাঠ্য বই পড়ি।”
“খালি পাঠ্য বই?”
“হ্যাঁ। সেইটাও পড়তে চাই না। যখন জোর করে তখন পড়ি।”
টুনি বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ গুটলুর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
“ক্লাস সিক্স।”
“গুড। আমার কাছে ক্লাস সিক্সের একটা অঙ্ক বই আছে। তুমি বসে বসে অঙ্ক কর।”
গুটলু কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “বসে বসে অঙ্ক করব?”
“হ্যাঁ। সময়টা তো কাটাতে হবে। অঙ্ক করলে সময় কেটে যায়।” বলে টুনি কয়েকটা কাগজ একটা বলপয়েন্ট কলম, আর ক্লাস সিক্সের অঙ্ক বইটা গুটলুর দিকে এগিয়ে দিল। মানুষ যেরকম করে বিষাক্ত সাপ কিংবা বিছার দিকে তাকায় গুটলু সেভাবে অঙ্ক বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি বলল, “যদি অঙ্ক করতে না চাও তাহলে তুমি এই কাগজগুলোতে একটি রচনা লিখতে পার।”
“রচনা?”
“হ্যাঁ। সৎ জীবন এবং মহৎ জীবনের ওপর রচনা।”
গুটলু এমনভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে খুব খারাপ একটা কথা বলে তাকে গালি দিয়েছে।
টুনি বলল, “আর যদি কিছু করতে না চাও তাহলে চুপচাপ বসে থাকতে পার।”
“আমি চুপচাপ বসে থাকি।”
“ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণ পর টুম্পা বলল, “আমি বাইরে যাই, গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”
টুনি বলল, “যা। খুব সাবধান কিন্তু।”
টুম্পা দরজা খুলে বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর টুনি বলল, “গুটলু, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করতে পারবে?”
“আমি? একা?”
“হ্যাঁ। আমি একটু দেখে আসি।”
“কী দেখে আসবে?”
“বাসার কী অবস্থা।”
“যদি শান্ত ভাইয়া চলে আসে?
“চলে আসলে আসবে। কোনো রকম বাড়াবাড়ি করবে না। যেটা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দেবে। চেষ্টা করবে চোখের দিকে না তাকাতে।”
গুটলু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “চোখের দিকে তাকালে কী হয়?
“অনেক সময় শান্তভাইয়ার ভায়োলেন্সটা বের হয়ে আসে। তাকে আরেক ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়াতে পারলে আরেকটু সেফ হবে।”
গুটলু বলল, “ও।”
“ঠিক আছে? যাব?”
গুটলু শুকনো মুখে বলল, “যাও।”
টুনি তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। গুটলু তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
টুনি শান্তকে খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত দাদির কাছে এসেছে। সব বাচ্চারা দাদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দাদির মুখ শুকনো এবং চেহারা বিমর্ষ। একজন জিজ্ঞেস করল, “দাদি তোমার কী হয়েছে?”
দাদি বললেন, “বুকটা ধরফর করছে।”
দাদি উত্তর দেবার আগেই টুনি বলল, “দাদির বুক ধরফড় করছে তার কারণ গুটলু এই বাসায় এসেছে।”
“গুটলু?” সবাই অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল। “গুটলু কে?”
টুনি বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। সে যে বাসায় যায় সেই বাসায় হয় সে আগুন ধরিয়ে দেয় না হলে পানিতে বাসাটা ভাসিয়ে দেয়।”
“কী বলছিস?” একজন অবাক হয়ে বলল, “সত্যি তাই করে?”
“হ্যাঁ, সেই বাসার জিনিসপত্র ভেঙেচুরে ফেলে না হয় বাসার মানুষজনের হাত পা কেটেকুটে যায়। সেই গুটলু এখন আমাদের বাসায়।”
“কোথায়?”
“আমার রুমে।”
“তোর রুমে কী করছে?”
“আমি যখন এসেছি তখন বসে ছিল। এখন কী করছে জানি না।”
বাচ্চাদের একজন বলল, “চল দেখে আসি।”
অন্যরা বলল, “চল।”
টুনি বলল, “না, না, সবাই যেও না। শুধু একজন গিয়ে নিয়ে এসো এখানে।”
“একজন? একজন কেন?”
টুনি মুখ গম্ভীর করে বলল, “কারণ শুধু একজন এই বাচ্চাটাকে কন্ট্রোল করতে পারবে।”
“কে? কে কন্ট্রোল করতে পারবে।”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “আমি?”
টুনি বলল, “হ্যাঁ তুমি। এই দুষ্টু বাচ্চাটাকে কন্ট্রোল করার মতো পার্সোনালিটি শুধু তোমার আছে। আর কারো নাই।”
শান্ত খুশি হয়ে বলল, “শুধু আমার আছে? তোর তাই ধারণা। শুধু আমার?”
টুনি বলল, “শুধু তুমি যখন বাচ্চাটাকে আনতে যাবে, তখন “তখন কী?”
“যখন বাচ্চাটাকে প্রথম দেখবে তখন তার দিকে তাকিয়ে ভিলেনের মতো একটু হাসবে?”
“ভিলেনের মতো হাসব? আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এমনি একটু মজা করার জন্য। আজকালকার বাচ্চা-কাচ্চারা এগুলো দেখলে খুব মজা পায়।”
“তা ঠিক।” শান্ত মাথা নাড়ল।
“পারবে না হাসতে? তখন বুকে থাবাও দিতে পার।”
“বুকে থাবা দিয়ে ভিলেনের মতো করে হাসব? এই রকম?” বলে শান্ত বুকে থাবা দিয়ে ভিলেনের মতো হাসল, প্রথমে আস্তে আস্তে হো হো শব্দ করতে করতে সেটাকে হা হা করে অট্টহাসির মতো করে ফেলল।
যারা হাজির ছিল তারা সবাই মাথা নেড়ে বলল, ভিলেনের হাসিটা খুবই ভালো হয়েছে। হিন্দি সিনেমার ভিলেন থেকেও ভালো।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া তুমি তাহলে যাও। নিয়ে এসো। গুটলু একা একা আমার রুমে বসে আছে। এতক্ষণে আমার রুমটা জ্বালিয়ে দিয়েছে কী না কে জানে।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে। যাচ্ছি।ঃ তারপর ভিলেনের হাসি হাসতে হাসতে সে দোতলায় রওনা দিল।।
.
গুটলু টুনির ঘরে চেয়ারটায় বসেছিল কিন্তু তার মতো মানুষের পক্ষে চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকা সম্ভব না। কাজেই সে এখন ঘরটাতে কী কী আছে দেখতে শুরু করল। ঘরটা তার জন্যে মোটামুটি বিরক্তকর, বই ছাড়া আর কিছু নেই। শেলফের ওপরে একটা ফ্রেমে টুনির বন্ধুদের সাথে তার একটা ছবি। ছবিটা বের করে সবার নাকের নিচে গোঁফ একে দিলে ছবিটা মনে হয় আরো ভালো দেখাবে। গুটলু টুনির ডেস্কের জিনিসপত্র ওলটপালট করে একটা মার্কার খুঁজল, খুঁজে পেল না। বলপয়েন্ট কলম দিয়েই মনে হয় কাজ চলে যাবে। বল পয়েন্ট কলমই হাতে নিয়ে ছবির ফ্রেমটা খোলার চেষ্টা করার সময় তার মনে হলো সে একজনের হাসির শব্দ শুনতে পেল। সিনেমায় ডাকাতের সর্দারেরা যেভাবে হাসে অনেকটা সেরকম।
গুটলু তখন ছবির ফ্রেমটা শেলফের ওপর রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ করে তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। যদি এই বাসার ম্যানিয়াক সাইকোটিক ছেলেটা চলে আসে তখন কী হবে? গুটলু শুনতে পেল হাসির শব্দটা ধীরে ধীরে ঘরের দরজার সামনে থেমেছে। কেউ একজন দরজাটা খোলার জন্য ধাক্কা দিল। খুলতে না পেরে দরজায় শব্দ করল।
গুটলু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আমি।”
গুটলু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমি কে?”
“আমি শান্ত।”
গুটলুর মনে হলো সে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। এই বাসার ম্যানিয়াক সাইকোটিক ভয়ংকর উন্মাদ ছেলেটি এখানে চলে এসেছে। এখন কী হবে? দরজাটি বন্ধ রাখবে? মেয়েগুলো বলেছে তাহলে নাকি আরো বিপদ। দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে তখন আরো ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে। ভয়ে গুটলুর শরীর অল্প অল্প কাঁপতে থাকে। এখন সে কী করবে?
আবার দরজায় শব্দ হলো। খট খট খট। আবার গলার স্বর শোনা গেল, “দরজা খোলো।”
গুটলু রীতিমতো ঘামতে থাকে। দরজা বন্ধ রাখা যাবে না। তাহলে আরো বড় বিপদ হবে। গুটলু কাঁপা হাতে ছিটকিনি খুলল। ছিটকিনি খুলে দিতেই ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভয়ংকর ম্যানিয়াক সাইকোটিক উন্মাদ ছেলেটা ঢুকে গেল। মেয়ে দুজন তাকে চোখের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিল সে তাই চোখের দিকে তাকাল না। দরজা খোলার সময় শুধু এক ঝলক দেখেছিল তাতেই তার শরীর হিম হয়ে গেছে। কী ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি! শুধু যে ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি তা নয় বুকে থাবা দিয়ে রক্তশীতল করা একটা অট্টহাসি দিয়েছে। এখন কী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? ঘাড়ের রগ কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খাবে? রক্তের গ্রুপটাও সে জানে না।
কিন্তু ভয়ংকর ম্যানিয়াক সাইকোটিক উন্মাদ ছেলেটা সেরকম কিছু করল। খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি গুটলু?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“গুটলু নামটা খুবই ফানি।” ম্যানিয়াক ছেলেটা হা হা করে হাসল। বলল, “গুটলু গুটলু গুটলু। হাউ ইন্টারেস্টিং।”
গুটলু কোনো কথা বলল না। ম্যানিয়াক ছেলেটা ভুল বলে নাই। গুটলু নামটা ইন্টারেস্টিং। এই নামের জন্যে তার অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
“চল, নিচে আমাদের সব ভাই-বোনেরা আছে। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
গুটলু মাথা নাড়ল। শুকনো গলায় বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে।”
“আমাদের ঝুমু খালা খুব ভালো ডালপুরী তৈরি করে। খেলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।”
মেয়ে, দুজন বলেছিল একেবারে নরমালভাবে থাকতে নরমালভাবে কথা বলতে। ম্যানিয়াক ছেলেটাও নরমালভাবে কথা বলছে। গুটলুও নরমাল ভাবে কথা বলল, “ডালপুরি খেতে আমারও খুব ভালো লাগে।”
দাদির আশেপাশে বাচ্চারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল শান্তর পিছু পিছু খুবই নিরীহ একটা বাচ্চা ছেলে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে ঘরে এসে ঢুকল। কাছাকাছি একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে পড়লো, তাকে দেখে একেবারেই দুষ্ট মনে হচ্ছে না। চোখে-মুখে দুষ্টুমির কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে কেমন যেন আতঙ্ক!
কিছুক্ষণের মাঝে ঝুমু খালা প্লেট বোঝাই করে ডালপুরি চটপটি আর লাড়ু নিয়ে এলো। বাচ্চারা ঝপাঝাপি কাড়াকাড়ি করে খেতে থাকে। গুটলু কাড়াকাড়িতে অংশ নিল না। পিঠ সোজা করে বসে রইল। টুনি তখন একটা প্লেটে তার জন্য কিছু খাবার তুলে দিয়ে গুটলুর হাতে তুলে দিয়ে কানের কাছে। মুখ লাগিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “শান্ত ভাইয়াকে দেখছ?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“সবাই কী রকম নরমালভাবে তার সাথে কথা বলছে দেখেছ?”
গুটলু আবার মাথা নাড়ল।
“আসলে কিন্তু পুরোটা অভিনয়। তার হাতে দুইটা লাড়ু দেখেছ?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“এই লাড়ুর ভেতর পুরো ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন আছে। যদি লাড্ড দুইটা খেয়ে ফেলে তখন বিপদ অনেকটা কেটে যাবে।”
গুটলু ভয়ে ভয়ে বলল, “খাবে তো?”
“মনে হয় খাবে। শান্ত ভাইয়া খেতে পছন্দ করে।”
গুটলু শুকনো মুখে বলল, “ও।”
“ডিনারের সময় খাবারের সঙ্গে সিডেটিভ দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলবে। তারপর ওপরে ঘরে নিয়ে চেইন দিয়ে বেঁধে ফেলবে।”
শান্ত হঠাৎ করে টুনি আর গুটলুকে লক্ষ করে বলল, “তোরা কী নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করছিস?”
গুটলু আতঙ্কে চমকে উঠে বলল, “না, না কিছু না কিছু না।”
টুনিও মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু না শান্ত ভাইয়া।”
ডালপুরিটা খুবই মজার ছিল, চটপটিটাও ছিল অসাধারণ কিন্তু গুটলু সেগুলো খুব মজা করে খেতে পারল বলে মনে হলো না। সে সারাক্ষণ শান্তর দিকে তাকিয়ে ছিল। শান্ত পরপর তিনটা লাড়ু খাওয়ার পর গুটলু প্রথমবার একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
.
গুটলুর মা বিয়ের কার্ড দিয়ে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা পার করে ফেলেছিল কিন্তু গুটলুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সে পুরো সময়টা একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসেছিল। গুটলুর মা ভেবেছিল এই বাসায় এসে গুটলুর দুই চারটি দুষ্টুমির গল্প শুনবে কিন্তু কিছুই শুনল না। তখন আরো কিছুক্ষণ দাদির সাথে গল্প করতে চাইছিল কিন্তু গুটলু চলে যাবার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে গেল।
গুটলুকে নিয়ে গুটলুর মা চলে যাবার পর শান্ত বলল, “কী আশ্চর্য, এরকম শান্তশিষ্ট ভদ্র একটা বাচ্চার নামে সবাই কী রকম আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছে, দেখেছিস?”
প্রমি বলল, “হ্যাঁ, কী সুইট একটা বাচ্চা। পুরো সময়টা চুপ করে বসে রইল। একটার চেয়ার থেকে উঠল পর্যন্ত না! কে বলেছে এই বাচ্চা দুষ্ট? মোটেও দুষ্টু না।”
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “হ্যাঁ। আমিও অবাক হয়ে গেলাম। চন্দনের বিয়েতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। শামিয়ানার দড়ি ধরে–” দাদি হঠাৎ কথা থামিয়ে ভুরু কুচকে টুনির দিকে তাকালেন। বললেন, “টুনি? তুই কিছু করেছিস নাকি?”
টুনি বলল, “আমি? আমি কী করব?”
টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা তুই তো সারাক্ষণ আমার সাথে ছিলি। আমরা কী কিছু করেছি?”
টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “না টুনি আপু। আমরা আবার কী করব?”
তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। ঠিক তখন দাদির (কিংবা নানির) টেলিফোনটা বাজল। দাদি টেলিফোনটা খুঁজে বের করতে করতে লাইন কেটে গেল তখন আবার টেলিফোনটা বাজল। দাদি টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার গুটলুর মা আমাকে ফোন করছে কেন?”
দাদি টেলিফোনের বোতাম টিপে কানে ধরলেন। গুটলুর মায়ের গলায় জোর আছে, ফোনে কানে না লাগিয়েই সবাই শুনল গুটলুর মা বলছেন, “চাচি! আপনি তো কখনো আমাকে বলেন নাই আপনার একজন নাতিকে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। ছাড়া পেলে সর্বনাশ হয়ে যায়–”
টুনি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে টুম্পাকে বলল, “টুম্পা আয় আমাদের স্কুল প্রজেক্টটা শেষ করতে হবে। যাই।”
টুম্পাও লাফ দিয়ে উঠে বলল, “চল টুনি আপু।”
কিছু বোঝার আগে দুজন ঘর থেকে উধাও হয়ে গেল।
জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিং
বুধবার দিন সন্ধ্যেবেলা একজন মানুষ ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে এলো। মানুষটা ছোটাচ্চুর বয়সী এবং একটা কালো টিশার্ট আর একটা জিন্সের প্যান্ট পরে আছে, পায়ে লাল রংয়ের স্লিপার। ছোটাচ্চু তাকে দেখে একই সাথে খুবই অবাক এবং খুবই খুশি হয়ে উঠল। তাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে জয়ন্ত, তুই? আমার বাসায়? সত্যি এসেছিস নাকি ভুল করে চলে এসেছিস?”
ছোটাচ্চুর বয়সী মানুষটা যার নাম জয়ন্ত সে বলল, “আগে কতবার এসেছি তখন তো কখনো জিজ্ঞেস করিসনি সত্যি এসেছি নাকি ভুল করে এসেছি।”
ছোটাচ্চু বলল, “তখন তুই ছিলি চিকন-চাকন জয়ন্ত! এখন তুই হচ্ছিস দ্য বিজনেস ম্যাগনেট জয়ন্ত!”
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত বলল, “আমিও তো বলতে পারি তখন তুই ছিলি আধামাধা শাহরিয়ার এখন দি অরিজিনিয়াল ডিটেকটিভ শাহরিয়ার!”
ছোটাচ্চু তার বন্ধুকে সোফায় বসাতে বসাতে বলল, “আমি আর অরিজিনাল ডিটেকটিভ নাই। ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়েছি।”
জয়ন্ত বলল, “কিছু কিছু জিনিস ছাড়তে চাইলেই ছাড়া যায় না। চিনে জেঁকের মতো তোর সাথে লেগে থাকবে। একবার যখন ডিকেটটিভ হয়েছিস, সারা জীবন তুই ডিটেকটিভ হয়ে থাকবি।”
ছোটাচ্চু বলল, “তুই শুনিসনি, একজন দুই নম্বরি বাটপার আমার এজেন্সি দখল করে নিয়েছে?”
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “আরে ধুর! এক এজেন্সি গেছে আরেক এজেন্সি আসবে। আসল জিনিস থাকে এইখানটায়–” বলে জয়ন্ত নিজের মাথায় টোকা দিল। বলল, “এইটা কোনো দুই নম্বরি বাটপার কোনোদিন দখল করতে পারবে না।”
এরকম সময় বাসার কয়েকটা বাচ্চা কোনো একটা কারণে একজন আরেকজনকে ধাওয়া করে বসার ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চুকে তার বন্ধুর সাথে গল্প করতে দেখে আবার হুটোপুটি করতে করতে চলে যাচ্ছিল। ছোটাচ্চু তাদেরকে থামাল, বলল, “এই, এক সেকেন্ড!”
বাচ্চাগুলো দাঁড়াল। ছোটাচ্চু বলল, “তোরা একটা কাজ করতে পারবি?”
“কী কাজ?”
“ঝুমুকে বলবি আমার খুবই ইম্পরট্যান্ট একজন বন্ধু এসেছে, তার জন্য ফার্স্ট ক্লাস চা বানিয়ে দিতে।”
বাচ্চাগুলো এবারে জয়ন্তকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, সবচেয়ে ছোটজন ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এই বন্ধু খুব ইম্পরট্যান্ট?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“দেখে ইম্পরট্যান্ট মনে হয় না।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কেন ইম্পরট্যান্ট?”
ছোটাচ্চু বলল, “বন্ধুর সামনে বলা যাবে না। ও লজ্জা পেতে পারে। ও যখন চলে যাবে তখন বলব।”
বাচ্চারা কিছুক্ষণ জয়ন্তকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তারপর আবার হুটোপুটি করতে করতে ভেতরে চলে গেল। তারা ঝুমু খালাকে চা বানিয়ে দেওয়ার কথা বলল, সাথে সাথে বাসার অন্য সব ছেলেমেয়েকে বলে এল যে ছোটাচ্চুর খুব ইম্পরট্যান্ট একটা বন্ধু এসেছে। বন্ধুটা চলে যাবার পর ছোটাচ্চু সবাইকে বলবে কেন তার বন্ধুটা এত ইম্পরট্যান্ট।
কাজেই কিছুক্ষণের ভেতরেই বাসার অন্য বাচ্চারাও ছোটাচ্চুর এই ইম্পরট্যান্ট বন্ধুটাকে দেখতে চলে এলো এবং বসার ঘরের জানালার বাইরে থেকে তারা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। ছোটাচ্চু বাচ্চাদের ফিস ফিস কথা শুনতে পেয়ে তাদের ডাকল, “এই তোরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করছিস কেন? সামনে আয়।”
তখন বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বসার ঘরে এসে ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্তকে সামনাসামনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। জয়ন্ত কী করবে বুঝতে না পেরে মুখ হাসি হাসি করে রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইল।
ছোটাছুও হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোরা সবাই ভালো করে আমার এই বন্ধুটাকে দেখে নে। আমার এই বন্ধু খুবই ইম্পরট্যান্ট একজন মানুষ।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন ইম্পরট্যান্ট ছোটাচ্চু।”
“আমার বন্ধু চলে যাবার পর বলব। এখন বললে একটু লজ্জা পেতে পারে।”
শান্ত বলল, “কেন লজ্জা পাবে? তোমার এই বন্ধু কী লজ্জার কোনো কাজ করে?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না! লজ্জার কাজ কেন করবে।”
জয়ন্ত তখন খুবই ব্রিবত হয়ে বলল, “আরে শাহরিয়ার তুই এসব কী শুরু করেছিস? ইম্পরট্যান্ট আবার কী? তোর সবসময় একটা নাটক করার অভ্যাস। যেটা বলার সোজাসুজি বলে ফেল। আমিও শুনি তুই আমার সম্পর্কে কী বলিস।”
বাচ্চারা সবাই চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। বল ছোটাচ্চু, বল।”
“তাহলে বলি, শোন।” ছোটাচ্চু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলছে সেরকম ভান করে বলল, “আমার এই বন্ধুর নাম জয়ন্ত। আমাদের ব্যাচে দুজন জয়ন্ত ছিল তাই আমরা এই জয়ন্তকে ডাকতাম চিকন-চাকন জয়ন্ত।”
সবচেয়ে ছোটজন বলল, “এই জন্য ইম্পরট্যান্ট?”
“আরে না! এই জন্যে কেউ ইম্পরট্যান্ট হয় নাকি। ইম্পরট্যান্ট অন্য কারণে।”
প্রমি জিজ্ঞেস করল, “আরেকজন যে জয়ন্ত ছিল তাকে তোমরা কী ডাকতে?”
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত বলল, “তাকে সবাই ডাকত নাদুসনুদুস জয়ন্ত।” নাম শুনে বাচ্চারা আনন্দে হি হি করে হাসল।
ছোটাচ্চু হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর আবার তার গল্প শুরু করল, “আমাদের ক্লাসে কিছু খুব সিরিয়াস ছেলে-মেয়ে ছিল আর কিছু ছিল ফাঁকিবাজ। ফাঁকিবাজদের মাঝে এক নম্বর ছিল আমাদের জয়ন্ত। চিকন-চাকন। জয়ন্ত।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “আর তুমি কয় নম্বর ছিলে?”
“দুই কিংবা তিন নম্বর। যাই হোক অনার্স পরীক্ষায় আমাদের জয়ন্ত ডাব্বা মারল–”
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত আপত্তি করে বলল, “পুরা ডাব্বা মারি নাই। এক সাবজেক্টে শুধু রিপিট–
“যাই হোক পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে জয়ন্তের আব্বু রেগে ফায়ার। আংকেল খুবই কড়া মানুষ ছিলেন। তখন আংকেল কী করলেন জানিস?”
শান্ত বলল, “বাড়ি থেকে বের করে দিলেন?”
ছোটাচ্চু বলল, “একজাক্টলি। জয়ন্তকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। জয়ন্ত মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়। একদিন এর সাথে থাকে, আরেকদিন আরেকজনের সাথে থাকে। তখন একদিন যখন আংকেল বাসায় নাই সে গোপনে বাসায় গেছে। আন্টি তাকে ভাত খাওয়ালেন তারপর তার বিয়ের নেকলেসটা দিয়ে বললেন এটা বিক্রি করে কিছু একটা করতে।”
ছোটাচ্চু একটু থামল, জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, “কী দিন গিয়েছে! মনে আছে তোদের নিয়ে সেই নেকলেস বিক্রি করতে গেলাম, জুয়েলারির দোকান আমাদের বিশ্বাস করে না। মনে করে আমরা চুরি করে এনেছি। পারলে পুলিশে খবর দেয়।”
ছোটাচ্চু বলল, “মনে নাই আবার। যাই হোক জয়ন্ত আন্টির নেকলেস বিক্রির টাকা দিয়ে বিজনেস শুরু করল। প্রথম বিজনেসটা কীসের ছিল কে বলতে পারবে?
শান্ত বলল, “ইয়াবা। ড্রাগের বিজনেসে টাকা সবচেয়ে বেশি।”
প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “ইয়ারকি করবি না।”
ছোটাচ্চু বলল, “জয়ন্তের প্রথম বিজনেস ছিল বল্লরি।”
“সেইটা আবার কী?”
“একটা হিন্দি সিনেমার নায়িকার ড্রেস। ঈদের আগে এই সিনেমা খুব হিট। আমাদের জয়ন্ত কীভাবে কীভাবে জানি আন্দাজ করল ঈদে নায়িকার এই ড্রেস পপুলার হবে। হাজার খানেক ড্রেস বানিয়ে সে রেডি। আসলেই ঈদের আগে হঠাৎ করে সবার মুখে শুধু বল্লরী ড্রেসের কথা। আমাদের জয়ন্ত সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারে না–এক ধাক্কায় বড়লোক। এইভাবে শুরু। তারপর কত কী যে বিজনেস করেছে বলে শেষ করা যাবে না। সাইকেল থেকে শুরু করে সফটওয়্যার। হোটেল থেকে শুরু করে শিপিং। এখন জয়ন্ত কী পরিমাণে বড়লোক হয়েছে তোরা কেউ চিন্তাও করতে পারবি না।”
একজন জানতে চাইল, “কী রকম বড়লোক?”
ছোটাচ্চু এমনভাবে কথা বলতে লাগল যে জয়ন্ত না, সে নিজেই বুঝি বড়লোক। হাত নেড়ে বলল, “খালি একটা উদাহরণ দেই। গত সামারে জয়ন্তের হঠাৎ করে ব্রাসেলস যেতে হবে। সে কীভাবে গেছে বল দেখি?”
টুম্পা বলল, “প্লেনে।”
শান্ত বলল, “ধুর গাধা। প্লেনে তো যাবেই, হেঁটে যাবে নাকি?”
প্রমি বলল, “বিজনেস ক্লাসে।”
“হলো না।”
শান্ত বলল, “ফার্স্ট ক্লাসে!”
“উঁহু” ছোটাচ্চু বলল, জয়ন্ত প্লেনের টিকিট পায় না, তখন সে আস্ত একটা প্লেন চার্টার করে ফেলল। ছোট একটা পার্সোনাল জেট!”
সবগুলো বাচ্চা তখন একসাথে বিস্ময়ের শব্দ করল। শান্ত বলল, “আমরা যেরকম সিএনজি রিজার্ভ যাই সেইরকম প্লেন রিজার্ভ?”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ। সেইরকম।”
জয়ন্ত বিব্রত হয়ে বলল, “দেখ শাহরিয়ার তুই এমনভাবে বলছিস যে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি সবসময় প্লেন চার্টার করি। একবার করতে হয়েছিল—“
ছোটাচ্চু জয়ন্তের কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। নিজের মতো করে বলতে থাকল, “বসন্ধুরায় তার একটা বাসা আছে। সেই বাসায় হাতে ম্যাপ না নিয়ে যদি যাস তাহলে হারিয়ে যাবি। সেই বাসায় কী নাই! ছাদের ওপর সুইমিং পুল।
বাচ্চারা সুইমিংপুলের কথা শুনে এক সাথে সবাই বিস্ময়ের শব্দ করল। ছোটাচ্চু বলল, “টাকা খরচ করে শেষ করতে পারে না। সেজন্যে জয়ন্ত কী করেছে জানিস?”
“কী করেছে?”
“তার বাসার নিচে একটা আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করেছে। বাংলাদেশের যত বড় বড় শিল্পী আছে তাদের সবার ছবি আছে।”
শাহানা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “জয়নুল আবেদীন?”
জয়ন্ত লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, “আছে।”
“কামরুল হাসান?”
“আছে।”
“সুলতান?”
“আছে।”
“শাহাবুদ্দিন? কিবরিয়া? আব্বুর রাজ্জাক?”
“আছে। মোটামুটি সবারই আছে!” জয়ন্ত শাহানার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, “তোমার পেইন্টিং ভালো লাগে?”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “জী। খুব ভালো লাগে।”
শান্ত বলল, “যদি ট্যারা-ব্যাকা ছবি হয় যেটা দেখে আগা-মাথা কিছু বোঝা যায় না সেইসব পেইন্টিং শাহানাপুর সবচেয়ে ভালো লাগে।”
শাহানা শান্তর মাথায় একা চাটি মেরে বলল, “যেটা বুঝিস না সেইটা নিয়ে কথা বলিস না।”
শান্ত বলল, “তা হলে আমার কথা বলাই বন্ধ হয়ে যাবে।”
প্রমি বলল, “তখন আমাদের সবার শান্তি হবে।”
জয়ন্ত শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার যদি পেইন্টিং ভালো লাগে তাহলে একদিন আমার বাসায় এসে আমার কালেকশনটা দেখে যেও। ভালো লাগবে।”
এক সাথে সব বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”
শাহানা বলল, “তোরা যাবি মানে? তোরা গিয়ে কী করবি? কোনোদিন গিয়েছিস কোনো আর্ট এক্সিবিশনে? কতবার আমি নিয়ে যেতে চেয়েছি। গিয়েছিস?”
সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল, তারা আসলে পেইন্টিং বুঝে না। তাই কখনো যায় নাই।
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা তো আমাকে কথাই শেষ করতে দিলি না, তোরা কী ভেবেছিস জয়ন্তের বাসায় শুধু সুইমিং পুল আর আর্ট মিউজিয়াম আছে?”
সবাই জানতে চাইল, “আর কী আছে ছোটাচ্চু?”
“রীতিমতো চিড়িয়াখানা। বাঘ-ভাল্লুক-হরিণ-ময়ূর কী নেই।”
“সত্যি?” বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “সত্যি সত্যি বাঘ-ভালুক আছে?”
জয়ন্ত বলল, “না, না, বাঘ-ভালুক নেই। কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণ আছে, বানর আছে, খরগোস আছে, ময়ূর আছে, অনেক রকম পাখি আছে। মাছ আছে। রেয়ার গাছ আছে।”
বাচ্চারা চিৎকার করতে থাকল, “দেখব। দেখব। আমরা দেখব।”
জয়ন্ত বলল, “সবাই মিলে চলে এসো। সুইমিংপুলে গোসল করবে, চিড়িয়াখানা দেখবে, পেইন্টিং দেখবে, দুপুরে খাবে”
শান্ত চিৎকার দিল, “খাব। খাব। আমরা খাব!”
জয়ন্ত হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিলে বলল, “তুই বাচ্চা কাচ্চাদের একদিন নিয়ে আয়। সারাদিন থাকবে ঘুরে বেড়াবে।”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু। হ্যাঁ। হ্যাঁ।”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের কোনদিন নিয়ে যাবে না। ছোটাচ্চুর কিছু মনে থাকে না।”
অনেকেই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ছোটাচ্চু সবকিছু ভুলে যায়।”
শান্ত বলল, “আমি মনে করিয়ে দেব।”
জয়ন্ত বলল, “ঠিক আছে, শাহরিয়ারকে নিতে হবে না। আমি আমার বড় ভ্যানটা পাঠিয়ে দেব, সাথে ম্যানেজার থাকবে। সে তোমাদের নিয়ে যাবে।”
সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “ইয়েস। ইয়েস। সেইটাই সবচেয়ে ভালো। ছোটাচ্চুকে কিছু করতে দিলেই ছোটাচ্চু সেটা মাখিয়ে ফেলে।”
জয়ন্ত বলল, “সেইটা আমিও বিশ্বাস করি। এই জন্যে আমরা তোমাদের ছোটাচ্চুকে ডাকতাম আধা মাধা শাহরিয়ার। মনে আছে শাহরিয়ার?”
ছোটাচ্চু মুখ বিকৃত করে বলল, “মনে নাই আবার?”
ঠিক তখন ঝুমু খালা প্লেট বোঝাই খাবার আর চা নিয়ে এলো বলে আলাপ থামিয়ে সবাই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
.
এক সপ্তাহ পরে ভোরবেলা জয়ন্ত একটা বড় ভ্যান পাঠিয়ে দিল। সাথে ভ্যানের ড্রাইভার আর একজন হাসিখুশি ম্যানেজার। বাসার সব বাচ্চা সেই ভ্যানটাতে গাদাগাদি করে উঠে বসল। ছোটাচ্চু ছাড়াই সবাই যাওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেল একেবার শেষ মুহূর্তে ছোটাচ্চুও ভ্যানে উঠে বসেছে।
ছুটির দিন, তাই রাস্তায় ভিড় নেই। সবাই দেখতে দেখতে জয়ন্তের বাসায় পৌঁছে গেল। ছোটাচ্চু ভুল বলে নাই বিশাল একটা জায়গা নিয়ে জয়ন্তের বাসা, বাইরে থেকেই বোঝা যায় না ভেতরে অনেক জায়গা। বড় একটা গেট খুলে গেল, তখন বিশাল ভ্যানটা ভেতরে ঢুকে পড়ে। ড্রাইভওয়েতে ভ্যানটা থামতেই সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়ির ওপর জয়ন্ত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়েছিল, সে নিচে নেমে এলো। শান্ত এগিয়ে গিয়ে বলল, “জয়ন্ত কাকু, আমরা সবাই এসে গেছি।”
“ভেরি গুড।”
“আমরা ছোটাচ্চুকে ছাড়াই আসতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ছোটাচ্চু জোর করে চলে এসেছে।”
জয়ন্ত হাসি মুখে বলল, “তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাদের ছোটাচ্চুকে ব্যস্ত রাখব যেন সে তোমাদের ডিস্টার্ব করতে না পারে।”
শান্ত বলল, “ভেরি গুড।”
জয়ন্ত ছোট কয়েকজনকে নামতে সাহায্য করল, তারপর বলল, “ডাইনিং টেবিলে তোমাদের জন্যে কিছু স্ন্যাকস্ রাখা আছে। আগে একটু খেয়ে নাও, তারপর যার যেটা পছন্দ সেটা দেখতে থাকো।
।সবাই বাসা থেকে নাশতা করে এসেছে কিন্তু খাবারের কথা শুনে আবার তাদের খিদে পেয়ে গেল। জয়ন্ত সবাইকে ভেতরে নিতে নিতে বলল, “সুইমিং পুলটা ছাদে। যারা সাঁতার জানো না তাদের জন্যে এক পাশে ছোট পুল আছে, পানি কম। তোমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আজকের জন্য আমি দুজন লাইফগার্ড নিয়ে এসেছি। তারা দেখবে।”
টুম্পা জানতে চাইল, “চিড়িয়াখানা কই?”
“বাসার পেছনে। কোনো হিংস্র প্রাণী নাই কিন্তু বানর থেকে একটু সাবধান। ছোট বাচ্চা দেখলে মাঝে মাঝে জ্বালাতন করে।”
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী রকম জ্বালাতন?”
“এই তো–মনে করো হাতে ললিপপ আছে, টান দিয়ে নিয়ে নেবে। হাজার হলেও বানর, তাই বাঁদরামি যায় না।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “আর পেইন্টিংগুলো?”
“সেটা বেসমেন্টে। কাউকে বললেই নিচে নিয়ে যাবে।”
সবাই প্রথমে ডাইনিং টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিল। তারপর বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই চিড়িয়াখানা দেখার জন্য ছুটল। সেটা দেখে শেষ করেই সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেখানে ঝাপাঝাপি করে যখন খিদেটা জাগিয়ে উঠবে তখন লাঞ্চ।
জয়ন্ত চা খেয়ে ছোটাচ্চুকে নিয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল কী একটা জরুরি কাজ আছে সেটা সেরে দুপুরের আগেই ফিরে আসবে।
সবাই যখন বাইরে হইচই চেঁচামেচি করছে তখন শাহানা বেসমেন্টে গেল। পেইন্টিংগুলো দেখার জন্য। অন্য কারো সেগুলো নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, শুধু টুনি শাহানার পিছু পিছু গেল। শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথায় যাস?”
“তোমার সাথে। পেইন্টিং দেখতে।”
“চিড়িয়াখানা দেখবি না?”
টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “চিড়িয়াখানা তো সব সময় দেখি। দাদি সবসময় বলে না আমাদের বাসা হচ্ছে একটা চিড়িয়াখানা! টিকিট লাগিয়ে দিলে মানুষজন টিকিট কেটে আমাদের দেখতে আসবে।
শাহানা হাসল, বলল, “তা ঠিক।”
বেসমেন্টটা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগাল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার পর একটা বড় হলঘর, ভেতরে কুসুম কুসুম ঠাণ্ডা। হলঘরের দেওয়ালে পেইন্টিংগুলো ঝোলানো। খুব সুন্দর করে ছোট ছোট আলো লাগানো আছে যেন পেইন্টিংগুলো ভালো করে দেখা যায়। দেখে মনে হয় একেবারে সত্যিকারের মিউজিয়াম।
শাহানা আর টুনি যখন মাত্র পেইন্টিংগুলো দেখা শুরু করেছে তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি একটা মানুষ এসে হাজির হলো। মানুষটার মাথায় চুল কম, যেটুকু চুল আছে মাঝখানে সিঁথি করে সেটা দুই ভাগ করে চাদিটা ঢেকে রেখেছে। পরনে একটা স্যুট এবং গলায় টাই। স্যুটটা মনে হয় ছোট হয়ে গেছে, শরীরের সাথে কেমন জানি টাইট করে লাগানো। গলায় লাল রংয়ের চিকন একটা টাই। মানুষটার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতরে। নাকের নিচে হিটলারের মতো গোঁফ, সেটা আবার চিকন হয়ে ঠোঁটের ওপর দিয়ে দুই পাশে নেমে গেছে। টুনি এর আগে কখনো কারো এরকম গোঁফ দেখেনি। একজন মানুষের চেহারা দেখে তাকে পছন্দ কিংবা অপছন্দ করা ঠিক না। কিন্তু এই মানুষটাকে দেখেই টুনির কেন জানি তাকে একেবারেই পছন্দ হলো না।
মানুষটা যখন মুখ খুলল তখন টুনি বুঝতে পারল তার ধারণাটা মনে হয় ঠিকই আছে। তার কারণ মানুষটা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা কে? এইখানে কী করছ?”
টুনির মনে হলো সে বলে, “আপনি কে? আপনি এইখানে কী করছেন?”
কিন্তু সে কিছু বলল না, সাথে শাহানা আছে। শাহানা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কথাবার্তা যা বলার সেই বলবে। শাহানা মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমরা পরিচয় দিলে মনে হয় চিনতে পারবেন না! জয়ন্ত কাকু আমাদের ফেমিলি ফ্রেন্ড। আমাদের এখানে ইনভাইট করেছেন। বিশেষ করে তার পেইন্টিং কালেকশন দেখার জন্য। সেজন্যে এসেছি।”
মানুষটা খুব বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল, “আমাকে কিছু বলল না–”
শাহানা বলল, “মনে হয় বুঝতে পারেন নাই যে আপনার পারমিশান নিতে হবে?”
এবারে মানুষটা একটু থতমত খেলে গেল, আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে পারমিশান না–মানে ইয়ে–” বলে কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
শাহানা আর টুনি অপেক্ষা করছিল কখন মানুষটা সরে যাবে তখন তারা পেইন্টিংগুলো দেখা শুরু করবে। কিন্তু মানুষটা সরে গেল না, একেবারে তাদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
তখন শাহানা বাধ্য হয়ে আরেকটু কথা বলল, “আপনি বুঝি এখানে আছেন?”
“হ্যাঁ। স্যার আমাকে এই আর্ট কালেকশনের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি দেখে-শুনে রাখি।”
শাহানা বলল, “ও।”
মানুষটা বলল, “ঠিক আছে, পেইন্টিং দেখতে চাইলে দেখো, কিন্তু নো ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফি। হাত দিয়ে ছুবে না।”
শাহানা মাথা নাড়ল, “ছুবো না।”
“ঘরটা হিউমিনিডিটি এন্ড টেম্পারেচার কন্ট্রোলড। পেইন্টিংগুলো ওয়েল প্রোটেক্টেড। সিসি ক্যামেরা দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করা হয়। কাজেই উল্টাপাল্টা কিছু করো না।”
এবারে শাহানা আর টুনির একসাথে একটু মেজাজ গরম হলো। শাহানা শীতল গলায় বলল, “উল্টাপাল্টা বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?”
“উল্টাপাল্টা মানে উল্টাপাল্টা। ছোট ছেলেমেয়েরা পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব কী বুঝবে? তাদের কাছে একটা জয়নুল আর একটা রিকশার পেইন্টিংয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। কলম দিয়ে হয়তো একটা পেইন্টিংয়ের ওপর নিজের নাম লিখে ফেলল।”
শাহানা মুখ শক্ত করে বলল, “আমরা নিজের নাম লিখব না। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন কন্ট্রোল রুম থেকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পারেন।” কথা শেষ করে সে ঘুরে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “আর তোকে শিখাই কেমন করে একটা সুন্দর পেইন্টিং এনজয় করতে হয়।”
তারপর প্রথম পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে লোকটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “এই যে এইটা হচ্ছে জয়নুলের একটা ওয়াটার কালার। ময়মনসিংহের একটা জমিদারবাড়িতে ছিল তারপর হারিয়ে গেল। অনেকদিন কোনো খোঁজ ছিল না, তারপর হঠাৎ করে গুলশানের একটা আর্ট সাপ্লাইয়ের দোকানে হাজির হলো। এটা অরিজিনাল না ভুয়া সেইটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এক্সপার্টরা বলেছে এটা অরিজিনাল। তখন এটা নিলামে উঠেছিল, অনেক দামে জয়ন্ত কাকু কিনে নিয়েছেন।”
মাঝখানে সিঁথি করা এবং হিটলার ও সিরাজদৌলার মতো গোঁফের মানুষটা মুখটা হা করে শাহানার দিকে তাকিয়ে রইল। আমতা আমতা করে বলল, “তুমি এতসব কেমন করে জান?”
“আমার পেইন্টিং ভালো লাগে। জয়ন্ত কাকু যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমি এইখানে দিনের পর দিন পড়ে থাকব।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই শাহানার কথা শুনে মানুষটার মুখটা কেমন জানি কালো হয়ে গেল। শাহানা অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, টুনি দেখল শাহানার চোখগুলো কেমন যেন ঢুলু ঢুলু হয়ে গেছে। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শাহানা পরের পেইন্টিংয়ের কাছে গেল। টুনিকে বলল, “এটা কামরুল হাসান। সবাই ওনাকে বলে পটুয়া কামরুল হাসান। শেষের দিকের আঁকা ছবি। শুধু তাকিয়ে দেখ, কী পাওয়ার ফুল ড্রয়িং, মাত্র কয়টা টান দিয়ে এঁকেছেন, লক্ষ্য কর। উজ্জ্বল রং–”
টাইট স্যুট এবং চিকন টাইয়ের মানুষটা শাহানার কথা শুনে কেমন জানি উশখুশ করতে লাগল, দেখে মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছে আবার ঠিক বলতে পারছে না কিছুক্ষণ ইতিউতি করে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোনো কথা না বলেই বিদায় নিল, শাহানা আর টুনি দুজনই তখন একেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
শাহানা বলল, “এখন শান্তিমতো পেইন্টিংগুলো দেখা যাবে।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ। এই মানুষটার কিছু একটা সমস্যা আছে।”
“চেহারাটা ফানি। এইটা কী সমস্যা?”
“উঁহু।” টুনি মাথা নাড়ল, “চেহারা না। অন্যকিছু।”
শাহানা বলল, “বাদ দে। আয় পেইন্টিং দেখি।”
দুজন আবার ছবি দেখতে শুরু করে।
চার নম্বর পেইন্টিংটার সামনে এসে শাহানা হঠাৎ কেমন জানি চমকে উঠল। এক ধরনের আর্ত চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ।”
“কী হয়েছে?”
“ফেক পেইন্টিং।”
টুনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফেক? মানে ভুয়া?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে বুঝলে?”
শাহানা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “কেমন করে বুঝলাম মানে? এইটা হওয়ার কথা একটা ওয়েল পেইন্টিং, ক্যানভাসের ওপর করা। ওয়েল পেইন্টিং হয় খসখসে, পেইন্টিং শুকিয়ে থাকে। আর এইটা হচ্ছে তার একটা ছবি, পিভিসিতে প্রিন্ট করে রেখেছে। চক চক করছে দেখছিস না?”
“কী আশ্চর্য! জয়ন্ত কাকু একটা ভুয়া পেইন্টিং কিনে সাজিয়ে রাখবেন?” টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হতেই পারে না।”
শাহানা প্রায় চিৎকার করে বলল, “হতেই পারে না মানে? নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করছিস না?”
টুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “শাহানাপু, আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“জয়ন্ত কাকু অরিজিনাল পেইন্টিংটাই কিনেছিলেন। কেউ একজন সেইটা চুরি করে ভুয়া এইটা এইখানে ঝুলিয়ে রেখেছে।”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “তুই ঠিকই বলেছিস। নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। আমাদের এক্ষুনি জয়ন্ত কাকুকে বলতে হবে।”
টুনি বলল, “দাঁড়াও শাহানাপু। নিশ্চয়ই ভেতর থেকে কেউ এইটা চুরি করেছে। আমরা বললেই সে সাবধান হয়ে যাবে। আমরা যে এইটা বুঝে ফেলেছি সেটা আগেই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। সত্যি কথা বলতে কী আমরা এখন কী করছি সেই চোর হয়তো সিসি টিভিতে সেটা দেখছে। তাই আমাদের ভান করতে হবে যেন আমরা কিছু বুঝি নাই। খুব নরমাল দেখাতে হবে।”
শাহানা বলল, “তোর কী মনে হয় টুনি? এই ফানি লুকিং লোকটাই চোর?”
“হতেও তো পারে। তারই তো চুরি করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখনো তো আমরা জানি না।”
শাহানা এদিক সেদিক তাকাল, “তারপর বলল, কে জানে এইটা ছাড়া আরও পেইন্টিং চুরি করেছে কি না কে জানে।”
“আগেই সেটা দেখতে যেও না শাহানাপু। আমরা একটা একটা করে দেখে যাই, তাহলে বের হয়ে যাবে।”
“এই ঘরটাতে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে, তাহলে চুরি করল কেমন করে?”
“সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে বোঝা যাবে। কে জানে কতদিন আগে চুরি করেছে।”
শাহানা রাগ রাগ মুখে বলল, “কত বড় সাহস। মদমাইশের বাচ্চা বদমাইশ।”
টুনি শাহানার দিকে তাকিলে বলল, “শাহানাপু তুমি এখনো রেগে আছ। আগে শান্ত হও। তোমার চেহারা দেখে যেন বুঝতে না পারে যে তুমি ধরে ফেলেছ এইটা ভুয়া পেইন্টিং।”
শাহানা বলল, “ঠিক আছে। আমি শান্ত ভাব দেখাই।”
শাহানা তখন শান্ত ভাব দেখিয়ে হয়ে নকল পেইন্টিংটা দেখার ভান করতে লাগল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এত বড় ছবি চুরি করল কেমন করে?”
“কেন, বুঝতে পারছিস না? চাকু দিয়ে ফ্রেমের চারপাশে ক্যানভাসটা কেটে নেয়। তারপরে আগে থেকে প্রিন্ট করে আনা ভুয়া ছবিটা ফ্রেমের সাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়। চুরি করা পেইন্টিংটা ভাঁজ করে একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। খুবই সোজা।”
“তার মানে ছবির ফ্রেমটা ঘোয় না?”
“না। ছবির ফ্রেম তার জায়গাতেই থাকে।”
“কী আশ্চর্য।” টুনি মাথা নাড়ল, “চোরের কত বুদ্ধি দেখেছ?”
শাহানা হাসার চেষ্টা করল, “সেই জন্যেই তো গ্রামদেশে বাচ্চা হলে সবাই দোয়া করে বলত তোমার পিঁপড়ার মতো শক্তি হোক আর চোরের মতো বুদ্ধি হোক।”
“পিঁপড়ার অনেক শক্তি, তাই না?”
“তার সাইজের তুলনায় শক্তি বেশি না? নিজের ওজন থেকে কয়েকগুণ বেশি ওজন ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে পারে। তুই পারবি?”
টুনির স্বীকার করতে হলো যে সে পারবে না।
দুজন মোটামুটি শান্তভাবে পেইন্টিংটার সামনে সময় কাটিয়ে পরের পেইন্টিংটা দেখতে গেল। সেখান থেকে পরেরটা, এভাবে একটা একটা করে দেখে যেতে থাকে। অন্য যে কেউ হলে পেইন্টিংগুলো এক নজর দেখেই চলে যেত, শাহানা মোটেও সেই মানুষ না। সে প্রত্যেকটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, টুনির সাথে ছবির ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ করল। প্রায় শখানেক ছবি দেখে শেষ করতে তাদের দুই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। এর মাঝে চারটা ছবি ভুয়া। চোর যেই হোক সে জয়ন্ত কাকুর আর্ট মিউজিয়ামের চারটা পেইন্টিং চুরি করে ফেলেছে। কী আশ্চর্য।
বেসমেন্টের আর্ট মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ওপরে উঠে দুজন প্রথমে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে অনেক্ষণ বিশ্রাম নিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাদের হাটু ব্যথা হয়ে গেছে। তারপর উঠে ভেতরে যাবার সময় দেখল পাশে একটা ছোট ঘর সেখানে অনেকগুলো টেলিভিশন স্ক্রিনের সামনে একজন মোটাসোটা মানুষ বসে আছে। এটা নিশ্চয়ই এই বাসার সিকিউরিটি রুম, এখান থেকে সবগুলো সিসি টিভিকে দেখা যায়।
টুনি বলল, “শাহানাপু চল আমরা সিকিউরিটি রুমটা একটু দেখে আসি।”
“কী দেখবি?”
“সিসি টিভি থাকলেও পেইন্টিং কীভাবে চুরি করে সেইটা।”
“আয় যাই।”
সিকিউরিটি রুমে ঢুকতেই মোটাসোটা মানুষটা তাদের দিকে তাকিয়ে ভালো মানুষের মতো হাসল। টুনি আগেও লক্ষ করেছে শুকনো মানুষের মেজাজ হয় খিটখিটে আর মোটাসোটা মানুষের মেজাজ হয় হাসিখুশি। সিকিউরিটির মানুষটা বলল, “তোমাদের কী খবর? স্যারের আর্ট মিউজিয়াম কেমন দেখলে?”
শাহানা বলল, “অসাধারণ!”
মানুষটা বলল, “আমি সিসি ক্যামেরাতে দেখলাম তোমরা অনেক সময় নিয়ে ছবিগুলি দেখেছ!”
টুনি শাহানাকে দেখিয়ে বলল, “শাহানাপু পেইন্টিং খুব পছন্দ করে। সেই জন্যে!”
“তোমাদের আগে আর কেউ এত মনোযোগ দিয়ে এই ছবি দেখে নাই!”
শাহানা বলল, “আমি আবার দেখতে আসব।”
“এসো। স্যার খুশি হবেন। কেউ স্যারের পেইন্টিং দেখতে আসলে স্যার খুব খুশি হন।”
টুনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মানুষটার পেছনে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একসাথে সবগুলো স্ক্রিন দেখতে পারেন?”
“আসলে দেখতে হয় না। শুধু চোখ বুলাই। যদি এবনরমাল কিছু হয় তাহলে দেখি।”
“এবনরমাল?”
“হ্যাঁ।”
“সেটা কী রকম?”
“ধরা যাক হঠাৎ যদি দেখি কোনো অপরিচিত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে কিংবা পরিচিত মানুষ খুব সন্দেহের ভঙ্গিতে হাঁটছে–”
“কখনো কী হয়েছে এরকম?”
“না সেভাবে হয় নাই। যেমন মনে করো আজকে তোমরা যখন পেইন্টিংগুলো দেখছিলে তোমরা সারাক্ষণ নরমাল ভাবে দেখেছ। শুধু প্রথমদিকে একবার–”
টুনি আর শাহানা দুজনই এবারে মোটোসোটা মানুষটার দিকে তাকাল, “প্রথমদিকে কী?”
“প্রথম দিকে তোমরা যখন একটা পেইন্টিং দেখছিলে হঠাৎ করে খুব উত্তেজিত হয়ে গেলে, মনে হলো খুব আশ্চর্য কিছু দেখেছ।”
টুনি আর শাহানা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মানুষটা বলল, “কী ছিল ছবিটাতে, কী দেখে এত অবাক হয়েছিলে?”
শাহানা কী বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে”
টুনি তখন শাহানাকে রক্ষা করল, বলল, “ওয়েল পেইন্টিংটা অন্য স্টাইলে আঁকা ছিল, এরকম হয় না সাধারণত। তাই না শাহানাপু?”
“হ্যাঁ। একই সাথে ওয়েল আর প্যাস্টেল
মোটাসোটা মানুষটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম গিয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করি ছবিতে কোনো সমস্যা আছে কী না, কাদেরী বখস যেতে দিল না, বলল, কোনো সমস্যা নাই।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “কাদেরী বখস কে?”
“আমাদের আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “ঐ যে স্যুট পরে ছিলেন? লাল টাই?”
“হ্যাঁ।”
“চুলের মাঝখানে সিঁথি?”
“হ্যাঁ।“
“উনি কী অনেকদিক থেকে আছেন?”
“না। মাস খানেক হলো জয়েন করেছেন।”
মোটা মানুষটার সামনে রাখা স্ক্রিনগুলোর একটাতে হঠাৎ করে দেখা গেল মুনিয়া ছুটে একটা খরগোসের বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়েছে, আরেকটাতে দেখা গেল শান্ত একটা লাল হাফ প্যান্ট পরে সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। টুম্পাকে দেখা গেল খুব মনোযোগ দিয়ে একটা কাকাতুয়া পাখিকে পরীক্ষা করছে। একজন মানুষ যখন জানে না তাকে কেউ দেখছে তখন মানুষটাকে দেখতে অন্যরকম মনে হয়। কারণটা কী কে জানে!
শাহানা বলল, “আয় টুনি যাই। চিড়িয়াখানাটা দেখে আসি। মনে হচ্ছে সবাই মিলে অনেক মজা করছে।”
টুনি একটু ইতস্তত করে বলল, “তুমি যাও শাহানাপু। আমি এই আংকেলের সাথে বসে এই সিকিউরিটি সিস্টেমটা দেখে আসি। মনে হচ্ছে খুবই ফাটাফাটি সিস্টেম।”
শাহানা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিলে রইল। তারপর বলল, “ঠিক আছে দেখ। আমি গেলাম।”
টুনি তখন মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করল, “আমি একটু দেখি, আপনি কীভাবে কাজ করেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো! দেখার অবশ্য কিছু নাই। বসে থেকে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ বুলাই!”
“সেইটাই দেখি।”
মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড তখন টুনির জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার পাশে রাখে। টুনি সেখানে বসে স্ক্রিনগুলো দেখে। আর্ট মিউজিয়ামের ভেতর দুইটা ক্যামেরা, দুইপাশ থেকে হলঘরটা দেখা যায়। চারটা পেইন্টিং চুরি করে সেখানে সেই পেইন্টিংয়ের ছবি লাগানো হয়েছে। চুরি করার পুরো ব্যাপারটা কারো না কারো স্ক্রিনে দেখার কথা। সিকিউরিটি গার্ড কেন সেটা দেখতে পেল না?
টুনি কিছুক্ষণ স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “কেউ যদি পেইন্টিং চুরি করার চেষ্টা করে কিংবা নষ্ট করার চেষ্টা করে তাহলে আপনি এখানে বসে সেটা দেখে ফেলবেন, তাই না?”
“অবশ্যই। আমরা তিনজন আছি, আট ঘণ্টার শিফট। যার ডিউটি সে দেখে ফেলবে।”
“মনে করেন কেউ একটা পেইন্ট চুরি করতে চায় কিন্তু কোনো প্রমাণ রাখতে চায় না তাহলে?”
“সম্ভব না। প্রমাণ থেকেই যাবে। ক্যামেরায় সব রেকর্ড করা হতে থাকে। যদি দেখি একটা পেইন্টিং চুরি গেছে আমরা আমাদের রেকর্ড রিপ্লে করে সেটা বের করে ফেলব।”
টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “কেউ যদি ক্যামেরা দুইটা অচল করে দেয় তাহলে তো সেটা রেকর্ড হবে না?”
“না। ক্যামেরার কানেকশন খুলে ফেললে, তখন কিছু রেকর্ড হবে না। কিন্তু আমরা এখানে বসে দেখে ফেলব যে ক্যামেরা বন্ধ হয়ে আছে। তখন আমরা যাব দেখার জন্য ক্যামেরা বন্ধ হলো কেমন করে।”
টুনি বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “কখনো কী আর্ট মিউজিয়ামের হলঘরের ক্যামেরা বন্ধ হয়েছে?”
সিকিউরিটি গার্ড ঘুরে টুনির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। হঠাৎ করে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ? তোমরা কী স্যারের মিউজিয়ামে কিছু একটা দেখেছ যেটা দেখে তোমার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে?”
“আংকেল, আপনাকে আমি সেটা পরে বলব। আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন?”
সিকিউরিটি গার্ড বলল, “তুমি জান, আসলেই আর্ট মিউজিয়ামের ক্যামেরা দুইটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”
“কখন?”
“সপ্তাহ খানেক আগে।”
“তখন আপনি কী করেছেন?”
“আমি যখন ব্যাপারটা দেখার জন্য মিউজিয়ামে দৌড়ে যাব তখন ক্যামেরা দুইটা আবার চালু হয়ে গেল।”
“তার মানে কতক্ষণ ক্যামেরা বন্ধ ছিল?”
“খুবই কম সময়। খুব বেশি হলে দুই মিনিট হবে।”
“মাত্র দুই মিনিট?”
“হ্যাঁ। কিংবা আরো কম।”
টুনি একটু হতাশ হলো। দুই মিনিটের মাঝে চারটা পেইন্টিং তার ফ্রেম থেকে আলাদা করে, ভুয়া পেইন্টিংগুলো সেখানে আঠা দিয়ে লাগানো সম্ভব না। টুনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আর কখনো কী ক্যামেরা বন্ধ হয়েছিল?”
সিকিউরিটি গার্ড মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হয়েছিল।”
টুনি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কবে? কখন? কীভাবে? কতক্ষণ বন্ধ ছিল?”
“একই দিনে। প্রথমবার বন্ধ হবার ঘণ্টা খানেক পর।”
“কতক্ষণ বন্ধ ছিল?”
“একই রকমভাবে, আমি যখন দেখার জন্য মিউজিয়ামে যাব, তখন আবার ক্যামেরা অন হয়ে গেল। দুই মিনিটের ভেতর।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “ও। আচ্ছা। মাত্র দুই মিনিট?”
“হ্যাঁ। কিংবা আরো কম। রেকডিংটা রিপ্লে করলে তুমি একজাক্ট সময়টা পেয়ে যাবে। এত কম সময়ে কোনো কিছু করা সম্ভব না। তবু আমি তখন মিউজিয়ামে গিয়েছি সবগুলো পেইন্টিং দেখেছি। কোনো সমস্যা নাই। ভেতরে কাদেরী বক্স ছিল সেও আমার সাথে ঘুরে ঘুরে দেখেছে।”
টুনি ঘুরে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “উনি বলেছেন সব ঠিক আছে? কোনো সমস্যা নাই?”
সিকিউরিটি গার্ড টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। তাই বলেছেন। আর কী বলবেন? কী সমস্যা হতে পারে? দুই মিনিটের মাঝে তো আর কেউ কিছু করতে পারে না। পেইন্টিং এত বড় একটা জিনিস, কে নিয়ে কোথায় নেবে? পুরো বাসায় সিসি টিভি লাগানো ধরা পড়ে যাবে না!”
টুনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর বলল, “আংকেল আমি কি সিসি ক্যামেরার ভিডিওটা দেখতে পারি? যখন ওটা বন্ধ হয়েছিল?”
“অবশ্যই দেখতে পার। কিন্তু দেখার কিছু নাই; খালি একটা হলঘর। সেখানে কেউ নাই।”
“তবু একটু দেখি? প্লিজ।”
সিকিউরিটি গার্ড একটা কম্পিউটার চালু করল। সেটা চালু হতে একটু সময় নিল। তারপর সেই কম্পিউটারের বিভিন্ন ফাইলের ভেতর ঘাটাঘাটি করে একটা ফাইল বের করে সেটা চালু করল। টুনি দেখল কম্পিউটারের মনিটরে পেইন্টিং ঝোলানো হলঘরটা দেখা যাচ্ছে। সিকিউরিটি গার্ড ঠিকই বলেছে, যেহেতু ঘরে একটা মানুষও নাই ভিডিওটা খুবই বোরিং। সত্যিকথা বলতে ভিডিওটা কী চলছে নাকি বন্ধ হয়ে আছে সেটাও বোঝার উপায় নেই।
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে টুনি বলল, “যখন ক্যামেরাটা বন্ধ হয়েছিল সেই অংশটা কোথায়?”
সিকিউরিটি গার্ড বলল, “ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে বের করতে হবে।”
তারপর মাউস দিয়ে এখানে সেখানে টোকা দিয়ে দ্রুত ভিডিওটা চালু করে জায়গাটা বের করে আনল। টুনি তখন ভিডিওটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। আর্ট মিউজিয়ামটা দেখা যাচ্ছে, ভেতরে কেউ নেই, শুধু ছবিগুলো ঝুলছে। হঠাৎ করে পুরোটা অন্ধকার হয়ে গেল। ওপরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ঠিক এক মিনিট একত্রিশ সেকেন্ড পর আবার ক্যামেরা চালু হয়ে স্ক্রিনে আর্ট মিউজিয়ামটা ভেসে উঠল। টুনি কিছুক্ষণ দেখে কেমন যেন একটু উত্তেজিত গলায় বলল, “এই জায়গাটা আবার দেখাবেন প্লিজ।”
“আবার?”
“হ্যাঁ। প্লিজ।”
সিকিউরিটি গার্ড অংশটা আবার দেখাল, দেখে টুনি এবারে আগের থেকে উত্তেজিত গলায় বলল, “আবার দেখাবেন প্লিজ? আবার। আবার!”
সিকিউরিটি গার্ড একটু অবাক হয়ে বলল, “আবার?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কী দেখছে বারবার?”
“আপনি ভালো করে দেখেন, তাহলে আপনিও দেখতে পাবেন।”
মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড আবার দেখাল। নিজেও দেখল কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেল না। হলঘরটা দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ ক্যামেরা বন্ধ হয়ে স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল, একটু পর আবার ক্যামেরা চালু হয়ে হলঘরটা দেখা যেতে শুরু করল।
টুনি উত্তেজিত হয়ে বলল, “দেখলেন? আপনি দেখলেন?”
সিকিউরিটি গার্ড মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি তো আজব কিছু দেখছি!”
টুনি বলল, “কেন দেখছেন না? প্রথমে আপনি দেখছেন সিসি ক্যামেরার ছবি। তারপর এটা এক-দুই মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে আবার যখন চালু হলো তখন সেই দৃশ্যটা আলাদা! সেটা অরিজিনাল সিসি ক্যামেরার ছবি না। সেটা সিসি ক্যামেরার সামনে ধরে রাখা এই ঘরটার একটা ছবি। তাকিয়ে দেখলে ছবিটা একটু খানি আলাদা।”
সিকিউরিটি গার্ড দেখল এবং চমকে উঠে বলল, “মাইয়াগো মাইয়া। কী সর্বনাশ!”
টুনি বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন কী করা হয়েছে? জয়ন্ত কাকুর এই মিউজিয়ামের একটা ছবি তুলে সেই ছবিটা সিসি ক্যামেরার সামনে ঝুলিয়ে রেখে ক্যামেরাটাকে ব্লক করেছে। সেই জন্যে ঘরের ভেতর কী হচ্ছে ক্যামেরাতে দেখা যাচ্ছে না! কিন্তু ঘরের ছবিটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে, তাই কেউ সন্দেহ করছে না।”
সিকিউরিটি গার্ড বলল, “এই ঘরে আরেকটা ক্যামেরা আছে।”
টুনি বলল, “সেই ক্যামেরটাতেও নিশ্চয়ই তাই করেছে।”
সিকিউরিটি গার্ড অন্য ক্যামেরার ভিডিওটাও খুঁজে বের করল এবং দেখা গেল সত্যি সত্যি ঐ ক্যামেরাও দেড় মিনিট বন্ধ ছিল তারপর যখন আবার চালু হলো তখন ক্যামেরায় যেরকম ছবি দেখার কথা সেরকম একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। তবে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ছবিটা ক্যামেরার সত্যিকারের ছবি না।
সিকিউরিটি গার্ড জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “কতক্ষণ এই ঘরটাকে ব্লক করে রেখেছে?”
“পুরো এক ঘণ্টার মতন! মনে নাই আপনি বলেছেন এক ঘণ্টা পর আবার ক্যামেরাগুলো এক দুই মিনিটের জন্য অচল হয়েছিল? তখন ছবিগুলো সরিয়ে আগের মতো করেছে। ততক্ষণে কাজ যা করার করা হয়ে গেছে।”
সিকিউরিটি গার্ড কেমন যেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী কাজ করেছে? তুমি বলেছিলে আমাকে বলবে। বল।”
টুনি বলল, “এই মিউজিয়ামের চারটা ওয়েল পেইন্টিং কেটে সেখানে পেইন্টিংটার একটা ছবি আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আসল পেইন্টিং নাই। যেটা আছে সেটা ভুয়া পেইন্টিং।”
সিকিউরিটি গার্ড চিৎকার করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“বিশ্বাস না করলে আপনি নিজে দেখে আসেন। তবে ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না।”
“কে এই কাজ করেছে?”
“আপনিই বলেন।”
“আমি কীভাবে বলব?”
“আপনি এই বাসায় থাকেন। সিকিউরিটির দায়িত্বে আছেন। আপনি না বললে, কে বলবে?”
“কিন্তু প্রমাণ ছাড়া একজনকে দোষ দিই কেমন করে?”
টুনি কিছু না বলে, উঠে দাঁড়াল। মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড বলল, “কই যাও?”
“বাইরে। দেখি অন্যরা কী করে?”
“কিন্তু পেইন্টিং চোরকে খুঁজে বের করবে না?”
টুনি বলল, “দেখি চিন্তা করে।”
“বেশি করে চিন্তা করো। আমি ভেবেছিলাম তোমার চাচা হচ্ছে। ডিটেকটিভ। তুমিও দেখি ডিটেকটিভ। আরো বড় ডিটেকটিভ।”
“কিন্তু আপনি কাউকে কিছু বলবেন না।”
“না, বলব না।”
টুনি কিছু বলল না, চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
.
দুপুরের খাবার সময় জয়ন্ত কাকু আর ছোটাচ্চু ফিরে এলেন। টুনি ছোটাচ্চুর কাছে গিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?”
“কী কাজ?”
“জয়ন্ত কাকুকে বলতে পারবে দুপুরে লাঞ্চের সময় যেন এই বাসার সবাইকে একটু ডেকে আনে।”
“সবাইকে? কেন?”
“আমি একটা জিনিস দেখেছি সেটা সবাইকে বলতে চাই।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, “কী দেখেছিস?”
“এখন বলব না। সবাইকে এক সাথে বলব।”
ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি নিচু গলায় বলল, “আরো একটা কথা।”
“কী কথা?”
“আমি যেসব কথা বলব তুমি সেগুলো চুপচাপ শুনে যাবে। আপত্তি করবে না।”
“কী বলবি?”
“যখন বলব, তখন শুনো।”
“কী আশ্চর্য।”
টুনি বলল, “কোনো আশ্চর্য না। তুমি দেখো।”
ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে পারল না, তবে টুনি যে শুধু শুধু একরম একটা নাটক করবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
দুপুরে খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে সব রকম খাবার দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে। খাওয়া শুরু করার আগে জয়ন্ত কাকু একটা খালি কাঁচের গ্লাস নিয়ে একটা চামুচ দিয়ে সেখানে টুং টুং শব্দ করে বলল, “ঘোষণা। জরুরি ঘোষণা।”
বাচ্চারা খাবার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে আছে। দৌড়াদৌড়ি করে সাঁতার কেটে পানিতে লাফঝাঁপ দিয়ে সবারই খিদেটা ভালো লেগেছে তাই ঘোষণাটা তাড়াতাড়ি শুনে শেষ করে দিতে চায়। জিজ্ঞেস করল, “কী ঘোষণা?”
জয়ন্ত কাকু বলল, “আসলে ঘোষণাটা দেবে তোমাদের টুনি। টুনি বলেছে বাসার সবার সামনে ঘোষণাটা দেবে। সেজন্য আমি বাসার সবাইকে ডেকেছি।” বলে জয়ন্ত কাকু গলা উঁচিয়ে বলল, “সবাই চলে এসো।”
তখন ডাইনিং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা সবাই একজন একজন করে ঢুকতে শুরু করলে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়াল। টুনি চোখের কোনা দিয়ে দেখল সবার মাঝে ছোটাচ্চুর আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর কাদেরী বশও আছে। কন্ট্রোল রুমের মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড আছে। সকাল বেলার হাসি খুশি ম্যানেজার, ভ্যানের ড্রাইভার, দুজন লাইফগার্ড, বাবুর্চি দারোয়ান সবাই আছে।”
জয়ন্ত কাকু জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের মাঝে টুনি কে?”
টুনি তার চশমাটা ঠিক করে এগিয়ে গেল, বলল, “আমি।”
জয়ন্ত কাকু টুনির সাইজ দেখে অবাক হয়ে বলল, “তুমি টুনি? তুমি ঘোষণা দেবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “জী জয়ন্ত কাকু।”
“ঠিক আছে তাহলে দাও।”
শান্ত বলল, “যা বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল। আমাদের অনেক খিদে পেয়েছে।”
শান্ত ভেবেছিল অন্য সবাই তার কথায় সায় দেবে কিন্তু দেখা গেল খিদে পেলেও সবাই ধৈর্য্য ধরে টুনির কথা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বুঝতে পেরেছে, টুনি নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা বলবে।
টুনি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “আজকে সকালে জয়ন্ত কাকুর বাসায় আসার সাথে সাথে শাহানাপু সবার আগে জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন দেখার জন্যে বেসমেন্টের বড় হলঘরটাতে গেছে। আমিও শাহানাপুর সাথে ছিলাম। শাহানাপু যেকোনো পেইন্টিং দেখে সেটা নিয়ে সবকিছু বলে ফেলতে পারে। সেখানে শাহানাপু কী দেখেছে সেটা এখন একটু বলবে।” তারপর টুনি শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহানাপু বল।”
শাহানা একটু থতমত খেয়ে বলল, “আমি? আমি কেন? তুইই বল।”
টুনি বলল, “না শাহানাপু। তুমি প্রথম লক্ষ করেছ তুমি বল। প্লিজ শাহানাপু।”
শাহানা তখন সবার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, “জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন অসাধারণ। মিউজিয়ামেও এরকম কালেকশান দেখা যায় না। কিন্তু—”
শাহানা একটু থামল এবং সবাই চোখ বড় বড় করে শাহানার দিকে তাকাল।
শাহানা বলল, “কিন্তু এই কালেকশানের চারটা ওয়েল পেইন্টিং চুরি করে সেই ফ্রেমে ভুয়া রিপ্রোডাকশান প্রিন্ট করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সোজা কথায় কোনো একজন পেইন্টিং চোর জয়ন্তাকাকুর চারটা পেইন্টিং চুরি করেছে।”
এবারে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। জয়ন্ত কাকু চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী? কোন চারটা?”
শাহানা বলল, “একটা শাহাবুদ্দিন। একটা কিবরিয়া। একটা আব্দুর রাজ্জাক। আরেকটা কনকচাপা।”
জয়ন্ত কাকু ঘুরে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল, “গার্ড! আর্ট কালেকশনের রুমে সিসি ক্যামেরা আছে না?”
টুনি হাত তুলে বলল, “জয়ন্ত কাকু আমি বলি। এই পেইন্টিং চোর অসাধারণ বুদ্ধিমান। সে এমনভাবে চুরি করেছে যে সিসি ক্যামেরাতে ধরা পড়েনি।”
জয়ন্ত কাকু বলল, “সেটা কীভাবে সম্ভব?”
“ক্যামেরা দুইটাকে আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি দিয়ে ব্লক করেছে। তাই কন্ট্রোল রুমে আর্ট মিউজিয়াম পুরোটা সারাক্ষণ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু আসলে সেটা আসল আর্ট মিউজিয়াম ঘর না। সেটা আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি।”
“কী আশ্চর্য!”
“জয়ন্ত কাকু, আমি আসলে বলা শেষ করিনি।”
“বল, বল, শেষ করো।”
টুনি গলা পরিষ্কার করে বলল, “দেখতেই পাচ্ছেন, আপনি যেটা সন্দেহ করছিলেন সেটা সত্যি বের হয়েছে। আপনি আমাদের বাসায় এসে ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করেছিলেন, ছোটাচ্চু যেহেতু ডিটেকটিভ সেজন্য আপনি ছোটাচ্চুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন আর্ট গ্যালারির সিকিউরিটি কীভাবে দেওয়া যায়? ছোটাচ্চু আপনার কাছ থেকে সময় নিয়েছিল কমপ্লিট একটা প্ল্যান দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর মাঝে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনাকে একটা স্পাই পেন দিয়েছিল।”
কথাগুলো সত্যি না তাই জয়ন্তকাকু কিছু একটা বলতে চাইছিল, টুনি দেখল ছোটাচ্চু জয়ন্তকাকুর হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু বলেছিল এই স্পাই পেনটা আর্ট মিউজিয়ামের হলঘরের মাঝামাঝি কোনো একটা ফ্রেমের ওপর রেখে দিতে। আপনি সেটা রেখে দিয়েছিলেন। পেইন্টিং চোর সেটা জানত না। তাই সে সিসি ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়েছিল সত্যি কিন্তু ছোটাচ্চুর স্পাই পেনকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। স্পাই পেনে তার সব কাজকর্ম রেকর্ড হয়েছে। স্পাই পেনটা মুভমেন্ট না হলে রেকর্ড করে না সেইজন্য ব্যাটারি খরচ হয় না। কাজেই আমাদের কাছে পেইন্টিং চুরির পুরো ভিডিও আছে। সেটা সবাইকে দেখানোর জন্য আপনাদের সবাইকে ডেকে এনেছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে যিনি চুরি করেছেন তিনিও এইখানে আছেন।”
সবাই এবারে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে। টুনির চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখলে কাদেরী বকসের চেহারা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে। মানুষটা দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে সে তার চিকন লাল টাইটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল।
টুনি বলল, “ভিডিওটা দেখার জন্য আমার একটা ল্যাপটপ লাগবে। জয়ন্ত কাকু একটা ল্যাপটপ কী আনা যাবে?”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। অবশ্যই আনা যাবে বলে জয়ন্ত কাকু তার একজন কর্মচারীকে বললেন, “আমার অফিস ঘরের টেবিল থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে আসো দেখি।”
কর্মচারীটা সাথে সাথে অফিস ঘরের দিকে দৌড়াল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “স্পাই পেনটা কোথায়?”
টুনি বলল, “সিকিউরিটি গার্ড আংকেলের কাছে। গার্ড আংকেল দেবেন একটু?”
মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড খুবই গম্ভীর মুখে পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে দিল। টুনি সাবধানে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা কলম বের করল, বলল, “এই যে স্পাই পেন।”
শান্ত বলল, “হায় খোদা! এইটা তো দেখতে একেবারে কলমের মতো।”
“এই জন্যে এইটার নাম স্পাই পেন। এর ভেতরে ভিডিও ক্যামেরা আছে। ইউএসবি পোর্ট আছে। একটু আগে আমরা কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটারে দেখেছি। পুরো ভিডিওটা আছে, এখন সবাইকে দেখাব।”
টুনি কলমের মতো দেখতে স্পাই পেনটা সোজা করে ধরে সবাইকে দেখাতে দেখাতে বলে “এইটার সামনে ক্যামেরাটা। যখন রেকর্ড করে তখন পেছনে একটা সবুজ এলইডি জ্বলে-নেভে। ব্যাটারি কমে গেলে এলইডিটা লাল হয়ে জ্বলে, তখন চার্জ করতে হয়।”
টুনি যখন স্পাই পেনটা উঁচু করে ধরে রেখেছে তখন হঠাৎ যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। কাদেরী বখস হঠাৎ ছুটে এসে একটা লাফ দিয়ে স্পাই পেনটা ছিনিয়ে নিয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিল। সবাই এত হকচকিয়ে গেল যে প্রথমে কয়েক সেকেন্ড কেউ বুঝতেই পারল না কী হচ্ছে। যখন বুঝতে পারল তখন কয়েকজন কাদেরী বখসের পেছন পেছন ছুটল। বাসার বাইরে দৌড়ে গিয়ে কয়েকজন তাকে ধরে ফেলল। হাত থেকে স্পাই পেনটা কেড়ে নিল একজন। তারপর তাকে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে এলো, তাকে ধরে আনার জন্যে চিকন লাল টাইটা খুব কাজে লাগল।
সিকিউরিটি গার্ড তাকে পিছমোড়া করে ধরে রাখল। অতি উৎসাহী একজন একটা ঘুষি মারার চেষ্টা করছিল জয়ন্ত কাকু তখন প্রচণ্ড একটা ধমক দিল, “খবরদার কেউ গায়ে হাত দেবে না।”
কাদেরী বখসকে ধরে জয়ন্ত কাকুর সামনে আনা হলো। মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়েছিল, মাঝখানে সিঁথি করে যত্ন করে চুলকে দুইভাগ করে টাক মাথাটাকে ঢেকে রাখা হয়েছিল এখন সব ওলটপালট হয়ে টাক মাথা বের হয়ে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।
জয়ন্ত কাকু বলল, “কাদেরী সাহেব, আপনাকে আমি বিশ্বাস করে আমার এখানে চাকরি দিয়েছি আর আপনি এরকম একটা কাজ করতে পারলেন? আমার চার-চারটা পেইন্টিং চুরি করলেন। চুরি করতে গিয়ে পেইন্টিংগুলোর কত ডেমেজ করেছেন কে জানে–”
কাদেরী বখস নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে করতে বলল, “স্যার আমি চুরি করতে চাই নাই স্যার। আমি স্যার হাই ফেমিলির ছেলে–জীবনে এই কাজ করি নাই। আমাকে স্যার একজন বাধ্য করেছে। সেই মানুষ অনেক ভয় দেখিয়েছে।”
জয়ন্ত কাকু ধমক দিয়ে বলল, “এসব বাজে কথা বলবেন না। কেউ কাউকে ভয় দেখিয়ে চুরি করাতে পারে না।”
কাদেরী বকস দুই হাত জোর করে বলল, “স্যার, আমাকে পুলিশে দেবেন স্যার। আল্লাহর কসম লাগে স্যার, আমি সব পেইন্টিং ফেরত দেব স্যার। আমার ফেমিলি পথে বসবে স্যার।”
সবাই গোল হয়ে ঘিরে কথাবার্তা শুনেছিল। তখন একজন বলল, “ল্যাপটপ এসে গেছে। চুরির ভিডিওটা আগে দেখি আমরা।” সবাই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখি। স্পাই পেনটা কার কাছে?”
একজন স্পাই পেনটা টুনির হাতে দিল। টুনি সেটা হাতে নিয়ে একটু লাজুক মুখে হেসে বলল, “আসলে কোনো ভিডিও নাই।”
“ভিডিও নাই মানে?” শান্ত চিৎকার করে বলল, “স্পাই পেন ভিডিও রেকর্ড করে নাই?”
টুনি বলল, “এইটা স্পাই পেন না। এইটা শাহানাপুর বল পয়েন্ট কলম।” তারপর কলমটা শাহানাপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “নাও শাহানাপু তোমার কলম।”
শান্ত কেমন জানি রেগে উঠল, “তার মানে, তার মানে–”
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “আমরা জানি চারটা পেইন্টিং চুরি গেছে। কিন্তু কে চুরি করেছে সেইটা তো জানি না। সেইটা ধরার জন্য এই নাটকটা করেছি।”
শান্ত তখনো রেগে আছে। চোখ মুখ লাল করে বলল, “তুই এইভাবে এতজন মানুষের সামনে এইভাবে মিথ্যা কথা বললি কেমন করে?”
যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেছে। প্রথম একজন-দুইজন, তারপর সবাই হাসতে শুরু করেছে। সবার শেষে ব্যাপারটা বুঝতে পারল কাদেরী বকস, তখন তার যা একটা চেহারা হলো সেটা আর বলার মতো না।
জয়ন্ত কাকু সিকিউরিটি গার্ডকে বলল, “আপনি একে নিয়ে যান। যদি আসলেই চারটা পেইন্টিং ফেরত দেয় একটা মুচলেকা লেখিয়ে ছেড়ে দেবেন। যদি না দেয় থানায় হ্যাঁন্ডওভার করেন।”
কাদেরী বকস নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে বলল, “দেব স্যার। ফেরত দেব। খোদার কসম।”
সিকিউরিটি গার্ড কাদেরী বখসের হাত ধরে নিয়ে যাবার আগে টুনির কাছে এসে বলল, “থ্যাংকু টুনি। তুমি চোরকে ধরে না দিলে খুব লজ্জার ব্যাপার হতো! আমাদের চাকরি থাকত না। আমার কোম্পানির বসকে আমি তোমার কথা বলব।”
টুনি বলল, “আপনাকেও থ্যাংকু, আমার সাথে একটিং করতে রাজি হওয়ার জন্য।”
শান্ত বলল, “চল, এখনই খাই।”
সবাই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ খাই। যা খিদে লেগেছে সেটা আর বলার মতো না।”
জয়ন্ত কাকু একটু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল, “তাহলে টুনি, শাহানা, তোমাদের আমি কী পুরস্কার দিতে পারি?”
শাহানা বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। আমাকে মাঝে মাঝে পেইন্টিংগুলো দেখতে দিলেই হবে।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাহলেই হবে।”
জয়ন্ত কাকু স্যান্ডউইচে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “সেটা তো আসতেই পার। যখন খুশি। সেটা তো পুরস্কার হলো না।”
টুনি বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। পেইন্টিং উদ্ধার হয়েছে সেইটাই পুরস্কার।”
জয়ন্ত কাকু বলল, “তোমাদের সবাইকে এক সপ্তাহের জন্যে রাঙামাটি কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনস বেড়াতে পাঠালে কেমন হয়?”
জয়ন্ত কাকুর কথা শুনে সবাই এত জোরে চিৎকার দিল যে কী হয়েছে সেটা দেখার জন্যে বাসার সবাই আবার ছুটে এলো। চিড়িয়াখানার বানরটা ভয় পেয়ে গাছের মগডালে উঠে জান দিয়ে চেঁচাতে লাগল।
এই বাচ্চাদের মতোই!
ফার্স্টবয়
টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে মাঠে ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে দেখছিল। তার বয়সী ছেলেমেয়েরাই সবচেয়ে বেশি কিন্তু টুনি তাদের মাঝে নেই। কীভাবে কীভাবে জানি তার মাঝে একটা বড় মানুষ বড় মানুষ ভাব চলে এসেছে তাই সে আর তার বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না। টিফিনের ছুটিতে বারান্দায় বসে বসে তাদের খেলতে দেখে–মাঝে মাঝে মনে হয় সেটাতেই বুঝি মজা বেশি।
টুনি মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় রাজু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। রাজুও অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে না তবে তার কারণটা ভিন্ন। ক্লাসে তার কোনো বন্ধু নেই, সে বেশির ভাগ সময় একা একা থাকে। রাজু একবার ডান থেকে বাম দিকে গেল তারপর আবার বাম থেকে ডান দিকে গেল। টুনির মনে হলো রাজু হয়তো তার সাথেই কথা বলতে চাইছে, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
তাই যখন রাজু আবার ডান দিকে থেকে বাম দিকে যেতে শুরু করেছে তখন টুনি তাকে ডাকল, “এই রাজু।”
রাজু কেমন জানি চমকে উঠল। বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কী হয়েছে?”
“সবাই কত মজা করে খেলছে, তুই খেলিস না কেন?”
এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া উচিত ছিল পাল্টা প্রশ্ন করে, তুই খেলিস না কেন?’ কিন্তু রাজু প্রশ্নটা না করে মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে কেউ কখনো কোনো খেলায় নেয় না।”
টুনি থতমত খেয়ে গেল, কথাটা মোটামুটি সত্যি কিন্তু এরকম সত্যি কথা কেউ কখনো এভাবে বলে ফেলে না। টুনি কথাটাকে একটা ঠাট্টার মতো ধরে নিয়ে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “তুই খেলবি?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না।”
“তুই যদি নিজেই খেলতে না চাস তাহলে তোকে খেলায় নেবে কেমন করে?”
রাজু কোনো উত্তর দিল না আবার চলেও গেল না। টুনির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথাবার্তা না বলে দুজন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট অস্বস্তির ব্যাপার, টুনি তাই রাজুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। রাজুর সাথে কথা বলার সময় বিষয় মাত্র একটাই হতে পারে, সেটা হচ্ছে লেখাপড়া। তাই টুনি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রাজু, জালাল স্যার যে অঙ্কটা দিয়েছিল সেটা করেছিস? ঔ যে চৌবাচ্চার অঙ্ক–এক দিক দিয়ে পানি আসে অন্যদিক দিয়ে পানি যায়”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। করি নাই।”
এটা রীতিমতো একটা সংবাদ। যে কাজগুলো বাড়ির কাজ হিসেবে দেওয়া হয় রাজু সেগুলো ক্লাসে বসেই করে ফেলে। আর কয়েকদিন আগে দেয়া অঙ্কটা এখনো শেষ করে নাই সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। অঙ্কটা রাজু করেছে নাকি করে নাই টুনির অবশ্যি সেটা জানার আসলে কোনো আগ্রহ নাই, সে শুধু একটা আলাপ চালিয়ে যেতে চাইছিল। তাই এবারে আরেকটা পড়ালেখার প্রশ্ন করল, “বিজ্ঞান স্যার যে আলু দিয়ে কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে দিয়েছিল সেইটা করে দেখেছিস? আসলেই কাজ করে?”
রাজু বলল, “জানি না।”
“এক্সপেরিমেন্টটা করিস নাই?”
“নাহ।” বলে রাজু তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর ওপরের দিকে তাকাল। টুনি আড় চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওপরে দেখার মতো কিছু নাই।
লেখাপড়া নিয়ে আর কী প্রশ্ন করা যেতে পারে টুনি সেটা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। সেরকম কিছু মনে পড়ল না। তখন একটা প্রশ্ন বানাতে হলো। জিজ্ঞেস করল, “নাসরীন ম্যাডামের বাংলা পড়ানো তোর কেমন লাগে?”
“নাসরীন ম্যাডাম? যে নূতন এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী জানি।”
রাজু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “খেয়াল করি নাই।”
টুনি এবারে রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, “খেয়াল করিস নাই?”
“নাহ।”
“তুই খেয়াল করিস নাই? এটা কী হতে পারে?”
রাজু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “লেখাপড়া আর ভালো লাগে না, ছেড়ে দিয়েছি।”
টুনি প্রায় আর্ত চিৎকার দিয়ে বলল, “ছেড়ে দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ।” রাজু আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল। তারপর আবার ওপরের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “লেখাপড়া করে কী হবে? খামোখা।”
টুনি এতক্ষণ ভদ্রতার একটা আলাপ চালানোর চেষ্টা করছিল। এবারে আর দ্রতার আলোচনার মাঝে থাকল না, সত্যিকারের আলোচনার মাঝে চলে এলো। চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস তুই? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? লেখাপড়া করে কী হবে মানে? তুই আমাদের ফার্স্টবয়, তুই লেখাপড়া না করলে কে লেখাপড়া করবে? তোর কী হয়েছে বল। সমস্যাটা কী?”
রাজু কিছু না বলে আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর আবার উপরের দিকে তাকাল, তারপর তাকিয়েই রইল।
টুনি নরম গলায় বলল, “তুই আয়। আমার কাছে বস। আমাকে বল কী হয়েছে।”
রাজু পাশে বসবে টুনি আশা করেনি, কিন্তু তাকে অবাক করে রাজু তার পাশে বসল। তারপর প্রায় এক শ কিলোমিটার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাতের তালুর দিকে তাকাল।
টুনি গলার স্বর আরো নরম করে বলল, “বল আমাকে। কী হয়েছে?”
রাজু মুখ তুলে টুনির দিকে তাকাল তারপর বলল, “তার আগে তুমি বল, তোমার আব্বু আর আম্মু কী ঝগড়া করে?”
টুনি এক মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে গেল। সে যে রাজুর সাথে তুই করে বলছে আর রাজু যে ক্লাসে কারো সাথেই তুই করে কথা বলে না, বলতে পারে
সেটাও সে লক্ষ করল। উত্তর দেওয়ার আগে টুনি ভালো করে রাজুর মুখটা লক্ষ করল, সেটা কেমন যেন দুঃখী একজনের মুখ।
টুনি বলল, “অবশ্যই ঝগড়া করে। পৃথিবীর কোনো আব্বু-আম্মু নাই যারা মাঝে মাঝে ঝগড়া করে না। যদি দেখা যায় কোনো আব্বু-আম্মু ঝগড়া করছে। তাহলে বুঝতে হবে কোনো একটা বড় সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“মনে কর ওয়াইফ-হাজব্যান্ড থেকে বয়সে অনেক ছোট। অনেক ভয় পায় এরকম। তা না হলে যেকোনো হাজব্যান্ড-ওয়াইফ মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাটি করে।”
“তোমার আব্বু আর আম্মু কীভাবে ঝগড়াঝাটি করে?”
টুনি মাথা চুলকাল, তারপর ইতস্তত করে বলল, “সেটা ঠিক জানি না। কোননাদিন আমাদের সামনে ঝগড়া করে নাই।”
রাজু ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেমন করে জান তোমার আব্বু-আম্মু ঝগড়া করে?”
“বোঝা যায়।” টুনি মুখে হাসি টেনে বলল, “দেখা যায় আব্বু-আম্মু কথা বলছে না। খাবার টেবিলে দুজনেই মুখ ভোঁতা করে বসে খাচ্ছে। কিংবা আম্মু খামাখো আমাদের ওপর মেজাজ করছে। কিংবা খারাপ খারাপ কথা বলছে–”
“খারাপ খারাপ কথা?” রাজু এবারে উৎসাহী হলো, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম খারাপ খারাপ কথা?”
টুনি রীতিমতো ডায়ালগের মতো ভঙ্গি করে বলল, “যেরকম মনে কর আম্মুর ফেবারিট খারাপ কথা হচ্ছে–” টুনি তখন রীতিমতো নাটকের ডায়লগের মতো ভঙ্গি করে বলল “আমাকে তো পেয়েছিস একজন দাসী বান্দি? লাট সাহেবদের সেবা করতে করতে জান কালি করে ফেলতে হবে। এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজেরা ঢেলে খেতে পারবে না! এইরকম।”
রাজু একটু অবাক হয়ে বলল, “এইটা সবচেয়ে খারাপ কথা?”
“এই রকমই তো হবে। আর কী হবে?”
“কখনো কখনো—” কিছু একটা বলতে গিয়ে রাজু থেমে গেল।
টুনি বলল, “বল। কী বলতে চাইছিলি বল।”
“বলছিলাম কী–” রাজু ইতস্তত করে বলল, “কখনো তোর আব্বু কী আম্মুর গায়ে হাত তুলে? কিংবা আম্মু—”
টুনি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। মুখ শান্ত করে বলল, “না সেরকম ঘটনা কখনোই ঘটে না। এটা খুব সিরিয়াস ঘটনা। এটা আসলে ঘটা উচিত না। কখনোই ঘটা উচিত না।” টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “তোর আব্বু-আম্মুর বেলায় কী কখনো ঘটেছে?”
“কখনো? রাজু কেমন করে জানি একটা হাসির মতো করে শব্দ করল, তারপর বলল, “প্রত্যেকদিন ঘটে।”
“প্রত্যেকদিন?”
রাজু মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেকদিন। দুজন অফিস থেকে এসে শুরু করে দেয়। খারাপ খারাপ ভাষায় একজন আরেকজনকে গালি দেয়। তারপর এক সময়ে দুজনেই ভাঙচুর করে। আম্মু মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কাঁদে।”
টুনি রাজুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “রাজু–”
“কী?”
“তোর আর বলার দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি।”
“তুমি মোটেই বুঝতে পারছ না। এর ভেতরে নিজে না থাকলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জান?”
রাজু কী বলবে টুনি আন্দাজ করতে পারে, তারপরও জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“মনে হয় ছয়তলা বাসার ছাদে উঠে নিচে লাফ দিই।”
টুনি অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে বলল, “খবরদার–রাজু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “ভয় নাই। লাফ দেব না।”
“গুড।” টুনিও হাসার মতো চেষ্টা করে বলল, “তুই যে আমাকে কথাগুলো বলেছিস সেজন্যে তোকে থ্যাংকু।”
“সবাই বলে তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি–”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “না না। আমার মাথায় মোটেও অনেক বুদ্ধি না। চৌবাচ্চার অঙ্কটা কীভাবে শুরু করব তার মাথা-মুণ্ড পর্যন্ত আন্দাজ করতে পারছি না। তুই যখন করবি তখন আমাকে বলিস।”
রাজু বলল, “লেখাপড়ার বুদ্ধি এক রকম আর আসল বুদ্ধি অন্যরকম। দুইটার মাঝে কোনো সম্পর্ক নাই।”
রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি, তুমি আমাকে বলবে আমি কী করব?”
টুনির রাজুর জন্যে খুব কষ্ট হলো। সে এখন তাকে কী বলবে? জিজ্ঞেস করল, “এখন তুই কী করিস?”
“কানে আঙুল দিয়ে ঘরে বসে থাকি। আগে জোর করে লেখাপড়া করতাম এখন আর লেখাপড়া করার ইচ্ছা করে না।”
টুনি বলল, “আমি আসলে তো কখনো এরকম অবস্থায় পড়ি নাই, এরকম কিছু দেখি নাই তাই ঠিক কী করতে হয় সেটা জানি না। তবে আমার মনে হয় তুই যেটা করছিস সেটা ঠিকই করছিস।”
“কী করছি?”
“এই যে আমাকে বলছিস।”
“বললে কী হয়?”
“আমি শুনেছি, মনে কষ্ট থাকলে সেটা নিয়ে আরেকজনের সাথে কথা বললে কষ্ট কমে।”
রাজু কিছু না বলে টুনির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “শুধু একটা ব্যাপার।”
“কী ব্যাপার?”
“আমি তোকে তুই করে বলছি আর তুই আমাকে তুমি করে বলছিস!”
রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি কাউকে তুই করে বলতে পারি না।”
“চেষ্টা করে দেখ। খুবই সোজা।”
“কীভাবে চেষ্টা করব?”
টুনি বলল, “তুই আমাকে বল, তুই একটা গাধা।”
“তোমাকে গাধা বলব?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি তো গাধা না।”
“এত প্যাচালে হবে না। বলে ফেলতে হবে। তাহলে এভাবে বল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”
রাজু মুখটা হাসি হাসি করে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”
টুনি বলল, “গুড! দেখলি কত সোজা। এবারে আরেকটা কিছু বল।”
“বলব?”
“হ্যাঁ।”
রাজু বলল, “তুই প্লিজ আমার কথা ক্লাসে আর কাউকে বলিস না তাহলে আমার খুব লজ্জা লাগবে।”
টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমি ক্লাসে কাউকে বলব না।”
.
টুনি ক্লাসে কাউকে বলল না কিন্তু বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা অনেকের সাথে আলোচনা করল। যেকোনো বড় সমস্যা হলে প্রথমেই ঝুমু খালার সাথে আলাপ করে, এবারেও তাই করল। তাকে সবকিছু খুলে বলার পর জানতে চাইল, এখন কী করা উচিত।
।ঝুমু খালার উত্তর দিতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “জরিনি বেওয়ার পান পড়া। একটা পান পড়া খেলেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মহব্বত ফিরে আসবে। আমাদের গ্রামে কাজেম আলী মোল্লার ছিল দুই বউ। বড় বউ একদিন—”
টুনি ঝুমু খালাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, তোমার মনে নাই আমি তোমাদের গ্রামে গিয়েছি? জরিনি বেওয়ার সাথে কথা বলেছি? জরিনি বেওয়া নিজে আমাকে বলেছে তাবিজ-কবজ-পান পড়া বলে কিছু নাই”
ঝুমু খালা মোটেও দমে গেল না। হাত পা নেড়ে বলল, “তোমার মতো ছোট মেয়েরে আর কী বলবে? জরিনি বেওয়ার যে পোষা জীন আছে সেইটা কী তোমারে বলছে? বলে নাই। সত্যি কথা বললে তোমাগো দাঁত কপাটি লাগব না?”
টুনি বলল, “তাবিজ-কবজ-পান পড়ার কথা ভুলে যাও। অন্য কিছু করা যায় কী না বল।”
“এই হলো তোমাগো সমস্যা। চাইর পাতা বই পড়ে মনে করে দুনিয়ার সবকিছু জেনে গেছে। সবকিছু অবিশ্বাস কর। তাবিজ-কবজ মানতে চাও না।”
টুনি ধৈর্য ধরে ঝুমু খালার বক্তৃতা শুনল, বক্তৃতা শেষে ঝুমু খালা আরেকটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “নতুন যে হিন্দি সিরিয়ালটা শুরু হইছে জিগি জিগি পেয়ার সেইখানে এইরকম একটা ঘটনা আছে। নায়িকার ব্লাড ক্যান্সার। হাসপাতালে নিছে–”
টুনি বুঝতে পারল ঝুমু খালাকে দিয়ে হবে না। তখন সে গেল ছোটাচ্চুর কাছে। সবকিছু শুনে ছোটাচ্চু বলল, “দুইজন যখন কমিটমেন্ট করে তখন যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ না থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে প্রেসক্রিপশনার ফর ডিসাস্টার। আমি তো বুঝতেই পারি না একজন বড় মানুষ ঝগড়া করে কেমন করে?”
টুনি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি বুঝতে পার না? মনে আছে যখন তুমি আর ফারিহাপু ঝগড়া করে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলে? আমরা যদি তখন–”
ছোটাচ্চু লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে সেটা তো ছিল খুবই হাস্যকর একটা ব্যাপার–”
“মোটেও হাস্যকর ছিল না। এখন তুমি বল আমি আমাদের ক্লাসের ছেলেটাকে কী করতে বলব?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “হলিউডের একটা সিনেমা দেখেছিলাম, সেখানে একটা মেয়ে তার বাবা আর মায়ের মাঝে মিল করে দিয়েছিল।
“কীভাবে?”
“অনেক জটিল কাহিনি এখন ভুলে গেছি।”
টুনি বুঝল ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলে লাভ নাই। ছোটাচ্চু এখনো বিয়েও করে নাই। আগে বিয়ে করুক তারপর বউয়ের সাথে ঝগড়া করুক তারপর দেখা যাবে।
তখন টুনি তার দাদির (কিংবা নানির) সাথে কথা বলল। সবকিছু শুনে দাদি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন, “আহারে! এই টুকুন বাচ্চা ছেলের মনে কী কষ্ট। যদি স্বামী-স্ত্রী এইভাবে বাচ্চার সামনে ঝগড়া করে তাহলে তো মুশকিল। ডিভোর্স না হয়ে যায়। ডিভোর্স হলে বাচ্চাটার কী হবে?”
দাদি অনেকক্ষণ আহা উঁহু করলেন, তারপর বললেন, “চেষ্টা করে দেখ মা’টাকে আমাদের বাসায় আনা যায় নাকি। আমি তাহলে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু বুঝিয়ে দেখি।”
টুনি বুঝতে পারল দাদির বুদ্ধিটাও কাজ করবে না। রাজুর মা’কে সে কেমন করে বাসায় আনবে? আর সমস্যা কী শুধু তার মায়ের? তার বাবারও নিশ্চয়ই সমস্যা আছে।
তখন টুনি তার আম্মুর সাথে কথা বলল। আম্মু বেশ অবাক হয়ে টুনির কথা শুনলেন। তার ছোট মেয়েটার যে বড় মানুষদের সমস্যা নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে সেটা দেখে আম্মু খুব অবাক হলেন না। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন মেয়েটা একটু অন্যরকম।
টুনির কথা শেষ হবার পর আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে আমি সবকিছু শুনলাম। এখন?”
“এখন তুমি বল রাজু কী করবে?”
“তোর কী ধারণা রাজুর কিছু একটা করার আছে যেটা করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”
টুনি মাথা চুলকালো, বলল, “না, মানে–”
“দোষটা কী রাজুর? সে কি কিছু একটা দোষ করেছে যে জন্যে তার আব্বু আম্মু এরকম হয়ে গেছে?”
“না। তা নয়।”
“তাহলে ছেলেটা কী করবে? কিছু যদি করতে হয় তাহলে সেটা করবে তার বাবা-মা। ছেলেটার সামনে ঝগড়াঝাটি করা বন্ধ করবে।”
টুনি আবার মাথা চুলকাল। আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখ, হাজব্যান্ড আর ওয়াইফের মাঝে মিলমিশ না হওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক না। সেজন্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়-আমেরিকার অর্ধেক বিয়ে ডিভোর্স হয়ে যায়। আমাদের দেশে আগে মেয়েরা সহ্য করত সেইজন্যে বিয়ে ভাঙতো না, আজকাল এতো সহ্য করে না। ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন এদেশেও ডিভোর্স হলে সমস্যাটা কী হয় জানিস?”
“কী?”
“যদি ছোট বাচ্চা-কাচ্চা থাকে তাহলে এই বাচ্চাগুলো মনে করে দোষটা তাদের। তারা কিছু একটা ভুল করেছে সেই জন্যে বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে।”
“তাহলে রাজুর কিছু করার নাই?”
“আমি তো কিছু চিন্তা করে পাই না। তুই তার ভালো বন্ধু হয়ে থাকিস যেন তোর কাছে এসে দুঃখের কথাগুলো বলতে পারে। কাউকে দুঃখের কথা বললে মনটা হালকা হয়—”
.
কাজেই টুনি রাজুর ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য চেষ্টা করে গেল। দেখা হলেই মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করে, “রাজু, তোর খবর কী?”
রাজু বেশির ভাগ সময় উত্তর দেয়, “নূতন কোনো খবর নাই।”
“লেখাপড়া শুরু করেছিস।”
“নাহ্।”
“শুরু করে দে, না হলে আমরা বিপদে পড়ব।”
“তোমাদের কী বিপদ?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু উঁহু হলো না।”
“কী হলো না।”
“তোমাদের বলা যাবে না। ঠিক করে বল।”
“ও আচ্ছা।”
রাজু তখন ঠিক করে বলে, “তোদের আবার কী বিপদ?”
“স্যার ম্যাডাম যখন ক্লাসে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কেউ উত্তর দিতে না পারলে কেমন রেগে যায় দেখিস না। তুই উত্তর দিয়ে আমাদের বিপদ কাটিয়ে দিবি।”
রাজু হাসার ভঙ্গি করে বলে, “ও আচ্ছা।”
টুনি আরো কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে, নিজ থেকে তার আব্বু আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করে না। রাজুও কিছু বলে না। টুনি অবশ্যি রাজুকে চোখে চোখে রাখে। তাদের ক্লাস একতলায় কিন্তু রাজুকে প্রায়ই দেখা যায় দুই-তিন তলায় ঘোরাঘুরি করে। ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর সবাই চিৎকার করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায় শুধু রাজুকে দেখা যায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে যেন বাসায় যাবার কোনো তাড়া নেই।
একদিন রাজু এসে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “টুনি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“উঁহু। হলো না হলো না।”
রাজুর তখন মনে পড়ে, সে একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কী কথা?”
“ভূত বলে কী কিছু আছে?”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “ভূত?”
“হ্যাঁ।”
“তোর ভূত নিয়ে মাথা ব্যথা কিসের জন্যে? ভূত থাকবে কোথা থেকে?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আমারও তাই মনে হয়, ভূত নাই। কিন্তু মাহতাব চাচা এমনভাবে বলে যে মনে হয় ভূত আছে।”
মাহতাব চাচা তাদের স্কুলের গার্ড, তার সাথে রাজুর ভূত নিয়ে আলোচনা কেন হচ্ছে টুনি বুঝতে পারে না। টুনি ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই মাহতাব চাচার সাথে জিন-ভূত নিয়ে আলাপ করছিস, ব্যাপারটা কী?”
রাজু কেমন যেন একটু লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে এইতো–”
টুনি জিজ্ঞেস করল, মাহতাব চাচা ভূত নিয়ে ঠিক কী বলেছে? কোথায় ভূত দেখেছে?”
“এইতো আমাদের স্কুলে। রাত্রে বেলা এইখানে নাকি ভূত দেখা যায়।”
“সত্যি?” টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “কী রকম ভূত?”
রাজু বলল, “ছায়ার মতন। বারান্দা দিয়ে হাঁটে। জানালা খুলে বন্ধ করে।”
টুনি বলল, “কী মজা। একটা যদি কোনোমতে ধরে ফেলতে পারি চিন্তা করতে পারিস কী মজা হবে? শিশিতে ভরে পকেটে করে বাসায় নিয়ে যেতাম। পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতাম।”
রাজু বলল, “ভূত শিশিতে আটবে?”
“আটবে না কেন। চিপে চুপে ঢুকিয়ে ফেলব।”
টুনি একটা ভূতকে চিপে চুপে একটা শিশিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দৃশ্যটা চিন্তা করে রাজু একটু হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে তুই ভূত বিশ্বাস করিস না?”
“ভূতের গল্প বিশ্বাস করি। ভূতে করি না।”
“তোকে যদি কেউ বলে এই স্কুলে রাত্রের বেলা একা একা থাকতে হবে তাহলে থাকতে পারবি?”
“কেউ যদি বাজি ধরে তাহলে চেষ্টা করতে পারি, তা না হলে কেন খামোখা রাত্রে এই স্কুলে থেকে মশার কামড় খাব? দিনের বেলাতেই এইখানে থাকতে অসহ্য লাগে, আবার রাত্রে?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। স্কুলে অসহ্য লাগে।”
.
কয়দিন পর টুনি দুপুর বেলা বারান্দায় বসে অন্যদের ছোটাচ্চুটি করে খেলতে দেখছে তখন রাজু এসে তার পাশে বসল। বলল, “চৌবাচ্চার অঙ্কটা করেছি।”
টুনি খুশি হয়ে বলল, “করেছিস? গুড। আমাকে দেখিয়ে দিস কীভাবে করতে হবে। আমি বুঝি না কেন একটা অঙ্ক এরকম প্যাচিয়ে দিতে হবে। সোজাসুজি দিতে সমস্যা কী?”
“সোজাসুজি দিলে সেইটা হিসাব। যোগ-বিয়োগ আর গুণ-ভাগ। প্যাচিয়ে দিলে সেইটা অঙ্ক।” রাজু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি তুই অঙ্ক করতে চাস না কেন?”
টুনি দেখল আজকাল রাজুকে আর তুই করে বলার কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে না নিজেই তুই করে বলছে। টুনি বলল, “আসলে বুদ্ধি নাই সেজন্যে।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে তুই বুদ্ধিটা এখানে সেখানে খরচ করতে চাস না। আসল বুদ্ধির জায়গায় খরচ করতে চাস, তাই না?
টুনি হাসল, বলল, “আসল বুদ্ধির জায়গা কোনটা?”
“যেমন মনে কর–” রাজু মুখটা সুচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “মনে কর একটা তালাকে এমন কিছু করতে চাই যেন সেইটা আর কাজ না করে–তাহলে কী করতে হবে?”
“কাজ না করে মানে কী? তালা বন্ধ হবে না, নাকি তালা খুলবে না?”
“তালা বন্ধ হবে না।”
“কেন?”
রাজু উত্তর দিল না, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “এমনি।”
টুনি বলল, “সবচেয়ে সোজা হচ্ছে চিউয়িংগাম খেয়ে সেইটা তালার গর্তে ঠেলে ভর্তি করে রাখা–তাহলে আর বন্ধ করতে পারবে না।”
রাজু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটু হেসে বলল, “এত সোজা।”
“একটা জিনিস নষ্ট করা সবসময় সোজা। ঠিক করা হচ্ছে কঠিন।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তোর মাথায় আসলেই অনেক বুদ্ধি।”
টুনি হাসল, বলল, “এইগুলো আসল বুদ্ধি না। এইগুলো হচ্ছে দুষ্টু বুদ্ধি।”
“তোর মাথায় নিশ্চয়ই ভালো বুদ্ধিও আছে। দেখি পরীক্ষা করে।”
“কীভাবে পরীক্ষা করবি?”
“মনে কর একজন বেশ কয়েকদিনের জন্য এডভেঞ্চারে যাবে, যেখানে কোনো খাওয়া-দাওয়া পাওয়া যায় না। তাহলে তার সাথে কী নিয়ে যেতে হবে যেন না খেয়ে থাকতে হয় না।”
টুনি উত্তর না দিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে রাজুর দিকে তাকাল, বলল, “তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”
রাজু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না–”
“তাহলে–?”
“এমনিই জিজ্ঞেস করছি। এমনি”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এমনি কেউ এগুলো জিজ্ঞেস করে না। সত্যি করে বল, তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”
“না। আমি বাড়ি থেকে পালাব না।” “তাহলে কেন এটা জিজ্ঞেস করছিস?”
“তোর বুদ্ধি টেস্ট করার জন্য। ঠিক আছে তোর বলতে না চাইলে বলতে হবে না।”
“এটা বুদ্ধি টেস্ট করার কিছু না। এর মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। এটা জানার বিষয়।”
“ঠিক আছে।” রাজু মেনে নিল। বলল, “তুই জানলেও তোর বলতে হবে না।”
“আমি খুব বেশি জানি না, কিন্তু দাদির কাছে শুনেছি সেভেন্টি ওয়ানে সবাই যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছিল তখন সাথে নিত চিড়া।”
“চিড়া?”
“হ্যাঁ। শুধু চিড়া। খিদে লাগলে চিবিয়ে একটু খেয়ে নিলেই পেট ভরে যেত। এজন্যে বলে শুকনো চিড়া পেট ভরে খেতে নেই। এটা নাকি পেটে গিয়ে ফুলে যায়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, চিড়া শুকনা, নষ্ট হতো না। দিনের পর দিন রাখা যেত।”
“ইন্টারেস্টিং।”
“আজকাল অবশ্যি আরো অনেক কিছু বের হয়েছে। হাই প্রোটিন বিস্কুট। প্যাকেট দুধ। হাই এনার্জি ড্রিংক।”
“চিড়াই ভালো। একেবারে সহজ সরল।”
টুনি আবার চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে তাকাল, বলল, “দেখ, রাজু, খবরদার তুই বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। রাস্তা-ঘাট কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। ভয়ানক কোনো বিপদে পড়ে যাবি।”
রাজু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”
“খোদার কসম?”
“আমি এই সব কিরা-কসমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুই যদি সত্যি শুনতে চাস তাহলে বলব।”
“বল।”
“খোদার কসম। আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”
টুনি সরু চোখে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
একদিন সরকারি ছুটি, একদিন স্কুল ছুটি তার সাথে শুক্র-শনিবার মিলে পরপর চারদিন স্কুল ছুটি। যখনই এরকম কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যায় তখন সেই ছুটিতে কোথায় যাওয়া হবে কী করা হবে সেটা নিয়ে নানারকম আলোচনা হয় কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। এবারে যেরকম সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে শান্ত খবর আনল চিড়িয়াখানায় নতুন এক ধরনের বানর আনা হয়েছে। সেগুলোকে বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর কথা, কিন্তু সেই শ্যাম্পু পাওয়া যাচ্ছে না বলে বানরকে গোসল করানো যাচ্ছে না এবং সেই কারণে পুরো চিড়িয়াখানায় বিকট দুর্গন্ধ। এই বর্ণনা শুনে অনেকেই পিছিয়ে গেল বলে শেষ পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় যাওয়া হলো না। তারপর ঠিক করা হলো সবাই মিলে নাটক দেখতে যাবে। কোন নাটক দেখা হবে সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হওয়ায় সেটাও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেল। তখন ঠিক করা হলো শপিং মলে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া হবে। সেজেগুঁজে যখন সবাই বের হবে তখন টুম্পা হড় হড় করে বমি করতে লাগল। আইসক্রিম খাওয়াতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ টুম্পার, কাজেই তাকে ছাড়া তো আর যাওয়া যায় না কাজেই এই প্রোগ্রামটাও বাতিল করতে হলো এবং সে কারণে সবাই কয়েকদিন থেকে বাসায়।
ছুটির তৃতীয় দিন রাত্রি বেলা বাসায় দুজন গেস্ট এলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী, চেহারা দেখেই মনে হয় তাদের ওপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে। কেউ বলে দেয় নাই তারপরেও দরজা খুলেই টুনি বুঝতে পারল এরা হচ্ছেন রাজুর বাবা-মা এবং রাজু তার কথা রাখে নাই, সে বাসা থেকে পালিয়েছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা টুনিকে দেখে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “মা, তুমি নিশ্চয়ই টুনি। আমার রাজু কোথায় তুমি জান?”
অন্য যে কেউ হলে তার পুরো বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় লাগত, টুনির কথা আলাদা তার বুঝতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। রাজু বাসা থেকে পালিয়েছে, রাজুর বাবা-মা তার স্কুলের ছেলেমেয়ে আর টিচারদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছে। গত কিছুদিন থেকে রাজু টুনির সাথে নিরিবিলি কথাবার্তা বলেছে সেটা নিশ্চয়ই অনেকে লক্ষ করেছে। তারা টুনির নাম বলেছে তাই বাবা মা টুনির কাছে চলে এসেছেন।
টুনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই মা হাঁটু গেড়ে বসে টুনিকে দুই হাতে ধরে ফেললেন তারপর প্রায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “মা, তুমি জান আমার রাজু কোথায়? জান?”
“না। জানি না। কিন্তু–কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“আমি আন্দাজ করতে পারি”
মা প্রায় চিৎকার করে বললেন, “তাহলে আন্দাজ করো। বল।”
টুনি রাজুর আম্মুর হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি আগে একটু শান্ত হয়ে বসেন। আমাকে একটু চিন্তা করতে হবে।”
বসার ঘরে হই-চইয়ের শব্দে বাসার প্রায় সবাই চলে এসেছে। সবার সামনে ঝুমু খালা তার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে তার বক্তৃতা শুরু করে দেবে। ছোটদের অনেকেই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, তারা একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে। বড়দেরও অনেকে এসেছে, ছোটাচ্চু বাচ্চাদের শান্ত করার চেষ্টা করল, ধমক দিয়ে বলল, “তোরা চুপ করবি? শুনি কী হয়েছে।”
টুনি সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে আন্টি আর আংকেল। আমাদের ক্লাসের যে ফার্স্টবয় রাজু, তার আম্মু আর আব্বু। আমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছেন।”
বাচ্চারা সব কিছু বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। শান্ত বলল, “ফার্স্টবয়! উরে বাপরে বাপ।”
টুনি বলল, “আমি আন্টির সাথে আর আংকেলের সাথে একা একা কথা বলব, তোমরা সবাই যাও।”
কেউ চলে যাবার নিশানা দেখাল না। তখন ছোটাচ্চু সবাইকে ঠেলে বের করে দিতে থাকে। ছোট-বড় সবাই বের হয়ে যাবার পর টুনি জিজ্ঞেস করল, “আমাকে একটু বলবেন রাজু কখন বাসা থেকে চলে গেছে।”
“পরশু দিন স্কুলে গেছে, তারপর আর বাসায় আসে নাই।”
“রাজু কী যাওয়ার আগে আপনাদের কোনো চিঠি লিখে গেছে।”
রাজুর আম্মু আর আন্ধু একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন, তারপর দুজনের অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে বসলেন। রাজুর আম্মু নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আব্বু একটু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “ইয়ে মানে একটা চিঠির মতো কিছু একটা লিখে গেছে। তার ঘরে পড়ার টেবিলের ওপর ছিল।”
“কী লিখেছে চিঠিতে?”
রাজুর আব্বু আবার একটু কাশলেন, তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “লিখেছে মানে যেন মানে আমরা যেন ইয়ে–” কথা শেষ না করে রাজুর আব্বু থেমে গেলেন।
টুনি বুঝতে পারল, চিঠিটায় কী লিখেছে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। টুনি তাই জিজ্ঞেস করল, “চিঠিটা সাথে আছে?”
রাজুর আব্বু আবার রাজুর আম্মুর দিকে তাকালেন তারপর রাজুর আম্মু তার ব্যাগ খুলে একটা চিঠি বের করে টুনির হাতে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ছোট চিঠি। চিঠিতে লেখা :
প্রিয় আব্বু আর আম্মু :
আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে লাভ নেই, আমাকে তোমরা খুঁজে পাবে না। খুব ইচ্ছা করছে। কোনো একটা জায়গায় শান্তিতে কয়েকদিন থাকি যেখানে তোমরা দুজন দিন-রাত ঝগড়া করছ না। মাঝে মাঝে মনে হয় পাগল হয়ে যাব। তোমরা এরকম কেন? আমার জন্য অস্থির হয়ো না, নিজে থেকেই কোনো একদিন চলে আসব।
রাজু।
টুনি চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম।”
টুনির আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী ভাবছিলে?”
“যে এইরকম কিছু একটা করে ফেলবে।”
“তোমার সাথে এইটা নিয়ে কথা বলেছে?”
“সরাসরি বলে নাই, কিন্তু তার কথা থেকে আন্দাজ করেছি।”
রাজুর আম্মু খপ করে টুনির হাত ধরে ফেললেন। ভাঙা গলায় বললেন, “আমার ছেলেটাকে বের করে দাও মা, প্লিজ। কোথায় আছে একা একা–”
টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল, আপনারা এখন বাসায় যান। আমি দেখি। খুঁজে বের করে আপনাদের জানাব।”
এরকম সময় দরজা ঠেলে ঝুমু খালা একটা ট্রেতে চা-নাশতা নিয়ে ঢুকল। টেবিলে রেখে বলল, “একটু চা-নাশতা খান। আপনাদের দেখে মনে হয় কয়দিন কিছু খান নাই।”
“ছেলেটা হারিয়ে গেছে, খাব কেমন করে?”
“হারায়ে যায় নাই, পালায়ে গেছে। আপনাগো চিন্তার কারণ নাই, টুনি খুঁজে বের করে ফেলবে। টুনির মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”
“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।
ঝুমু খালা ধমক দিয়ে বলল, “সব কথার মাঝে তোমার একটা কথা বলার স্বভাব।”
ধমক খেয়ে টুনি চুপ করে গেল। কুমু খালা এবারে রাজুর আম্মুকে উপদেশ দিতে শুরু করল, “আফা, আপনাদের একটা কথা বলি। বাচ্চা জন্ম দিলেই কিন্তু দায়িত্ব শেষ না। বাচ্চারে ঠিক করে মানুষ করতে হয়। বাচ্চারে আদর করতে হয়। বাচ্চার সামনে যদি ঝগড়াঝাটি করেন–”
টুনি ঝুমু খালাকে থামানোর চেষ্টা করল, বলল, “ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা টুনিকে উল্টো একটা ধমক দিল, “আমি একটা কথা বলতেছি তুমি মাঝখানে ডিস্টার্ব দাও কেন?” তারপর ঘুরে রাজুর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করতে হয় না। বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করলে বাচ্চা অমানুষ হয়ে যায়। আমাগো গ্রামে স্বামী-স্ত্রী বাচ্চার সামনে ঝগড়া করত, সেই বাচ্চা বড় হয়ে ডাবল মার্ডারের আসামি।”
টুনি এবারে রীতিমতো গলা উঁচিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, আন্টি আর আংকেল এখন খুব টায়ার্ড। তারা বাসায় গিয়ে রেস্ট নেবেন। তার আগে আমার সাথে একটু কথা বলবেন।”
ঝুমু খালা চলে যাবার পর টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল আপনারা কিছু মনে করবেন না। ঝুমু খালা সব সময় সবার সাথে এইভাবে কথা বলে।”
রাজুর আম্মু বললেন, “কিন্তু কথাটা তো ভুল বলে নাই। আসলেই আমরা তো রাজুর সামনেই ঝগড়াঝাটি করি। বুঝতে পারি নাই রাজুকে এইভাবে এফেক্ট করবে—”
টুনি বলল, “জী রাজুও বলেছে আমাকে। এত ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। খুব মন খারাপ করে থাকে।”
রাজুর আব্বু রাজুর আম্মুর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমি একশবার বলেছি ছেলেটার দিকে তাকাও, কিন্তু তোমার সময় নাই।”
রাজুর আম্মু দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিস হিস শব্দ করে বললেন, “কেন? আমাকেই কেন সব দেখতে হবে? তোমার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই?”
রাজুর আব্বু হতাশ হবার ভঙ্গি করে বললেন, “এই যে, এই যে আবার শুরু করে দিলে।”
“আমি? আমি শুরু করেছি?”
টুনি অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এরকম অবস্থাতেও টুনির সামনে যদি দুজন ঝগড়া শুরু করে দেয় তাহলে বাসাতে নিশ্চয়ই দুজনে খুনোখুনি করে ফেলে। টুনির হঠাৎ করে রাজুর জন্য মায়া হতে থাকে।
রাজুর আব্বু-আম্মু সত্যি সত্যি ঝগড়া শুরু করে দেয়ার আগে টুনি তাদের থামানোর চেষ্টা করল। বলল, “আংকেল, আন্টি, আপনারা নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। আপনারা একটু খেয়ে নেন, তারপর বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। আমি রাজুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।”
“তুমি জান সে কোথায় আছে?”
“এখনো জানি না, কিন্তু মনে হয় বের করতে পারব।”
রাজুর আম্মু তখন আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। টুনি কী করবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে একটু পরে আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে দুজনে ঝগড়া করবেন। বড় মানুষেরা এরকম বোকা কেন?
.
রাজুর আব্বু-আম্মু চলে যাবার পর সবাই এসে টুনিকে ঘিরে ধরল। তারা জানালার পাশে বসে সবকিছু শুনেছে এখন আরো শুনতে চায়। কী হয়েছে জানতে চায়। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কোথায় আছে জানিস?”
ঝুমু খালা বলল, “নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়ি। এই বয়সী ছেলেরা বেশি দূর যাইতে পারে না।”
শান্ত বলল, “সেন্ট মার্টিনস। আমি যদি কখনো বাড়ি থেকে পালাই তাহলে সেন্ট মার্টিনস যাব। আগে থেকে বলে রাখলাম।”
টুম্পা বলল, “উঁহু। নিশ্চয়ই কোনো বন্ধুর বাসায় গেছে।”
টুনি বলল, “না। আমার মনে হয় স্কুলে লুকিয়ে আছে।”
সবাই এক সাথে চিৎকার করে বলল, “স্কুলে?”
প্রমি বলল, “ইয়া আল্লাহ। কী বোরিং। কেউ কখনো পালিয়ে স্কুলে যায়?”
টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটা, তুমি আমাকে একটু স্কুলে নিয়ে যাবে?”
সবগুলো বাচ্চা এক সাথে চিৎকার করে বলল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”
টুনি বলল, “না, না, এটা নিয়ে মোটেও হইচই করা যাবে না। যদি জানাজানি হয় রাজু স্কুলে থাকছে–তার অনেক ঝামেলা হতে পারে।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুচকে বলল, “তাহলে? তাকে খুঁজে বের করবি কীভাবে?”
“তুমি গার্ড চাচাকে একটু ব্যস্ত রাখবে আমি ভেতরে গিয়ে রাজুকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসব।”
“আমি? আমি কীভাবে ব্যস্ত রাখব?”
“গার্ড চাচা বিশ্বাস করে আমাদের স্কুলে ভূত আছে। তুমি ভূত নিয়ে আলোচনা করতে পার।”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি! এই রাত্রে গার্ডের সাথে ভূত নিয়ে আলোচনা করব?”
“সমস্যা কী? ভান করবে তুমি সাংবাদিক।”
.
কাজেই ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে তাদের স্কুলে হাজির হয়েছে। টুনি একটু দূরে লুকিয়ে রইল তখন ছোটাচ্চু গিয়ে স্কুলের গেটে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে একজনের গলার শব্দ শোনা গেল, “কে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি।”
“আমি কে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে চিনবেন না। আমি একজন সাংবাদিক।”
এবারে স্কুলের গার্ড মাহতাব চাচা ভেতর থেকে তালা খুলে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনার সাথে কথা আছে।”
“কী কথা?”
“ভেতরে এসে বলি। গেটে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না।”
মাহতাব চাচা খানিকটা অনিচ্ছা এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে গেট থেকে সরে দাঁড়াল। মাহতাব চাচা আবার গেটে তালা দিতে চাচ্ছিল তখন ছোটাচ্চু বলল, “তালা মারবেন না। খোলা থাকুক।”
“কেন?”
“আমার ফটোগ্রাফার সিগারেট কিনতে গেছে। সে আসবে।”
মাহতাব চাচা সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল,
গেটের পাশে ছোট একটা ঘর, এখানে মনে হয় মাহতাব চাচা থাকে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “এইটা আপনার ঘর?”
“হ্যাঁ।”
“আসেন, আপনার ঘরে বসি। একটু বসে কথা বলি।” বলে মাহতাব চাচাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তার ঘরে ঢুকে গেল এবং ঠিক তখন টুনি সুড়ৎ করে গেটটা একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে স্কুলের বিল্ডিংয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার ছোট ঘরটার ভেতরে ঢুকে বলল, “আমি আসলে একটা নিউজ করতে চাই।”
“নিউজ?”
“হ্যাঁ। ভূতের ওপরে নিউজ।”
মাহতাব চাচা এইবারে একটু নড়ে চড়ে উঠল। “ভূতের ওপর?”
“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি শুনেছি এই স্কুলটাতে নাকী ভূত আছে। এইটাতো অনেক পুরনো বিল্ডিং, পুরনো বিল্ডিংয়ে সবসময় ভূত থাকে। আপনি যেহেতু এইখানে রাতে থাকেন তাই জানতে চাইছিলাম আপনি কী রাতে কখনো কিছু দেখেছেন? শুনেছেন?”
মাহতাব চাচা বিড় বিড় করে কিছু একটা দোয়া পড়ে বুকে একটু থুতু ফেলল, তারপর গলা থেকে ঝুলে থাকা প্রায় ঢোলের মতো বড় একটা তাবিজকে হাত দিয়ে ধরে বলল, “আপনি ভুল শুনেন নাই। এই স্কুলে তেনাদের ভয় আছে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “তেনারা কারা? তারা কী করে?”
“তেনাদের নাম রাত্রে নিতে চাই না।”
“কিন্তু কী করে?”
“হাঁটে। সারারাত স্কুলের বারান্দা দিয়া হাঁটে।”
“দেখতে কী রকম?”
মাহতাব চাচা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেইটা কবে কেডা? তারে কাছে থেকে কে দেখতে যাবে? আমার জানের মায়া নাই? কয়দিন থেকে মনে হয় উৎপাত বাড়ছে।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুচকালো, জিজ্ঞেস করল, “উৎপাত বেড়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে বুঝলেন?”
“গতরাতে স্পষ্ট শুনলাম বাথরুমে ফ্লাশ করল।”
“ভূতে বাথরুমে ফ্লাশ করল? তার মানে ভূত বাথরুম করে? বড়টা নাকি ছোটটা?”
“কবে কেডা।”
মাহতাব চাচা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কী দেখতে গেছি নাকি? আমার জানের মায়া নাই?”
ছোটাচ্চু যখন মাহতাব চাচার সাথে এরকম একটা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন টুনি স্কুলের বড় বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। তুই কোথায়?”
টুনি একটা একটা ক্লাসঘরের সামনে দিয়ে হাঁটে। আবছা অন্ধকারে দরজার তালা পরীক্ষা করে। কোনো একটা তালা নিশ্চয়ই চিউয়িংগাম দিয়ে নষ্ট করে রেখেছে, সেই ঘরে রাজু আছে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে বসে থাকবে কে বলেছে? হয়তো অন্ধকারে অন্য কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাই টুনি হেঁটে যেতে যেতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। আমি টুনি। তোর ভয় নাই, বের হয়ে আয়। বের হয়ে আয়। কেউ জানবে না।”
তিন তালার ক্লাসরুমগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় চাপা অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো একজন এগিয়ে এলো, এক মুহূর্তের জন্যে টুনি চমকে ওঠে, চাপা গলায় বলে, “রাজু?”
“হ্যাঁ। তুই এখানে কী করছিস?”
“তুই কথা রাখিস নাই। তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি বাসা থেকে পালাবি না।”
“উঁহু।” রাজু চাপা গলায় বলল, “আমি বাসা থেকে পালাব না বলি নাই। আমি বলেছিলাম নিজেকে বিপদের মাঝে ফেলব না। আমি কোনো বিপদে পড়ি নাই। মশার কামড়ে কোনো বিপদ নাই।”
“আছে। ডেঙ্গু না হলে চিকুনগুনিয়া অনেক বড় বিপদ।”
“মশার কয়েল আছে।”
“ফাজলামি করবি না।” টুনি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “কী খাচ্ছিস? চিড়া?”
“হ্যাঁ।”
“আর কিছু?”
“নাহ্।”
“সময় কাটাস কেমন করে?”
“দিনের বেলা বই পড়ি?”
“রাত্রে?”
“চিন্তা করি?”
“কী চিন্তা করিস?”
“এইতো। এইটা সেইটা।”
“মাহতাব চাচার ভূতের সাথে দেখা হয়েছে?”
“এখনো হয় নাই।” রাজু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “তুই এখানে এসেছিস কীভাবে? তোকে কে বলেছে?”
“তোর, আব্বু-আম্মু।”
“সত্যি? রাজুর গলার স্বরে কেমন যেন ঠাট্টার মতো শোনাল, “আমি ভেবেছিলাম এখনো হয়তো জানেই না যে আমি বাসায় নাই।”
টুনি বলল, “ফাজলামি করবি না। তোর আব্বু-আম্মু পাগলের মতো হয়ে গেছে।”
“তারা কোথায়? স্কুলে এসেছে?”
“না। আমি আনি নাই। বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি তোকে খুঁজে পেলে জানাব।”
“ও।“
দুজন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর টুনি নরম গলায় বলল, “চল, এখন যাই।”
“বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা করছে না।”
“ঠিক আছে তোর বাসায় যেতে হবে না। আমাদের বাসায় চল।”
“উঁহু। সবার সামনে লজ্জা করবে।”
“কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় কোনো নরমাল মানুষ নাই। সব এবনরমাল। গেলেই বুঝতে পারবি। আয়।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “যেতে চাই না।”
টুনি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে রাজুর হাত ধরার চেষ্টা করল, বলল, “আয়। দুই দিন থেকে না খেয়ে আছিস। আমাদের বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ভালো করে খাবি। ঝুমু খালা অসাধারণ রান্না করতে পারে।”
“ঝুমু খালা কে?”
“গেলেই দেখবি। আয়। তোর কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় সবাই পাগল। সবাই তোর জন্যে অপেক্ষা করছে?”
“সবাই? আমার জন্য অপেক্ষা করছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“মনে হয় কেমন করে বাসা থেকে পালাতে হয় সেটা তোর কাছ থেকে শিখবে।”
এই প্রথম রাজু হেসে ফেলল।
একটু পরেই টুনি যেভাবে নিঃশব্দে ঢুকেছিল ঠিক সেভাবে নিঃশব্দে রাজুকে নিয়ে বের হয়ে এলো। মাহতাব চাচা টের পেল না কিন্তু ছোটাচ্চু চোখের কোনো দিয়ে ঠিকই লক্ষ করল। ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি ছিল, সেটাকে এবারে দ্রুত শেষ করে দিল। হাত তুলে মাহতাব চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থামেন থামেন।”
মাহতাব চাচা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ভয় করছে।”
“ভয় করছে?”
“হ্যাঁ, এই দেখেন হাত-পা কাঁপছে।” ছোটাচ্চু বেশ জোরে জোরে তার হাত কাঁপাতে থাকল।
মাহতাব চাচা বেশ অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাচ্চু বলল, “আমি একলা থাকি, রাত্রে ভয় পেতে পারি। আরেকদিন দিনের বেলা এসে বাকিটা শুনব। আমার বন্ধুটা সিগারেট কিনে আসার কথা ছিল, সে আসল না। এখন একলা বাসায় যেতে হবে।”
“কেন আসল না?”
“মনে হয় ভয়ে। তার ভূতের অনেক ভয়।”
ছোটাচ্চু মাহতাব চাচাকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু চলে যাবার পর মাহতাব চাচার মনে হলো কোন পত্রিকায় কবে তার ভূত সংক্রান্ত ইন্টারভিউ ছাপা হবে সেটা জিজ্ঞেস করা হলো না।
.
রাজুকে বাসায় এনে টুনি তার আবু-আম্মুকে ফোন করে জানালো যে তাকে পাওয়া গেছে তবে আজকের রাতটা এই বাসাতেই কাটাবে। আম্মু রাজুর সাথে টেলিফোনে কথা বলতে চাইলেন, টুনি তখন রাজুকে টেলিফোনটা ধরিয়ে দিল। ওই পাশে তার আম্মু কী বললেন শোনা গেল না, এই পাশে রাজু অবশ্যি হু-হা ছাড়া আর কিছু বলল না। সে যখন সাবধানে চোখ মোছার চেষ্টা করল তখন সবাই সেটা না দেখার ভান করে সরে গেল।
রাজু গোসল করে শান্তর ঢলঢলে ঘুমের কাপড় পরে এলো। ঝুমু খালা তার জন্যে খাবার গরম করল। আলাদা করে গরম ভাত রান্না করল। ছোটাচ্চু একটা আইসক্রিমের প্যাকেট কিনে নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলে সবাই রাজুর চারপাশে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে কে কীভাবে বাসা থেকে পালাবে এবং বাসা থেকে পালিয়ে কে কোথায় যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। বাসা থেকে পালিয়ে যাবার সময় সাথে কী কী নিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো এবং পুরো সময়টা ঝুমু খালা এই ব্যাপারে সবাইকে নানা ধরনের উপদেশ দিতে থাকল।
রাজুকে স্বীকার করতেই হলো, টুনি তাকে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, এই বাসার মানুষগুলো আসলেই পাগল, এবনরমাল!
সে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহা, তার পরিচিত সবাই যদি এরকম এবনরমাল হতো।
সাপ
স্কুলে ঢুকে টুনি যখন নিজের ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছে তখন লক্ষ করল একেবারে গেন্দা সাইজের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে কোথায় জানি হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা ক্লাস ওয়ান কিংবা টুয়ের বেশি হবে না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “এই! তোরা কই যাস?”
দলটার সামনের দিকে চশমা পরা একটা মেয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে।”
টুনি অবাক হয়ে বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে? কেন?”
“আমরা একটা ভ্যারাইটি শো করব। সেইটার পারমিশান নেবার জন্য।”
“তোরা ভ্যারাইটি শো করবি? সেইটা কী জিনিস?”
এবারে একটা ছেলে উত্তর দিল। তার মনে হয় ঠাণ্ডা বেশি লাগে কারণ তার একটা সোয়েটারের ওপরে একটা জ্যাকেট এবং গলায় মাফলার। সে খুবই গম্ভীর গলায় বলল, “ভ্যারাইটি শো হচ্ছে যেখানে নাচ-গান-আবৃত্তি নাটক এই সব হয়।”
“তোরা এই সব করবি?”
এবারে পুরো দলের সবাই একসাথে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
একজন যোগ করল, “নাটকও হবে।”
চশমা পরা মেয়েটা বলল, “হ্যাঁ। নাটকও হবে।”
“নাটকের নাম কী?”
“প্রেতাত্মার অট্টহাসি। ভৌতিক নাটক।”
টুনি চমৎকৃত হলো। জিজ্ঞেস করল, “কার লেখা নাটক?”
“পূর্ণা।” বলে কয়েকজন পূর্ণাকে সামনে ঠেলে দিল। পূর্ণারও চোখে চশমা এবং সত্যিকারের নাট্যকারের মতো তার উশকোখুশকো চুল। তবে নাট্যকারের মতো সে গম্ভীর নয়, তার চোখে-মুখে লাজুক হাসি।
“কী সাংঘাতিক।” টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, “যা তোরা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে। পারমিশান নিয়ে আয়।”
ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চাদের মোটামুটি বড়োসড়ো দলটি আবার গুটি গুটি পায়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসের দিকে রওনা দিল।
.
ক্লাসরুমে ঢুকে টুনি দেখল সেখানে একটা জটলা। নিজের সিটে ব্যাগটা রেখে দেখল মেঝেতে কাঁচের টুকরো এবং তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। এরা এই ক্লাসের দুষ্টু ছেলেগুলোদের কয়েকজন। এদের উৎপাতে মোটামুটি সবাই অতিষ্ঠ। কী হচ্ছে বোঝার জন্যে টুনি দাঁড়িয়ে গেল তখন দুজন মারামারি শুরু করে দিল। কয়েকজন তাদের টেনে আলাদা করে দেয়। যে বেশি মারকুটে নাম সবুজ, সে চিৎকার করে বলল, “আমি এক্ষুনি যাব প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে নালিশ করতে। তোরা সাক্ষী। তোরা বল, কে আগে শুরু করেছে? কে?”
যাদেরকে সাক্ষী মানা হয়েছে তাদের কাউকেই কে আগে শুরু করেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেল না। একজন বলেই ফেলল, “দিন-রাত মারামারি করিস লজ্জা করে না? আবার আগে-পরে নিয়ে ঘোট পাকাস?”
আরেকজন বলল, “জানালার কাঁচ ভেঙেছিস, এখন ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকবে–”
আরেকজন বলল, “সেই জন্যেই তো ভেঙেছে, যেন ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে আর আমরা ক্লাস করতে না পারি।”
সবুজ নামের মারকুটে ছেলেটা হিংস্র মুখে বলল, “আমি গেলাম প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে নালিশ করতে। তোরা কে যাবি আমার সাথে?”
টুনি বলল, “আমি যাব।”
সবুজ অবাক হয়ে বলল, “তুই? তুই কেন যাবি?”
“তুই না সাক্ষী চাইছিস। আমি সাক্ষী দেব।”
সবুজ থতমত খেয়ে বলল, “তুই-তুই-তুই কী সাক্ষী দিবি?”
“যেটা দেখেছি সেটা।”
সবুজকে আড়ালে অনেকেই ষণ্ডা সবুজ ডাকে। তার সাথে আরো কয়েকজন থাকে তারা বলল, “আয় সবুজ আমরা যাব তোর সাথে। কুনো চিন্তা নাই।”
তারা টুনিকে নিতে চাইছিল না কিন্তু টুনি তাদের পিছু পিছু গেল। স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুবই সুইট, কোনো দরকার ছাড়াই তার সাথে যখন খুশি দেখা করতে যাওয়া যায়।
প্রিন্সিপাল খুলল, “আসতে পর দরজার ঝোল
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসের দরজার ঝোলানো পর্দা সরিয়ে সবুজের দলের একজন বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম দরজায় দাঁড়ানো সবুজ এবং তার দলবলের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার বলার ইচ্ছা করছে, না, তোমরা আসতে পার না। কিন্তু সেইটা তো বলা যাবে না। তোমাদেরকে আসতে দিতে হবে। এসো। এসে এই পাশে দাঁড়াও।”
সবাই যখন ভেতরে ঢুকল তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টুনিকে দেখতে পেলেন, একটু অবাক হয়ে বললেন, “তুমি? তুমি এদের সাথে কেন?”
টুনি মুখ কাচুমাচু করে বলল, “এইখানে কী হয় দেখতে চাচ্ছিলাম।”
“ও আচ্ছা, সার্কাস দেখতে এসেছ?”
“অনেকটা সেইরকম।”
সবুজ এবং তার দল চোখ পাকিয়ে টুনির দিকে তাকাল, টুনি সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “সার্কাস দেখার জন্যে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি এই সুইট বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। তোমরা কী জানো এই বাচ্চাগুলো নিজেরা নাটক লিখেছে, নিজেরা অভিনয় করবে, নিজেরা ডিরেকশান দেবে?”
টুনি বলল, “জানি ম্যাডাম।”
“কী অসাধারণ!” তারপর বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ যেটা বলছিলাম। অবশ্যই আমি তোমাদের পারমিশান দেব। পারমিশানের জন্য একটা এপ্লিকেশন পর্যন্ত লিখে এনেছ, সেখানে কোনো বানান পর্যন্ত ভুল নেই শুধু একটা শব্দের প্রয়োগ পুরোপুরি ঠিক হয় নাই–”
উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার মেয়ে রীতিমতো ভুরু কুচকে বলল, “কোন শব্দ ম্যাডাম?”
“তোমরা লিখেছ এই স্কুলে বিদ্যা আরোহণের পাশাপাশি আমরা উৎসব করতে চাই। এখানে আরোহণ হবে না, হবে আহরণ। বিদ্যা আহরণ করে আর গাছে আরোহণ করে। বুঝেছ?”
নাট্যকারের সাথে সাথে অন্যরাও মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যপাশে দাঁড়ানো সবুজের দলটি দেখিয়ে বললেন, “এই যে এরা সবসময় বাদরামো করে। কাজেই আমরা বলতে পারি এই বানরের দল বৃক্ষে আরোহণ করবে আর তোমরা বিদ্যা আহরণ করবে–”
এই তুলনামূলক আলোচনায় বাচ্চাগুলো খুবই আনন্দ পেল এবং কয়েকজন মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হেসে ফেলল। সবুজ এবং তার দলবল চোখ পাকিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকাল এবং বাচ্চাগুলো সাথে সাথে ভয়ে হাসি বন্ধ করে ফেলল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা দুই মিনিট অপেক্ষা করো, তোমাদের কী লাগবে না লাগবে আমি দেখছি।”
তারপর সবুজের দলটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন তোমরা বল কী জন্যে এসেছ।”
সবুজ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ম্যাডাম আমরা একটা কমপ্লেন নিয়ে এসেছি।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুচকে বললেন, “দাঁড়াও, তুমি সবুজ না?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর তোমরা লাল নীল বেগুনি–”
সবুজের সাঙ্গোপাঙ্গ ম্যাডামের ঠাট্টাটা ধরতে পারল না। ছোট বাচ্চারা ঠিকই ধরতে পারল এবং তারা আবার হি হি করে হেসে উঠল তখন সবুজ আবার তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল এবং বাচ্চাগুলো আবার ভয় পেয়ে হাসি বন্ধ করল।
সবুজ আরেকবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ম্যাডাম, আমরা একটা কমপ্লেন করতে এসেছি। আমাদের ক্লাসে–”
ম্যাডাম হাত তুলে থামালেন, বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি আরেকবার তোমার দলবল নিয়ে কমপ্লেন করতে এসেছিলে না? পরে দেখা গেল তুমিই হচ্ছ কালপ্রিট? তুমি বুঝে গিয়েছ অন্য কেউ কমপ্লেন করার আগেই তুমি কমপ্লেন করে ফেলবে, তাহলে পরে তোমাকে ধরা যাবে না–অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স?”
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে ম্যাডাম–”
“এর আগেরবার একটা চেয়ার ভেঙেছিলে। এইবারে কী ভেঙেছ?”
সবুজ আমতা আমতা করতে লাগল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি জান? কিছু কী ভেঙেছে?”
“ক্লাস রুমে ভাঙা কাঁচ। জানালার কাঁচ ভেঙেছে কিন্তু কে ভেঙেছে আমি দেখি নাই।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে নিজের মাথা কিছুক্ষণ চেপে ধরে রেখে বললেন, “শোনো সবুজ। তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা একটু আধটু দুষ্টুমি করবে সেটা আমি মেনেই নিয়েছি। আমি সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করি। কিন্তু দুষ্টু এক জিনিস আর পাজি অন্য জিনিস। আগে তুমি দুষ্টু ছিলে, এখন তোমার প্রমোশন হয়েছে, তুমি দুষ্ট্র থেকে পাজি হয়েছ। পাজি ছেলেমেয়েদের কীভাবে সোজা করতে হয় আমি কিন্তু সেটা জানি।”
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু ম্যাডাম আগে আমি শুরু করি নাই। জিজ্ঞেস করে দেখেন—”
“কী শুরু কর নাই?”
সবুজ বুঝতে পারল কথাটা বলা ঠিক হয় নাই। তাই এবারে মুখ বন্ধ করে রাখল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী শুরু করো নাই?”
টুনি সাহায্য করল, বলল, “ক্লাসে একটু মারামারি হয়েছে, সবুজ মনে হয় তার কথা বলছে। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার নিজের মাথা চেপে ধরলেন, বললেন, “শুধু জানালার কাঁচ ভাঙেনি, মারামারিও হয়েছে?”
টুনি আবার সাহায্য করার চেষ্টা করল, বলল, “বেশি সিরিয়াস মারামারি না, হালকা একটু হাতাহাতি। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ এবারে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “নিজেরা নিজেরা আবার মিটমাট করে নিয়েছে। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ এবারে আরো জোরে জোরে মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “দেখো সবুজ, তোমরা বড় হয়েছ, আমি আশা করব তোমরা দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু উল্টোটা হচ্ছে তোমরা দিনে দিনে দায়িত্বহীন হয়ে যাচ্ছ।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছোট বাচ্চাদের দলটিকে দেখিয়ে বললেন, “অথচ দেখো, এই ছোট বাচ্চারা মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে তারা নিজেরা নিজেরা একটা অনুষ্ঠান অর্গানাইজ করছে। গান কবিতা আবৃত্তি করছে। নিজেরা নাটক লিখেছে সেটা অভিনয় করবে। এদেরকে দেখে তোমার লজ্জা হওয়ার কথা।”
সবুজ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল, খুব লজ্জা হলো বলে মনে হলো না। বাচ্চাগুলোর ওপর উল্টো তার খুব রাগ হলো সেটা অনুমান করা যায়। টুনি দেখল সবুজের চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হতে শুরু করেছে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “যাও এখান থেকে। বিদায় হও। আর শুনে রাখো, তোমার বিরুদ্ধে যদি আর কোনোদিন কোনো নালিশ আসে তাহলে আমি তোমাকে সিধে করে দেব। মনে থাকবে?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “এখন দূর হও আমার সামনে থেকে।”
সবাই বের হয়ে গেল, টুনিও পিছু পিছু বের হয়ে এলো। বাইরে বের হয়েই সবুজ হিংস্র গলায় বলল, “আমি আন্ডাবাচ্চাদের নাটক করা বের করছি।”
টুনি বলল, “কী বললি? তুই কী বললি?”
সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “কিছু বলি নাই।”
“বলেছিস। আমি শুনেছি।”
“যদি শুনেছিস তাহলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?” বলে সবুজ গট গট করে দলবল নিয়ে হেঁটে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।
টুনি একটু দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে গেল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন, সবুজ আগে দুষ্টু ছিল। এখন প্রমোশন হয়ে পাজি হয়েছে। দুষ্টু ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমস্যা হয় না কিন্তু পাজিদের নিয়ে অনেক সমস্যা। এই পাজি সবুজটা ছোট ছোট ক্লাস টুয়ের ছেলেমেয়েদের পেছনে লেগে গেলে তো অনেক ঝামেলা হবে।
টুনি স্কুলের বারান্দায় চিন্তিত মুখে বসে রইল। বাচ্চাগুলোকে একটু সাবধান করে দিতে হবে।
.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। ক্লাস টুয়ের বাচ্চাগুলো পুরো সপ্তাহ রিহার্সাল করেছে। তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই। যেদিন ভ্যারাইটি শো
সেদিন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের সকলের ক্লাস ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা সকাল থেকে স্টেজ সাজাচ্ছে। নানা রকম রঙিন কাগজ কেটে কেটে স্কচ টেপ দিয়ে পেছনে লাগানো হচ্ছে, স্টেজটা একটা ভ্যারাইটি শো’-এর স্টেজ মনে না হয়ে বিয়েবাড়ির মত দেখাচ্ছে কিন্তু সেটা নিয়ে কারো খুব মাথাব্যথা নেই।
টিফিন ছুটির ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। ক্লাস টুয়ের ক্লাসরুমটা বেশি বড় না, নিজেদের ছেলেমেয়ে দিয়েই বোঝাই হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান দেখার জন্যে অন্য ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়েরাও এসেছে, সবাই মোটামুটি গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। স্টেজের বাম পাশে দরজার কাছাকাছি সবুজ তার ছোট বিপজ্জনক দলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে এক ধরনের বাঁকা হাসি দেখলেই বুক ধক করে ওঠে।
সবুজের দল কী করে ফেলে সেটা দেখার জন্যে কিংবা সম্ভব হলে সামাল দেওয়ার জন্য টুনিও সবুজের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। টুনি অনুষ্ঠান থেকে বেশি চোখ রাখছে সবুজের দিকে। দুষ্টু মানুষ কখন কী করবে আন্দাজ করা যায় কিন্তু পাজি মানুষ কখন কী করবে বলা খুব মুশকিল।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে মিলে লাল পরি নীল পরি গানটা গেয়ে যখন মাত্র শেষ করেছে তখন সবুজ হঠাৎ স্টেজের সামনে লাফ দিয়ে দাঁড়াল, তারপর আঙুল দিয়ে স্টেজের নিচে দেখিয়ে চিৎকার করে বলল, “সাপ! সাপ! সাপ!”
সবাই তার আঙুল দিয়ে দেখানো স্টেজের নিচের জায়গাটার দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল সত্যি সত্যিই একটা মোটাসোটা সাপ সেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।
সবুজের সাথে সাথে তার দলের অন্যরাও ‘সাপ! সাপ!’ বলে চিৎকার করতে করতে ঘরের মাঝে লাফালাফি দাপাদাপি করতে লাগল।
তখন পুরো ক্লাসরুমটাতে একটা ভয়ংকর অবস্থা শুরু হয়ে গেল। স্টেজের ওপর যে গানের দলটা ছিল তারা সেখানেই লাফাতে লাগল, একজন আরেকজনকে ধরে চিৎকার করতে লাগল। স্টেজের পাশে যারা ছিল তারা লাফ দিয়ে কাছাকাছি জানালার ওপর ঝুলে পড়ে চিৎকার করতে লাগল। যারা দর্শক ছিল তারা যে যেখানে আছে প্রথমে সেখানে লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতে থাকল। কয়েকজন দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল, তাদের পেছনে পেছনে যারা আসছিল তারা তাদের ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে শুরু করল। কয়েকজন বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে সেখানে লাফাতে লাগল। চিৎকার চেঁচামেচি হইচই কান্নাকাটিতে পুরো ঘরটার যা একটা অবস্থা হলো সেটা বলার মতো না।
টুনি সবুজের পরিকল্পনাটা শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চাদের ভ্যারাইটি শো তখন আসলেই ‘ভ্যারাইটি শো হয়ে গেছে। কী করছে চিন্তা না করেই টুনি স্টেজের দিকে ছুটে গেল। লাফ দিয়ে স্টেজে উঠে সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, “চুপ। সবাই চুপ। একেবারে চুপ। যে যেখানে আছিস সেখানে দাঁড়িয়ে যা।”
তার চিৎকার সবাই শুনবে সেইটা সে আশা করে নাই–কিন্তু সবাই শুনল। তার কথামতো সবাই একেবারে চুপ না করলেও একটু শান্ত হলো। যে যেখানে আছে সেখানে দাঁড়িয়ে গেল। টুনি তখন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী মাস?”
এবারে সবাই চুপ করে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। যখন স্টেজের নিচে একটা ভয়ংকর সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে তখন এইটা কোন মাস সেই বিষয়টা কেন জানতে হবে?”
টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “কোন মাস?”
এবারে একজন সাহস করে রিনরিনে গলায় বলল, “ডিসেম্বর।”
“বাংলা কোন মাস?”
কেউই জানে না কিংবা কারো বলার সাহস নেই তাই টুনি নিজেই বলে দিল, “পৌষ মাস।”
তখন একজন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি এখন কেন এটা জিজ্ঞেস করছ?”
তার আগে বল, “এইটা কি গরম কাল, নাকি বর্ষাকাল নাকি শীতকাল?”
কয়েকজন ভয়ে ভয়ে বলল, “শীতকাল।”
“তোরা জানিস না শীতকালে সাপ গর্ত থেকে বের হয় না?”
কেউই জানত না তাই তারা ভয়ে ভয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। জানালায় ঝুলে থাকা উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু এই যে বের হয়েছে?”
“তার কারণ হচ্ছে এইটা নকল সাপ। এই দ্যাখ।”
এবারে পুরো ক্লাসের বাচ্চা-কাচ্চা চুপ করে গেল। তারা অবাক হয়ে দেখতে লাগল কী হয়। টুনি তখন স্টেজ থেকে নেমে সাপটার কাছে গেল। উবু হয়ে বসে সাপটার দিকে তাকাল, সাপটা একেবারে স্থির হয়ে কুকুতে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টুনির যে একটু ভয় করছিল না তা নয় কিন্তু তার পরেও সে খপ করে সাপটার ঘাড়ে ধরে টেনে আনল। তার ধারণা সত্যি, এটা রবারের তৈরি সাপ কিন্তু দেখতে হুবহু সত্যিকারের সাপের মতো।
সাপটা ধরে সবাইকে দেখানোর সাথে সাথে পুরো ক্লাসে নৃতন করে অন্য ধরনের একটু হট্টগোল শুরু হলো। প্রেতাত্মার অভিনয় করবে বলে যে মেয়েটি মুখে রং মেখে জানালার শিক ধরে ঝুলছে সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু এইটা কী আসলেই নকল সাপ? তাহলে নড়ছে কেন?”
“এইটা মোটেই নড়ছে না, আমি ঝুলিয়ে রেখেছি বলে নড়ছে। এই দ্যাখ–”
টুনি রবারের সাপটা মেয়েটাকে দেখানোর জন্যে তার কাছে নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু সেই মেয়েটা তার প্রেতাত্মার রং মাখা মুখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল, বলল, “ভয় করে। আমার ভয় করে। সাপকে আমার অনেক ভয় করে। নকল সাপকেও ভয় করে।”
তার সাথে সাথে আরো কয়েকজন বলল, “হ্যাঁ আপু, নকল সাপটা মনে হচ্ছে জীবন্ত। আমাদের ভয় করে।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “সাপটা আসলেই কী নকল?”
টুনি সাপটার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “হ্যাঁ নকল। বিশ্বাস না করলে এই যে সাপটার পেটের মাঝে তাকিয়ে দ্যাখ, লেখা আছে মেড ইন চায়না। সত্যিকারের সাপের পেটের মাঝে কখনো লেখা থাকবে মেড ইন চায়না?”
একটা ছোট ছেলে রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল, “যদি চাইনিজ সাপ হতো?”
এবারে বেশ কয়েকজন হেসে উঠল। একজন বলল, “চাইনিজ হলে চাইনিজরা এটাকে খেয়ে ফেলতো তাই না আপু?”
টুনি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “হ্যাঁ মনে হয় খেয়ে ফেলতো। কিন্তু এইটা রবারের, এইটা কেউ খাবে না।”
এবারে অনেকেই নকল সাপটা দেখার জন্যে টুনির কাছে ছুটে আসতে লাগল। যারা সাহসী তারা ছুঁয়ে দেখল। যারা বেশি সাহসী তারা রীতিমতো হাতে ধরে টিপেটুপে দেখল। টুনি কিছুক্ষণ তাদেরকে দেখতে দিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো তোদের ভ্যারাইটি শো দেখতে এসেছি। রবারের সাপ দেখতে আসি নাই।”
উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার মেয়েটা জানালা থেকে নেমে এলো, জিজ্ঞেস করল, “আবার করব?”
“করবি না কেন? শুরু কর।”
সবাই ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। শুধু প্রেতাত্মা মেয়েটি জানালার শিক ধরে ঝুলে থেকে বলল, “আপু, তুমি সাপটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা কেমন করে নাটক করব? আমার সাপ অনেক ভয় করে।”
“রবারের সাপও ভয় পাস?”
“হ্যাঁ। দেখলেই শরীরের মাঝে কী রকম জানি ইলি বিলি করে।”
ইলি বিলি জিনিসটা কী টুনির জানার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখন মনে হয় এইটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করার সময় না। সে সাপটা কয়েকবার গোল করে প্যাচিয়ে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি এইটা সরিয়ে অন্য জায়গায় রেখে আসছি। তোরা অনুষ্ঠান শুরু কর।“
“ঠিক আছে আপু। ঠিক আছে।” বলে বাচ্চাগুলো আবার ছোটাচ্চুটি শুরু করে দিল।
.
টুনি ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। দূরে একটা গাছের নিচে সবুজ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টুনি তাদের না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি অফিসের দিকে রওনা দিল।
কিছুক্ষণের মাঝেই আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। নাচগান আবৃত্তি এবং নাটক। অনুষ্ঠানের শুরুতে দর্শকরা খুবই সভ্য-ভব্য হয়েছিল কিন্তু সাপ নিয়ে হই চই করার কারণে দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে একটুখানি জংলি হয়ে গেছে। যেখানে শুধু হাততালি দিলেই হয় সেখানে তারা টেবিলে থাবা দিল। যেখানে টেবিলে থাবা দিলেই হয় সেখানে চিৎকার করল, আর যেখানে একটুখানি চিৎকার করা যায় সেখানে তারা বেঞ্চে উঠে লাফালাফি করল। অনুষ্ঠান খুবই ভালো হলো শুধু কবিতা আবৃত্তি করার সময় একজন মাঝামাঝি এসে ভুলে গিয়ে অন্য একটা কবিতা বলে ফেলল। নাচটাও খুবই ভালো হতো কিন্তু মাঝখানে শাড়ি খুলে যাওয়ার কারণে সেটাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে হলো। দর্শকরা সবচেয়ে পছন্দ করল নাটকটা, কিন্তু ভৌতিক নাটক হওয়ার পরও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মাঝে মাঝেই হি হি করে হাসতে শুরু করার কারণে নাটকটাতে ভৌতিক ভাব না এসে একটা হাসির ভাব চলে এসেছিল। শুধু তাই না এতবার রিহার্সাল দেওয়ার পরও বাচ্চাগুলো ডায়লগ ভুলে যাচ্ছিল তখন তারা বানিয়ে বানিয়ে ডায়লগ দিতে শুরু করল। বানানো ডায়লগগুলো আসল ডায়লগ থেকেও হাসির হওয়ার কারণে শেষের দিকে আসল ডায়লগ না বলে সবাই বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুরু করল, সেইজন্যে নাটকটা একটু লম্বা হয়ে গেল। উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার রেগে মেগে স্টেজে এসে ধাক্কাধাক্কি করার কারণে হঠাৎ করে নাটকটা শেষ হয়ে গেল।
টুনি অবশ্যি নাটকের শেষের দিকে মনোযোগ দিতে পারছিল না কারণ তখন কোথা থেকে সবুজ এসে হাজির হয়েছে। সে টুনির পাশে দাঁড়িয়ে খুবই কাচুমাচু মুখ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলতে শুরু করল, জিজ্ঞেস করল, “সাপটা কই?” (টুনি পুরো ব্যাপারটা বোঝার পরেও না বোঝার ভান করল। জিজ্ঞেস করল, “সাপ? কোন সাপ?”
“ঐ যে স্টেজের নিচে ছিল। রবারের সাপ।”
“ও!” টুনি বোঝার ভান করল, বলল, “কেন?”
“না। মানে ইয়ে–জানতে চাচ্ছিলাম।”
“বাচ্চারা দেখে ভয় পায়, সেইজন্যে লুকিয়ে রেখেছি।”
সবুজ মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, “সাপটা দিবি আমাকে?”
টুনি চোখ কপালে তুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “দেব? তোকে? তোকে কেন দেব?”
“সাপটা আসলে আমার। আমি এনেছিলাম।”
“তোর? তুই রেখেছিলি?”
সবুজ বোকার মতো হাসার ভঙ্গি করে বলল, “হ্যাঁ। এমনি বাচ্চাদের সাথে একটু মজা করার জন্য।”
টুনি চোখ লাল করে বলল, “একটু মজা করার জন্য? বাচ্চারা কত কষ্ট করে সবকিছু রেডি করেছে আর তুই এসে দিয়েছিস সবকিছু নষ্ট করে? তুই কী রকম মানুষ?”
সবুজ অপরাধীর মতো ভঙ্গি করে বলল, “আসলে গাধামো হয়েছিল। আর হবে না। খোদার কসম।”
“ঠিক আছে। আর যেন না হয়। যদি হয় তাহলে কিন্তু খবর আছে।”
সবুজ মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল, একটু পরে, উশখুশ করে বলল, “দিবি না?”
“কী দেব না?”
“আমার সাপটা?”
“আমি তো জানতাম না এটা তোর সাপ! আমি তো আমি তো–”
সবুজ আতঙ্কিত গলায় বলল, “তুই কী?”
“আমি তো ঠিক করে রেখেছি এই বাচ্চাদের সাপটা গিফট দেব।”
সবুজ ফ্যাকাসে মুখে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না না। বাচ্চাদের দিস না। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“কেন?”
“সাপটা আসলে আমার নিজের না। কিসলু ভাইয়ের।”
“কিসলু ভাইটা কে?”
“আমাদের পাড়ায় থাকে। বডি বিল্ডার।”
সবুজ শুকনো গলায় বলল, “আমি এক দিনের জন্য ধার এনেছিলাম। বলেছিলাম আজকে বিকেলে ফেরত দেব। ফেরত না দিলে কিসলু ভাই অনেক রাগ করবে।”
টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “দেরি হয়ে গেছে মনে হয়।”
“কিসের দেরি হয়ে গেছে?”
“সাপটা ফেরত দেবার।”
সবুজ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, বলল, “দিতেই হবে।”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “পুরোটা তো আর ফেরত দেয়া যাবে না।”
“পুরোটা? পুরোটা মানে কী?”
“একটু অপেক্ষা কর। নাটকটা শেষ হোক। দেখবি।”
কাজেই সবুজকে নাটকটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো।
যখন নাটকটা শেষ হলো এবং বাচ্চারা হাততালি দিয়ে, টেবিলে থাবা দিয়ে, বেঞ্চের ওপর উঠে লাফ দিয়ে চিৎকার করে অনুষ্ঠান শেষ করল তখন টুনি তার হাতের পলিথিনের ব্যাগটা নিয়ে স্টেজে উঠে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি কী তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
“বল। বল আপু বল।”
টুনি সাপটা ধরে তাদের ভ্যারাইটি শো রক্ষা করেছে কাজেই তারা যদি টুনির কথা না শুনে তাহলে কার কথা শুনবে?
টুনি বলল, “তোমাদের ভ্যারাইটি শো খুবই ভালো হয়েছে। এত ভালো ভ্যারাইটি শো আমি জীবনেও দেখি নাই।”
বাচ্চারা আবার চিৎকার করে লাফিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। টুনি তাদের থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, যখন শেষ পর্যন্ত সবাই থেমে গেল তখন টুনি বলল, “আমি তাই তোমাদের সবার জন্য একটা গিফট রেডি করেছি। খুবই ছোট গিফট কিন্তু আমার মনে হয় তোমার এই গিফটা পেলে খুবই মজা পাবে।”
বাচ্চারা এবারে আগ্রহ নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। টুনি তার পলিথিনের ব্যাগটা ওপরে ধরে বলল, “আজকে আমরা যে রবারের সাপটা ধরেছিলাম আমি সেটাকে টুকরো টুকরো করে এনেছি। সবার জন্যে এক টুকরো। তোমরা এইটাকে রবার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।”
কথা শেষ করে টুনি পলিথিনের ব্যাগটা উল্টো করে ধরল এবং তার ভেতর থেকে সাপের টুকরোগুলো ঝুর ঝুর করে স্টেজের ওপর পড়তে লাগল। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে সেই টুকরোগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
টুনি বলল, “শুধু সাপের মাথাটা তোমরা নিও না। এইটা তোমাদের সবুজ ভাইয়ার জন্য। তার জন্যেই আজকে তোমরা এই গিফটটা পেয়েছ।”
কেউ একজন সাপের মাথাটা এনে টুনির হাতে দিল। টুনি সেটা নিয়ে সবুজকে ডাকল, বলল, “সবুজ নিয়ে যা। তোর কিসলু ভাইকে বলিস এর থেকে বেশি পাওয়া গেল না।”
সবুজের মুখ প্রথমে ফ্যাকাশে তারপর ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। তারপর সেখানে লাল-নীল ছোপ ছোপ রং দেখা যেতে থাকে।
.
পরের দিন সবুজ স্কুলে এলো না। এর পরের দিন সে যখন স্কুলে এসেছে তখন তার বাম চোখটা ফুলে আছে এবং চোখের নিচে কালো দাগ। শুধু তাই না স্পষ্ট মনে হলো তার বাম কানটা ডান কান থেকে লম্বা। সবুজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাসে এসে পিছনে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল, কারো সাথে কথা বলল না।
টুনি কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিসলু ভাই?”
সবুজ চোখ লাল করে বলল, “খবরদার কথা বলবি না। খুন করে ফেলব।”
টুনি বলল, “তুই নিজেই বল, দোষটা কার? তোর না আমার?”
সবুজ এবারেও কোনো কথা বলল না। টুনি বলল, “তুই আগে যখন খালি দুষ্টু ছিলি তখন ভালো ছিলি! কেন যে পাজি হতে গেলি?”
সবুজ কোনো কথা না বলে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইল।
হারানো চিঠি
সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা-কাচ্চারা বড় টেবিলটা ঘিরে পড়তে বসেছে। এই বাসায় বাচ্চা কাচ্চাদের অন্য কোনো নিয়ম নেই, শুধু এই একটা নিয়ম রয়েছে–সন্ধেবেলা সবাইকে পড়তে বসতে হবে। পড়তে বসে আসলেই পড়ার বই পড়ছে নাকি রগরগে ডিটেকটিভ বই পড়ছে সেটা কেউ খোঁজ করে দেখে না। তবে যারা বড় তারা ছোটদের দিকে নজর রাখে যেন কেউ বেশি বেলাইনে চলে না যায়।
টেবিলে টুনি বিশাল একটা ইংরেজি বই নিয়ে বসেছে, সেটা দেখে শান্ত ধমক দিয়ে বলল, “এই টুনি তুই কী পড়ছিস?’
টুনি বইয়ের মলাটটা দেখে বলল, “হিউম্যান সাইকোলজি।”
শান্ত আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, “পড়ার সময় পাঠ্যবই পড়ার কথা। আলতু ফালতু বই পড়ার কথা না।”
টুনি বলল, “আমার পড়া শেষ। হোমওয়ার্ক কমপ্লিট।”
“সেইজন্যে আলতু ফালতু বই পড়বি?”
“এটা মোটেও আলতু ফালতু বই না।”
টুনি গম্ভীর গলায় বলল, “এটা সাইকোলজির ওপরে ক্লাসিক একটা বই।”
“কোথায় পেয়েছিস এই বই?”
“আম্মু এনেছে।”
“তোর আম্মু নিজে পড়ার জন্যে এনেছে। তোর জন্যে তো আনে নাই? তুই পড়ছিস কেন?”
বাসার কেউই শান্তর কথাবার্তা শুনে কখনোই অবাক হয় না, তাই টুনিও অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করল, “কেন? পড়লে কী হয়?”
শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, “অনেক কিছু হয়। সিস্টেম নষ্ট হয়।”
টুনি কখনোই কোনো কিছুতে বেশি অবাক হয় না, তার পরেও আজকে সে বেশ অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সিস্টেম নষ্ট হয়?”
“হ্যাঁ।” শান্ত গলার স্বর আরো গম্ভীর করে বলল, “সিস্টেম হচ্ছে ছোটরা পড়বে ছোটদের বই। বড়রা পড়বে বড়দের বই। তুই পড়িস ক্লাস ফাইভে–”
টুনি বাধা দিল, বলল, “সেভেন।”
“একই কথা।”
“মোটেও একই কথা না। দুই বছরের পার্থক্য।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে। তুই পড়িস ক্লাস সেভেনে, তুই কেন এত মোটা ইংরেজি উওম্যান সাইকোপ্যাথি বই পড়বি।”
“উওম্যান সাইকোপ্যাথি না। হিউম্যান সাইকোলজি।”
“একই কথা।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “একই কথা না। হিউম্যান সাইকোলজি হচ্ছে মানুষের ব্রেন আর মন কীভাবে কাজ করে তার ওপরে বই।”
“ঠিক আছে।”
শান্ত মেঘস্বরে বলল, “তুই কেন এত অল্প বয়সে এরকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়বি?”
“পড়লে কী হয়?”
“তুই জানিস না কী হয়?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না।”
“এখন যদি বড়রা কেউ হাজির হয় তাহলে কী দেখবে?” শান্ত মুখ ভেংচে, বলল, “দেখবে আমাদের এই ছোট টুনি চোখে চশমা পরে এরকম মোটা কঠিন একটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছে। তখন আমাদের বলবে, তোরা এত বড় দামড়া হয়েছিস এখনো আলতু-ফালতু ডিটেকটিভ বই পড়িস, আর এই দ্যাখ আমাদের জ্ঞানী-গুণি টুনি মহারানি এখনই কত মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়া শুরু করেছে।”
শান্ত কথাটা শেষ করার সময় জ্ঞানী-গুণী টুনি মহারানি’ কথাটার ওপর আলাদা করে জোর দিল।
টুনি একটু অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত তার গলায় আরো কয়েক কেজি বিষ ঢেলে বলল, “বড় মানুষেরা তখন বলবে আমাদের টুনি এখনই এই রকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়ছে, যখন আরেকটু বড় হবে তখন নির্ঘাত আস্ত ডিকশনারি পানিতে ভিজিয়ে কোঁৎ করে গিলে ফেলবে–”
টুনি এই বারে শান্তকে কথার মাঝখানে থামাল, বলল, “না, বলবে না।”
“বলবে না?”
“না।”
“কেন বলবে না?”
“তার কারণ আমি এই মোটা মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছি না। শুধু এর ছবি দেখছি।”
“শুধু ছবি দেখছিস?”
“হ্যাঁ।”
মনে হলো শুধু ছবি দেখছে শুনে শান্ত একটু শান্ত হলো। কিন্তু তারপরেও সে ছেড়ে দিল না, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শুধু ছবি দেখলে পড়ার মতো ভান করছিস কেন? সবার সামনে ভাব দেখাচ্ছিস?”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, একটা ছবি দেখলে ছবিটা কিসের বোঝা যায় না। ছবিটার নিচে লেখা থাকে ছবিটা কীসের। সেই লেখাটা পড়তে হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি তখন বইটা তুলে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল, “এই দেখো একটা বাচ্চার ছবি। এটা দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে না। যদি এর নিচে কী লেখা আছে সেইটা পড় তাহলে বুঝবে এইটা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম অটিস্টিক বাচ্চার ছবি।”
“দেখি দেখি–” বলে সবাই টেবিলে ঝুঁকে পড়ে পৃথিবীর প্রথম পাওয়া অটিস্টিক বাচ্চার ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখল।
টুনি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আরেকটা ছবি বের করে দেখিয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে মিলগ্রাম আর এইটা হচ্ছে মিলগ্রামের মেশিন।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “মিলগ্রামের মেশিন কী করে।”
টুনি বলল, “ইলেকট্রিক শক দেয়।”
টুম্পা বলল, “সত্যি? ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মেশিন আছে?”
টুনি বলল, “সত্যি সত্যি ইলেকট্রিক শক দেয় না। শক দেওয়ার ভান করে।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন ভান করে।”
টুনি গম্ভীর মুখে বলল, “সেইটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। কিন্তু শান্ত ভাইয়া, তুমি বলেছ আমার মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়া নিষেধ।”
শান্ত একটু থতমত খেয়ে গেল কিন্তু টুনির কথার উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না। এতক্ষণে আরো অনেকে টুনির মোটা ইংরেজি বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, টুম্পা একটা ছবির ওপর আঙুল রেখে বলল, “এইটা কীসের ছবি?”
টুনি বলল, “এটা একটা ক্লাসরুমের ছবি। একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে।”
“কেন একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে?”
“এটাও ভান। ছাত্রটা একটিং করছে, দেখার জন্য কতজন ঘটনাটা ঠিক করে দেখে।”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “কতজন ঠিক করে দেখে মানে কী? সবাই তো ঠিক করে দেখবে।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্! কেউই ঠিক করে দেখবে না।”
“মানে?”
“মানে সবাই নিজের মতো করে দেখবে। যার যেটা দেখার ইচ্ছা সে সেইটা দেখবে।”
“কী বলছিস তুই? তোর বইয়ে তাই লেখা?”
“হ্যাঁ। সেইজন্যে যখন কোনো ঘটনা ঘটে যায় আর অন্যেরা বলে আমি স্পষ্ট নিজের চোখে দেখলাম, তাদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না।”
শান্ত টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “তোর বইটা বিশ্বাস করা ঠিক না। উল্টাপাল্টা কথা লিখা।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
টুনি এত সহজে শান্তর কথা মেনে নেবে শান্ত সেটা আশা করে নাই, সে ভাবছিল টুনি শান্তর সাথে এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে। তর্ক করা শান্তর খুব প্রিয় কাজ। একা একা তর্ক করা যায় না কিন্তু শান্ত তবু চেষ্টা করল, গলা উঁচু করে বলল, “যে বইয়ে লেখা যে একটা ঘটনা নিজের চোখে দেখলেও সে ঠিক জিনিস দেখবে না, তার যেটা ইচ্ছা সেইটা দেখবে–সেই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আগুন ধরানো উচিত।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আগুন দেওয়ার আগে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে নিও। আম্মু অনেক টাকা দিয়ে বইটা কিনেছে।”
“কেমন করে এই বইটা লিখল?”
শান্ত তবুও গজর গজর করতে থাকে, “একটা জিনিস চোখের সামনে হবে কিন্তু কেউ দেখবে না?”
শান্তর কথাকে কেউই বেশি গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যেহেতু অনেকক্ষণ থেকে সে বকর বকর করছে, শাহানা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “শান্ত, কেউ যখন একটা বই লিখে তখন সে বুঝে-শুনে লিখে। কী লিখেছে, কেন লিখেছে সেটা যদি জানতে চাস বইটা পড়ে দ্যাখ।”
“কক্ষনো না।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এরকম উল্টাপাল্টা বই আমি পড়ব? আমি কী এত বোকা নাকি।”
শাহানা বলল, “না তুই মোটেও এত বোকা না। সেইটাই হচ্ছে সমস্যা।
টুনি এরকম সময় বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কই যাস?
“পানি খেতে।”
শান্ত হা হা করে হাসল, বলল, “এই মোটা জ্ঞানের ইংরেজি বই পড়তে গিয়ে তোর গলা শুকিয়ে গেছে!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয়।”
পানি খেতে যেটুকু সময় লাগার কথা টুনির তার থেকে বেশ খানিকটা সময় বেশি লাগল। বোঝা গেল সে শুধু পানি খায়নি আরো কিছু করে এসেছে। তবে কী করে এসেছে সেটা তখন কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।
শান্তর যেহেতু পড়ায় মন নেই তাই সে কিছুক্ষণ টুম্পাকে জ্বালাতন করে মুনিয়ার পেছনে লেগেছে, ঠিক তখন হঠাৎ বাইরে ঝুমু খালার চিৎকার শোনা গেল, “মার! মার, ইবলিশের বাচ্চারে মার!” তারপরে আঁটার ঝপাং ঝপাং শব্দ শোনা গেল।
ঝুমু খালা কাকে এভাবে ঝটা পেটা করছে দেখার জন্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঝুমু খালা ঝাঁটা দিয়ে কিছু একটাকে পেটাতে পেটাতে তাদের ঘরে ঢুকে গেল। যে প্রাণীটাকে ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে ঝুমু খালা মারার চেষ্টা করছে সেটা নিশ্চয়ই ঘরের ভেতর এঁকে বেঁকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ ঝুমু খালা নিজেও এঁকে বেঁকে সেটাকে মারার চেষ্টা করে চিৎকার করতে লাগল, “মার। মার বদমাইশের বাচ্চারে মার! খুন করে ফেলব আমি!”
যাকে খুন করার চেষ্টা করছে প্রাণীটা নিশ্চয়ই অনেক চালু, কারণ সেটা এঁকে বেঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঝুমু খালা সেটাকে ঝাঁটাপেটা করার চেষ্টা করতে করতে পিছু পিছু বের হয়ে গেল। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ঝুমু খালা ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছে।
আবার যখন সবাই টেবিলে এসে বসেছে শান্ত বলল, “বাপরে বাপ, কত বড় ইন্দুর দেখেছিস?’
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ইন্দুর অনেক ভয় করে।”
“ভয়ের কিছু নাই, ঝুমু খালা নিশ্চয়ই ইন্দুরকে সাইজ করে ফেলবে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “হঁদুরটা কী কালো ছিল, নাকি ছাই রংয়ের ছিল?”
শান্ত বলল, “কালো কুচকুচে কালো।”
টুম্পা বলল, “সাদা।”
প্রমি বলল, “ছাই রংয়ের।”
শাহানা মুচকি হেসে বলল, “শান্ত দেখেছিস। ঘটনাটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, ইঁদুরটার রং কী ছিল!”
শান্ত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “পারব না কেন? এক শবার পারব। কালো রংয়ের। বললাম তো।”
“সবাই কালো বলছে না। একেকজন একেকটা বলছে।”
“কেউ যদি ভালো করে না দেখে সেটা আমার দোষ?”
টুনি, “ঠিক আছে, তাহলে বলো ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল?”
শান্ত একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “ইয়ে মানে আমি আসলে ইন্দুরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম তো তাই শাড়ির রংটা খেয়াল করি নাই।”
“তবুও নিশ্চয় দেখেছ। মনে করার চেষ্টা করো।”
শান্ত চোখ সরু করে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “তুই কী করার চেষ্টা করছিস?”
টুনি বইটা দেখিয়ে বলল, “এই বইটা বলেছে মানুষের সামনে কোনো ঘটনা ঘটলেও মানুষ নিজের মত করে দেখে। তারা মনে করে যে দেখেছে, আসলে দেখে না। সেইটা সত্যি কীনা এক্সপেরিমেন্ট করছি। বল ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল।”
টুম্পা বলল, “সবুজ।”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হুম মনে হয় সবুজ।
টুনি বলল, “ঠিক আছে চল, ঝুমু খালার কাছে গিয়ে দেখি কী রংয়ের শাড়ি পরে আছে।”
“চল।” সবাই উঠে দাঁড়াল কিন্তু তাদের আর যেতে হলো না কারণ ঝুমু খালা নিজেই তখন চলে এসেছে। কোনো একটা কারণে তার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি। ঝুমু খালার পরনে একটা হলুদ ডোরা কাটা শাড়ি, সেটা মোটেও সবুজ না।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, এখন তোমার বিশ্বাস হলো যে তোমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে কিন্তু তবু তুমি সেটা ঠিক করে দেখ নাই।”
শান্ত তবুও মানতে রাজি হলো না, বলল, “আসলে আমি ইন্দুরটার দিকে তাকিয়েছিলাম সেই জন্যে ঝুমু খালার শাড়িটার রং খেয়াল করি নাই।”
“ঠিক আছে। ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল?”
“কালো। কুচকুচে কালো।”
টুনি ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে ঝুমু খালা, তুমি বলো ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল। কালো?”
ঝুমু খালা হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগল। শান্ত একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো ঝুমু খালা, তুমি হাসো কেন? বল, ইন্দুরটা কী রংয়ের ছিল?”
ঝুমু খালা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “কোনো ইন্দুর আছিল না। আমি খালি একটিং করছি। ভাব দেখাইছি একটা ইন্দুর মারতাছি।” তারপর আবার হি হি করে হাসতে লাগল।
শান্ত হা করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কোনো ইন্দুর ছিল না?”
“না। এই বাসায় ইন্দুর নাই।”
“তাহলে—তাহলে–”
“টুনি গিয়া আমারে জিগাইল আমি কী একটা ইন্দুর মারার একটিং করবার পারমু কী না। সেই জন্যে কইরা দেখাইলাম। কেমন হইছে আমার একটিং?”
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “অনেক ভালো হয়েছে ঝুমু খালা।” তারপর কেমন জানি বোকার মতো হাসতে লাগল।
ঝুমু খালার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠে, “ভালো হইছে?”
“হ্যাঁ।” শান্ত মাথা নাড়ল, “ঝুমু খালা, তুমি টেলিভিশনের নাটকে একটিং করতে পারবে।”
অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, কথাটি সত্যি। ঝুমু খালার ইঁদুর মারা নাটকের অভিনয় অনবদ্য। ইচ্ছে করলেই সে টেলিভিশনে একটিং করতে পারবে। বিশেষ করে কাউকে ঝাড়পেটা করার চরিত্রে।
একটু পর টুনি যখন আবার তার মোটা ইংরেজি বইটা খুলে বসেছে তখন শান্ত গলা নামিয়ে বলল, “টুনি।”
“বলো শান্ত ভাইয়া।”
“দেখা শেষ হলে তোর জ্ঞানের বইটা আমাকে একটু দিবি?
টুনি হাসল, বলল, “দেব না কেন! এক শবার দেব। অনেক মজার মজার জিনিস আছে এই বইয়ে।”
টুনি তখনো জানত না এই বইয়ের বিচিত্র জ্ঞানটুকু আর কয়দিন পরেই একটা অন্য কাজে লেগে যাবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে এভাবে:
দাদি টেলিভিশন দেখছেন। তার পায়ের কাছে বসে ঝুমু খালাও টেলিভিশন দেখছে। এতদিন ঝুমু খালা শুধু কাহিনিটা দেখত, অভিনয় করার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে ঝুমু খালা চরিত্রগুলোর অভিনয় খুবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ সময়েই তাদের অভিনয় দেখে সে হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে থাকে। কোন ডায়ালগটা কীভাবে বলা উচিত ছিল সে ব্যাপারেও এখন ঝুমু খালার একেবারে সুনির্দিষ্ট মতামত আছে।
দাদি এবং ঝুমু খালা ছাড়াও বাসার বেশির ভাগ বাচ্চারাও আশেপাশে আছে। পচা আলু নামে একটা নতুন খেলা আবিষ্কার হয়েছে। শরীরের চামড়ার খানিকটা দুই আঙুল দিয়ে চিপে ধরে মাঝখানে খোঁচা দিয়ে একটা পচা আলুর অনুভূতি আসবে দাবি করে সবাই যন্ত্রণায় আহ্-উহ্ এবং আনন্দে হি হি করে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এরকম সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকল এবং সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু! আজকে কী এনেছ?”
ছোটাচ্চু একটা ধমক দিয়ে বলল, “তোদের সমস্যাটা কী? দেখা হলেই কী এনেছ কী এনেছ? আমি কী আনব?”
প্রায় সবাই একসাথে বলল, “খাবার।”
“তোরা খেতে পাস না নাকি? সবসময় খাই খাই করিস।”
একজন বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের এখন বাড়ন্ত বয়স। আমাদের বইয়ে লেখা আছে বাড়ন্ত বয়সে অনেক কিছু খেতে হয়।”
ছোটাচ্চু ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝুমু, রান্নাঘরে কী গাজর আছে?”
ঝুমু খালা বলল, “গাজর শেষ। খালি মূলা আছে।”
“ঠিক আছে তাহলে সবার হাতে একটা করে মূলা ধরিয়ে দাও। বসে চাবাতে থাকুক। মূলাতে অনেক ভাইটামিন আছে।”
বাচ্চাগুলো মুখ বিকৃত করে চিৎকার করতে লাগল।
একজন বলল, “বুঝেছি। ছোটাচ্চুর তো চাকরি নাই, বেকার মানুষ সেইজন্যে কিপটেমি করছে।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “বেকার হয়েছি তো কী হয়েছে? আমার কী কাজের অভাব আছে?” বলে ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে উঁচু করে ধরল। বলল, “এই দ্যাখ, আজকেই একজন একটা কাজের অফার দিয়েছে। সাথে এডভান্স পেমেন্ট।”
বাচ্চাগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “কত টাকা? কত টাকা?”
ছোটাচ্চু চোখ সরু করে বলল, “তোরা সব সময় টাকার এমাউন্ট নিয়ে মাথা ঘামাস কী জন্যে?”
একজন লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি। টাকা এত কম যে ছোটাচ্চু বলতে লজ্জা পাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “মোটেও না। আমি ইন প্রিন্সিপাল বাচ্চাদের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলি না। নেভার।”
বাচ্চারা মুখ টিপে হাসল, ধরেই নিল টাকার পরিমাণ কম বলে বলছে না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তোমার কাজটা কী?
ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে বসে হাসি হাসি মুখে বলল, “কাজটা খুবই ইন্টারেস্টিং। একটা চিঠি খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ, একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ চিঠি একজন বয়স্কা মহিলার কাছে এসেছে সেই চিঠিটা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“চিঠিটা কোথায় আছে?”
“ভদ্রমহিলার বাসাতেই আছে। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে সেটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“তুমি সেটা কীভাবে খুঁজে বের করবে?”
ছোটাচ্চু দাঁত বের করে হাসল। বলল, “এর জন্য আমি একজন প্রফেশনালের সাহায্য নেব।”
“প্রফেশনাল?”
“হ্যাঁ।”
একজন জানতে চাইল, “কে প্রফেশনাল?”
ছোটাচ্চু একটা অঙ্গভঙ্গি করে বলল, “তোরাই বল জিনিসপত্র খোঁজার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট কে?”
প্রায় সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “ঝুমু খালা।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ঝুমু হচ্ছে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমি ঝুমুকে নিয়ে যাব। ঝুমু খুঁজে বের করে দেবে। সে জন্যে তাকে প্রফেশনাল ফী দেওয়া হবে।”
ঝুমু খালা যে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট সেই কথাটি অবশ্যি সত্যি। বড় চাচা যখন বলেন, ‘আমার চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না’ ঝুমু খালা সাথে সাথে বাথরুমে গিয়ে টুথপেস্টের পাশ থেকে চশমা বের করে দেয়। মেজো খালা যখন বলে, ‘আমার লাল ব্লাউজটা যে কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা বালিশের তলা থেকে লাল ব্লাউজ বের করে আনে। দাদি (কিংবা নানি) যখন বলে আমার মোবাইলটা কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা সেটা সোফার চিপা থেকে বের করে আনে। স্কুলে যাবার আগে বাচ্চারা যখন চিৎকার শুরু করে ‘আমার অঙ্ক হোমওয়ার্ক! অঙ্ক হোমওয়ার্ক!’ ‘তখন ঝুমু খালা টেবিলের তলা থেকে সেটা উদ্ধার করে দেয়। ছোটাচ্চু যখন বলে, ‘আমার কলম! আমার কলম!’ তখন ঝুমু খালাকে বেশির ভাগ সময়েই কিছু করতে হয় না। কোনো দিকে না তাকিয়েই বলে, ‘ছোডু ভাই, কানের ওপরে দেখেছেন?’ বেশির ভাগ সময়েই সেটা সেখানে পাওয়া যায়।
ঝুমু খালাকে প্রফেশনাল হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি বের করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে ঝুমু খালার আনন্দ হবে বলে সবাই ভেবেছিল। কিন্তু ঝুমু খালাকে মোটেও সেরকম আনন্দিত দেখাল না। বরং ঝুমু খালা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “না ছোডু ভাই আপনি আমাকে দিয়া এই কাম করাবার পারবেন না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“এই বাসার জিনিসপত্র খুঁইজা বার করা খুবই সোজা। হের কারণ হচ্ছে আমি সবার চরিত্র জানি। কে কুনখানে কুন জিনিসটা ফালাইয়া রাখে আমার থাইকা ভালো করে কেউ জানে না। বড় ভাইজান সবসময় চশমা এইখানে হেইখানে ফালায়া রাখে। আফা আর ভাবিদের সমস্যা বেলাউজ আর কানের দুল। খালার মোবাইল ফোন থাকে সোফাসেটের চিপায়। পোলাপানদের বই খাতা কুনো সময় ঠিক জায়গায় থাকে না; টেবিলের নিচে, বিছানার নিচে, বালিশের নিচে–আমি ধরেন না খুঁইজাই বার করতে পারি। কিন্তুক অন্য বাড়িতে তো সেইটা হইব না।”
ছোটাচ্চু বলল, “কেন হবে না?”
“আমি অন্যের বাড়িতে গিয়া তার মাল সামানে হাত দিমু? কক্ষনো না। এই বাসা আমার নিজের বাসা; আমি এর ড্রয়ার খুলি, হের আলমারি খুলি কেউ আমারে কিছু কয় না। অন্য বাড়িতে কোনো জিনিসে হাত দিলেই বুড়ি হ্যাঁৎ করে উঠব।”
ছোটাচ্চু বলল, “না, না, হ্যাঁৎ করে উঠবে কেন? আমাকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে চিঠিটা খোঁজার জন্য। পুরো বাসা ওলট পালট করে ফেললেও কিছু বলবে না।”
ঝুমু খালা গম্ভীর গলায় বলল, “জে না। মানুষজনের মাল-সামানা খুবই পেরাইভেট। অন্যের পেরাইভেট জায়গায় হাত দিতে হয় না।”
ছোটাচ্চুকে এবারে খানিকটা অসহায় দেখাল, মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে ঝুমু–আমি তোমার ওপর ভরসা করে রাজি হয়েছি। এখন তুমি যদি বেঁকে বস বিপদে পড়ে যাব। প্লিজ রাজি হয়ে যাও।”
শান্ত বলল, “ঝুমু খালা, তোমার ফি’টা ডাবল করে দাও। এই সুযোগ। আমি তোমার সেক্রেটারি হয়ে যাব।”
ঝুমু খালা বলল, “জে না। কাজটা ঠিক হবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “তুমি একবার গিয়ে শুধু দেখ। আমাকে বলো কীভাবে কী করতে হবে। তুমি না চাইলে তোমার নিজের করতে হবে না।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা রাজি হয়ে যাও। দরকার হলে আমি থাকব তোমার সাথে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একবার গিয়া বাসাটা দেখতে পারি, তার বেশি কিছু না।”
সবাই তখন আনন্দের একটা শব্দ করল, ছোটাচ্চুর গলা উঠল সবার ওপরে।
.
দুই দিন পর বিকেল বেলা ছোটাচ্চু এসে ঝুমু খালাকে ডেকে বলল, “ঝুমু, তুমি রেডি হয়ে নাও।”
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “কি জন্য?”
“মনে নাই একটা চিঠি খুঁজে দিতে হবে?”
ঝুমু খালাকে কেমন যেন একটু বিপর্যস্ত দেখাল। আমতা আমতা করে বলল, “আমি একলা?”
“আর কে যাবে তোমার সাথে? “পোলাপান কাউরে নেই সাথে?”
“কাকে নেবে?”
“দেখি কারে পাই।”
ঝুমু খালা টুনিকে পেয়ে গেল। অন্য বাচ্চাদের থেকে টুনিকেই ঝুমু খালার বেশি পছন্দ। মেয়েটার মাথার মাঝে মনে হয় বুদ্ধি গিজ গিজ করছে। কাজকর্ম কথাবার্তাতেও ধীর-স্থির।
টুনি খুব আনন্দের সাথে যেতে রাজি হলো। যাবার আগে সে একটা সিল করা খাম নিল, খামের ওপর তার নিজের নাম ঠিকানা লেখা। খামটা কেন নিল, খামের ভেতর কী আছে কেউ জানে না।
খানিকক্ষণ পর ঝুমু খালা আর টুনি ছোটাচ্চুর সাথে নিচে নেমে দেখে বাসার সামনে একটা ঢাউস গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির সামনে একজন মাঝবয়সী মানুষ, মানুষটার মাথার সামনে চুল হালকা হয়ে আসছে, সেই জন্যে মনে হয় কপালটা অনেক বড়। ঝুমু খালা বলেছে বড় লোকদের কপাল এরকম হয়। মানুষটা একটা সাদা রংয়ের হাফ হাতা শার্ট পরে আছে। ছোটাচ্চুকে দেখে বলল, “থ্যাংক ইউ শাহরিয়ার সাহেব, আপনি রাজি হওয়ার জন্য। এই চিঠিটা খুবই দরকারী চিঠি, মা কীভাবে যে হারিয়ে ফেলল। খুঁজে পাওয়া না গেলে অনেক বড় ঝামেলায় পড়ব। প্রোপার্টি নিয়ে ঝামেলা।”
ছোটাচ্চু কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা তখন একটু জিজ্ঞাসার ভঙ্গি করে ঝুমু খালা আর টুনির দিকে তাকাল, ভদ্রভাবে জানতে চাইছে এরা কারা। ছোটাচ্চু বলল, “আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে ঝুমু, হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট। তাকেও সাথে নিচ্ছি।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এ হচ্ছে টুনি। ঝুমু যেন একা একা বোরিং ফিল না করে সেজন্যে যাচ্ছে। আমার ভাতিঝি।”
মানুষটা বলল, “বেশ বেশ। তাহলে গাড়িতে উঠে যাই।”
গাড়ির ড্রাইভার নেই মানুষটা নিজেই গাড়ি চালাবে। ছোটাচ্চু তার সাথে সামনে বসল। টুনি আর ঝুমু বসল পেছনে।
গাড়িটা যখন বড় রাস্তায় উঠে একটা ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেল তখন মানুষটা কেমন যেন একটু অপরাধীর মতো গলায় বলল, “আমার মায়ের বাসায় নেওয়ার আগে আপনাদের মনে হয় একটু সাবধান করে নেয়া ভালো।”
ছোটাচ্চু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সাবধান? কী নিয়ে সাবধান।”
“আমার মাকে নিয়ে।”
“আপনার মাকে নিয়ে? কী হয়েছে আপনার মায়ের?”
“মানে আমার মা একটু একসেনট্রিক টাইপ, মানে বাতিকগ্রস্ত বলতে পারেন। যত বয়স হচ্ছে সেটা আরেকটু বেড়ে যাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করেন আপনার মা?”
“এমনিতে বেশ হাসি-খুশি। কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি আছে।”
“জিনিসপত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি?”
“হ্যাঁ। বাইরে গেলেই কিছু একটা কিনে ফেলেন–টাকা-পয়সার তো অভাব নেই, যেটা ইচ্ছা সেটা কিনতে পারেন। জিনিসপত্র কিনে কিনে বাসাটা বোঝাই করে রেখেছেন, কিছু ফেলতেও পারেন না, তাই আস্তে আস্তে বাসাটা দরকারি বেদরকারি জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে। এখন এমন অবস্থা–” মানুষটা কথা শেষ না করে থেমে গেল।
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কি অবস্থা?”
“বাসার ভেতরে বলতে গেলে হাঁটার জায়গা নেই।”
“আপনারা আপনার মা’কে কিছু বলেন না?”
“কতবার বলেছি!” মানুষটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, “সবাই মিলে হাজার বার বলেছি, যে জিনিসের দরকার নেই সেগুলো ফেলে দিই কিংবা কোথাও দান করে দিই। মা রাজিও হন কিন্তু সত্যি সত্যি বাসা খালি করার সময় হলে তখন আর উৎসাহ দেখান না। জিনিসপত্র বাড়তেই থাকে।”
পেছন থেকে ঝুমু খালা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “কেরোসিন।”
মানুষটা চমকে উঠে বলল, “কী? কী বললেন?”
“বলছি অবস্থা কেরোসিন।”
“মানে? কেরোসিন মানে?”
টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “ঝুমু খালা বলতে চাইছে অবস্থাটা একটু জটিল।”
মানুষটা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ জটিল তো বটেই। যে চিঠিটা এতদিন থেকে খুঁজছি কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না তার এক নম্বর কারণ বাসা বোঝাই জিনিসপত্র। এত জিনিসপত্র থাকলে জিনিস কী খুঁজে পাওয়া যায়?”
ঝুমু খালা আবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবস্থা আসলেই কেরোসিন।”
কথাটার মানে কী এইবারে আর মানুষটাকে বোঝাতে হলো না। মানুষটাও লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তবে এই চিঠিটা খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়ার কথা। চিঠিটা একটা বড় খামে। খামটা লাল রংয়ের। ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা।”
ছোটাচ্চু বলল, “চিঠিটা কে পাঠিয়েছে?”
“এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার। তাদের ফার্ম থেকে। ফার্মের নাম সিনহা এন্ড সমাদ্দার।”
টুনি নামটা কয়েকবার আওড়ে নিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করল।
.
ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে শেষ পর্যন্ত তারা একটা বাসায় পৌঁছাল। বড় কম্পাউন্ড নিয়ে একটা বাসা, বড় লোকদের বাসা যেরকম হয়। দারোয়ান গেট খুলে দিল। মানুষটা বাসার সামনে গাড়িটা থামাল। নামার আগে ঝুমু খালা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আংকেল আপনারে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
মানুষটা বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই।”
“আপনারা আমাগো কী খালি চিঠিটা খোঁজার জন্য আনছেন নাকি বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে আনছেন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাসা খালি না করে চিঠিটা বের করা যাব না।”
মানুষটা ভালো মানুষের মতো হেসে ফেলল। বলল, “না, বাসা খালি করে দেবার জন্য আনিনি, কারণ মনে হয় সেটা সম্ভব না। তবে কেউ যদি আসলেই মাকে বুঝিয়ে বাসাটা খালি করে দিতে পারত তাকে আমরা একটা গোল্ড মেডেল দিতাম। স্যালুট করতাম।”
ঝুমু খালা বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে শব্দ করে বলল, “কেরোসিনের ওপরে ডিজেল!”
বাসার দরজায় শব্দ করতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। একজন কাজের মহিলা দরজাটা খুলে দিয়েছে। মানুষটা তাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কী করে?”
“টেলিভিশন দেখে।”
“যাও। মাকে ডাকো। বল গেস্ট এসেছেন।”
মানুষটা তখন ছোটাচ্চু, টুনি আর ঝুমু খালাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই টুনি একটা ধাক্কা খেলো। এটা বসার ঘর কিন্তু এটাকে মনে হচ্ছে একটা গুদামঘর। গতবার ঈদের আগে একবার তাকে নিয়ে তার আম্মু কাঁচা বাজারে গিয়েছিল। সেই কাঁচাবাজারে একটা দোকান বোঝাই ছিল জিনিসপত্রে, দোকানের মানুষটা কোনোভাবে একটা কোনায় বসেছিল মনে হচ্ছিল একটু নাড়াচাড়া করলেই তার ওপর চাল-ডাল মসলা-ঘি, সেমাই সব হুড়মুড় করে পড়বে। এখানেও তাই–চারিদিকে শুধু জিনিস আর জিনিস, মনে হলো এক্ষুনি বুঝি সবকিছু তাদের ওপর পড়বে।
দেওয়ালে নানা ধরনের পেইন্টিং। যতগুলো আঁটে তার থেকে বেশি, উপরে নিচে-ডানে-বামে শুধু পেইন্টিং আর ফ্রেম। কিছু ছবি ভালো কিছু কুৎসিত। কিছু দামি কিছু সস্তা। বসার ঘরে অনেকগুলো শো-কেস, প্রত্যেকটা শো-কেস বোঝাই নানা ধরনের পুতুল কিংবা শো-পিস দিয়ে, ভেতরে ঢুকিয়ে ঠেসে কাঁচের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। দরজাটা খুললেই শো-পিসগুলো নিচে পড়বে। শো কেসের ওপরেও নানা ধরনের জিনিসপত্র একেবারে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঘরের ভেতর বড় শেলফ। শেলফ বোঝাই নানা রকম বই। শেলফে বই আঁটে না বলে অনেক বই মেঝেতে।
বসার ঘরে সাধারণত একটা সোফা সেট থাকে কিন্তু এই বসার ঘরে মনে হয় তিন থেকে চার সেট সোফা। কিছু দামি, কিছু অতি কুৎসিত! সোফার ওপর নানারকম জিনিস, মানুষ কেমন করে এখানে বসবে সেটা একটা রহস্য। সোফার সামনে টেবিল, টেবিলের ওপর রাজ্যের জিনিস, টেবিলের নিচে জিনিসপত্র আরো অনেক বেশি। এখানে-সেখানে অসংখ্য ফুলদানি এবং সেই ফুলদানিতে ক্যাটক্যাটে রংয়ের প্লাস্টিকের ফুল। চারিদিকে নানা ধরনের বাক্স, বাক্সের ভেতর কী আছে কে জানে, অনেক বাক্স মনে হয় জীবনেও খোলা হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে ঘরের ভেতর কেমন জানি গুমোট একটা গন্ধ।
টুনি আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মানুষটির বয়স্কা মা এসে ঢুকলেন। জিনিসপত্রের ফাঁকে ফাঁকে চড়ইপাখির মতো পা ফেলে থুড়থুড়ে বুড়ো মহিলাটি কাছে এসে বললেন, “ও খোকা এসেছিস? বউমা ভালো আছে? নিয়ে আসলি না কেন? বুবাই কী করে? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে? বিন্তী না ইন্ডিয়া যাবে? গিয়েছিল? কেমন লেগেছে?”
অনেকগুলো প্রশ্ন করে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বললেন, “কয়দিন থেকে মাথাটা কেমন জানি উড়া উড়া লাগছে। এক বোতল জবা কুসুম তেল কিনে এনেছি এখন বোতলটা আর খুঁজে পাই না। কোথায় যে রেখেছি।”
বুড়ো মহিলার ছেলে, যার নাম খোকা কিংবা ভদ্রমহিলা যাকে খোকা বলে ডাকেন, মাথা নেড়ে বলল, “মা তুমি এই বাসায় কিছু খুঁজে পাবে না। কেমন করে পাবে; দেখেছ কত জিনিস?”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “খুচরা মাল।”
মানুষটা এবারে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর তার মাকে বলল, “মা তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এই যে এরা এসেছেন তোমার চিঠিটা খুঁজে বের করতে।” ছোটাচ্চুকে দেখিয়ে বলল, “ইনি শাহরিয়ার সাহেব, অনেক বড় ডিটেকটিভ!”
বুড়ো মহিলা খিক খিক করে হেসে বললেন, “আসল টিকটিকি! হি হি হি।”
ছোটাচ্চু কী আর করবে, টিকটিকি হয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা ঝুমু খালাকে দেখিয়ে বলল, “ইনি মিস ঝুমু। জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট আর তার সাথে ছোট মেয়েটা টুনি। এসেছে সাথে থাকার জন্য!”
বুড়ো মহিলা চোখ বড় বড় করে তাদের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “খুঁজে বের করা একটুও কঠিন হবে না। লাল রংয়ের খাম, ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পেয়ে যাবে।”
ঝুমু খালা আবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “এই বাসার মইধ্যে এক খুচরা মাল যে একটা একটা করে জিনিস সরায়া খুঁজতে কম পক্ষে দশ বছর লাগব! বেশিও লাগতে পারে।”
ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কী বলছ ঝুমু। তুমি কী একটা একটা জিনিস সরিয়ে খুঁজবে? তুমি খুঁজবে মাথা খাঁটিয়ে। তোমাকে এনেছি কী জন্যে?”
ঝুমু খালাকে মাথা খাটানো নিয়ে খুব উৎসাহী দেখা গেল না।
কিছুক্ষণ ভদ্রতার কথাবার্তা বলে ছোটাচ্চু চলে গেল। অবশ্যি চলে গেল না বলে পালিয়ে গেল বলাই ঠিক হবে। ভদ্রমহিলার ছেলেও সরে পড়ল, ঘরের মাঝে রইল শুধু ঝুমু খালা আর টুনি।
ঝুমু খালা তার শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে বলল, “নানি, এইবারে বলেন দেখি আপনি আপনার চিঠিটা কুন ঘরে কুন জায়গায় রাখছিলেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলাকে এক সেকেন্ডের জন্যে একটু বিভ্রান্ত দেখাল কিন্তু তারপরেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “আস, আমার সাথে, তোমাকে দেখাই।”
ঝুমু খালা আর টুনি ভদ্রমহিলার পিছু পিছু ভেতরে গেল। একটা বড় ঘরের ভেতর দিয়ে তারা ভেতরে ভদ্রমহিলার বেডরুমে পৌঁছালো। এখানে একটা বিছানা আছে সে জন্যে বোঝা যাচ্ছে এটা বেডরুম তা না হলে ঘরটা এমনভাবে জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই যে এটা যে একটা বেডরুম সেটা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। ঘরের এক পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা বড় আলমারি, শেলফ, কাপড় রাখার একটা আলনা এবং প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর নানারকম জিনিসপত্র। শেলফের ওপরে এবং নিচে বই। আলমিরার ওপরে কম্বল এবং বিছানার চাঁদর। আলনার ওপর নানা ধরনের কাপড়। ঘরে ছড়ানো-ছিটানো নানা সাইজের নানা আকারের পুতুল। এ ছাড়াও আছে তেল-শ্যাম্পু ক্রিম এবং কসমেটিকস। শুধু এই ঘরে যে জিনিস আছে সেই জিনিস দিয়ে নিউ মার্কেটে তিনটা দোকান বোঝাই করা সম্ভব।
সাবধানে পা ফেলে বুড়ো মহিলা তার বিছানার কাছে গিয়ে বললেন “এই বিছানায় বসে আমি চিঠিটা পড়েছি। উঁকিলের চিঠি। পড়ে কিছু বুঝি নাই। কিন্তু মনে হয় চিঠিটা খুব দরকারি। তাই বিছানা থেকে ওঠে চিঠিটা–” ভদ্রমহিলা থেমে গিয়ে তার ধবধবে সাদা চুলে ঢাকা মাথাটা চুলকালেন, তারপর একটু অপ্রস্তুতের মত হাসলেন। হেসে বললেন, “তারপরে মনে হয় এই ঘরে কোনো এক জায়গায় চিঠিটা সাবধানে রাখলাম।”
“কোন জায়গায়? চিন্তা করেন? চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। মনে পড়ছে না।” ড্রেসিং টেবিলের ওপর হতে পারে। শেলফের উপর হতে পারে। আবার আলমারির ভেতর হতে পারে। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা আবার খিক খিক করে একটু হাসলেন। টুনি লক্ষ করল তাঁর হাসিটা খুবই মজার।
ঝুমু খালা কী আর করবে, চিঠি খোজার জন্যে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে তার ওপরে রাখা জিনিসপত্র খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। এদিক-সেদিক দেখল, একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে তাকাল। দুই-একটা জিনিস বের করে আবার ঢুকিয়ে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে এই বাসায় সত্যি সত্যি কোনো একটা জিনিস খুঁজে বের করা অসম্ভব।
টুনি তখন বুড়ো মহিলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো মহিলার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়।”
টুনি নাম বলল, ক্লাস বলল। বুড়ো মহিলা তখন মাথা নেড়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বললেন, “তোমাদের দেখে আমার মায়া হয়। চাও আর না চাও তোমাদের লেখাপড়া করতে হয়। আমাদের সময় লেখাপড়া না করলে নাই! বাবা-মা ধরে বিয়ে দিয়ে দিত। আমার যখন বিয়ে দিয়েছিল তখন আমার বয়স চৌদ্দ।”
“আপনার হাজব্যান্ড কোথায়?”
“মরে গেছে। আজ প্রায় বিশ বছর–”
“এতদিন?”
“হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বেচারা মরে যাবার পর একা হয়ে গেছি। সময় কাটে না তাই দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াই। জিনিসপত্র কিনি। সময়টা কাটে।”
“আপনি এই বাসায় কতদিন থেকে আছেন?”
“পঞ্চাশ বছর তো হবেই। বেশিও হতে পারে।”
টুনি চারিদিকে তাকাল। অর্ধশতাব্দীর জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়ানো। তখন হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, “নানি। আমার এই চিঠিটা আমি হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম।” টুনি তার হাতে ধরে রাখা খামটা–যেটা বাসা থেকে এনেছে সেটা দেখাল। তারপর বলল, “এই খামটা খুবই দরকারি। আপনার হাতে একটু দিই? কোনো এক জায়গায় সাবধানে একটু রাখবেন? যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। আমি ঝুমু খালাকে একটু সাহায্য করি?”
বুড়ো মহিলা বললেন, “আমি? আমি রাখব?”
“হ্যাঁ। প্লিজ।” বলে বুড়ো মহিলা কিছু বলার আগে তার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে ঘরে ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য জিনিসপত্রের ভেতরে সাবধানে পা ফেলে ঝুমু খালার কাছে হাজির হয়ে বলল, “ঝুমু খালা। আমি তোমাকে সাহায্য করি?”
ঝুমু খালা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আর আমাকে কী সাহায্য করবা?” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “এর থেকে খেড়ের গাদার মাঝে সুই খোজা সোজা।”
টুনি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করছিল বুড়ো মহিলা তার চিঠিটা কী করেন। এটাকে সাবধানে রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রাখবেন। কোথায় রাখেন সেটাই টুনি দেখতে চায়।
টুনি দেখল বুড়ো মহিলা তার জিনিসপত্রের ওপর দিয়ে সাবধানে চড়ই পাখির মতো পা ফেলে শেলফের কাছে গেলেন। তারপর শেলফের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে সেই বইয়ের ভেতর চিঠিটা রেখে বইটা আবার শেলফের ওপর রেখে দিলেন। তার মানে এটা হচ্ছে এই ভদ্রমহিলার দরকারি কাগজপত্র রাখার সিস্টেম। তাঁর হারিয়ে যাওয়া লাল খামটি এই বইগুলোর ভেতর খুঁজে দেখতে হবে। দেখা যাচ্ছে বইগুলোর ভেতর নানা ধরনের কাগজপত্র গুঁজে রাখা আছে।
টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, ভদ্রমহিলা যখন একটু সরে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন তখন সে তাড়াতাড়ি শেলফের কাছে গিয়ে বইগুলোর ভেতর খুঁজতে থাকে। অনেকগুলো বইয়ের ভেতরেই নানা ধরনের কাগজ, খাম, চিঠি, ফটো আছে, তবে লাল খাম একটিও নেই। টুনি হতাশ হয়ে চলে আসার আগে আবার বইগুলোর ভেতর তাকায়। তার হঠাৎ মনে পড়ল সেদিন সে শিখেছে মানুষ প্রায় সময়েই ভুল জিনিস দেখে। ভুল জিনিস মনে রাখে। ভদ্রমহিলা সারাক্ষণই লাল খামের কথা বলেছেন, এমন কী হতে পারে খামটা লাল না, সেটা সাদা কিংবা হলুদ? মনে রেখেছেন লাল হিসেবে?
টুনি যখন দ্বিতীয়বার বইগুলোর ভেতর দেখে তখন হঠাৎ একটা বইয়ের ভেতর হলুদ একটা খাম পেল।
ভদ্রমহিলার ঠিকানায় লেখা চিঠি। খামের কোনায় লেখা “এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার” তার নিচে লেখা “সিনহা এন্ড সমাদ্দার” ঠিক যেরকম ভদ্রমহিলার ছেলে বলেছিল। খামটা মোটেও লাল নয়। খামটা হলুদ। এই বাসায় সারাক্ষণ সবাই লাল খাম খুঁজেছে সেজন্যে কেউ কখনো পায়নি।
টুনি খামটা নিয়ে তার ভেতরের চিঠিটা বের করে পড়ার চেষ্টা করল। কটমটে আইনি ভাষা পড়ে কিছু বোঝা যায় না। শুধু অনুমান করতে পারল এখানে বেশ কিছু তথ্য, দলিলের কপি এইসব আছে। খুবই জরুরি কিছু কাগজপত্র। এগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এই চিঠিটাই এতদিন থেকে সবাই মিলে খুঁজছে। লাল খাম হিসেবে খুঁজেছে বলে কেউ খুঁজে পায় নাই।
টুনি খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তারপর যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিয়ে ঝুমু খালার কাছে ফিরে এলো। ঝুমু খালা টুনিকে দেখে আবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল, টুনি তার আগেই ফিস ফিস করে বলল, “ঝুমু খালা, পেয়ে গেছি।”
ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “কী পায়া গেছ?”
“ঐ চিঠিটা।”
ঝুমু খালার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, টুনি কোন চিঠির কথা বলছে। যখন বুঝতে পারল তখন একটা চিৎকার দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। তারপর টুনির মতোই ফিস ফিস করে বলল, “কোন খানে পাইছ?”
টুনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ শেলফের ওপর বইয়ের ভেতর।”
“তুমি বুঝলা কেমন করে যে ঐ শেলফের বইয়ের ভেতরে থাকব?”
“আন্দাজ করেছি। উনি সব দরকারি কাগজ ঐখানে রাখেন দেখলাম।”
ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “এতদিন ধইরা কেউ তাইলে খুঁইজ্জা পাইল না কেন?”
“সবাই লাল খাম খুঁজেছে। খামটা আসলে লাল না। হলুদ।”
“হলুদ?’
টুনি মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা সন্দেহের চোখে বলল, “আসল চিঠিই পাইছ নাকি ভুলভাল?”
“আসল চিঠি, খুলে দেখেছি।”
ঝুমু খালা তখন টুনির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল, “তোমার মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”
“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।”
“একই কথা।” ঝুমু খালা সবগুলো দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে বুড়ি নানিরে ডাকি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আগেই না। চিঠিটা তো সহজ ছিল, এই বাসার জিনিসপত্র খালি করার একটা বুদ্ধি বের করা যাবে? তাহলে এই নানির একটা উপকার হয়।”
ঝুমু খালা ঠোঁট সুচাল করে ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, “তারপর মুখ হাসি হাসি করে বলল, “একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“কী জিনিস?”
“আমার কিছু একটিং করতে হইতে পারে।”
“একটিং? কী একটিং?”
“আমি তো একটা একটিংই পারি। সেইটা হলো ইন্দুর মারার একটিং।”
“ইঁদুর মারার একটিং?”
“হা। এই দেখো–” বলে টুনি কিছু বোঝার আগেই ঝুমু খালা একটা গগণবিদারী চিৎকার দিল। সেই চিৎকার শুনে মনে হলো কেউ বুঝি ঝুমু খালাকে খুন করে ফেলছে।
চিৎকার শুনে প্রথমে বাসার কাজে সাহায্য করার মহিলা ছুটে এলো। তার পিছু পিছু বুড়ি নানি ছুটে এলেন, এবারে আর চড়ুই পাখির মতো পা ফেলে নয় শালিখ পাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। ঝুমু খালার মতোই চিৎকার করতে লাগলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
ঝুমু খালা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রথমে এদিক সেদিক কয়েকটা লাফ দিল, তারপর নিচু হয়ে একটা পিতলের ফুলদানি তুলে সেটা দিয়ে দমাদম করে অদৃশ্য একটা ইঁদুরকে পিটাতে লাগল। ইঁদুরের পিছু পিছু ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি করতে করতে ঝুমু খালা চিৎকার করতে লাগল, “মার! ইন্দুরের বাচ্চারে মার।”
বয়স্ক বুড়ি নানিও আতংকে চিৎকার করতে করতে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে সেখানেই লাফাতে লাগলেন। ঝুমু খালা পিতলের ফুলদানি দিয়ে অদৃশ্য ইঁদুরকে মারার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে হাপাতে লাগল। বুড়ি নানি বিছানার ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ছিল? ইঁদুর?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই মোটা ইন্দুর। কুচকুচা কালা।” ঝুমু খালা হাত দিয়ে উঁদুরের যে সাইজটা দেখিয়েছে সেই সাইজের বিড়াল হতে পারে, ইঁদুর হওয়া সম্ভব না।
ঝুমু খালা পিতলের বড় ফুলদানিটা হাতে অস্ত্রের মতো ধরে রেখে এদিক সেদিক সতর্কভাবে তাকাতে তাকাতে বলল, “এই বাসায় ইন্দুর আছে তার মানে কী বুঝছেন নানি?”
ভদ্রমহিলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কী?”
“তার মানে হচ্ছে এই বাড়িতে সাপও নিশ্চয়ই আছে।”
“সাপ।”
“হে।” ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “যে বাড়িতে ইন্দুর থাকে সেই বাড়িতে সাপ থাকে। আর যে বাড়িতে সাপ থাকে সেই বাড়িতে বেজী থাকে। সে বাড়িতে বেজি থাকে সেই বাড়িতে শিয়ালও থাকতে পারে।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে কেমন জানি অসহায় দেখায়। কাঁপা গলায় বললেন, “কী বলছ এইসব?”
ঝুমু খালা হাতের ফুলদানিটা অস্ত্রের মতো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, “নানি, আপনি এই বাড়ি পরিষ্কার করেন। তা না হলে–”
“তা না হলে কী?”
“আপনি রাত্রে যখন ঘুমাবেন। তখন এই মোটকা মোটকা ভোটকা ভোটকা কালা কালা ইন্দুর আইসা আপনার হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল কামড়াইয়া কামড়াইয়া খায়া ফালাইব। সকালে উইঠা দেখাবেন হাতের দুইটা আঙুল নাই।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলা ঝুমু খালার এরকম ভয়ংকর বর্ণনা শুনে কী রকম জানি শিউরে উঠলেন।
ঝুমু খালা নির্দয়ের মতো বলতে থাকল, “প্রথমে একটা দুইটা ইন্দুর আসব। তারপর আট-দশটা। তারপর এক রাত্রে শত শত কালা কালা ইন্দুর কিলবিল কিলবিল কইরা আপনার ওপর ঝাঁপায়া পড়ব।” কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঝুমু খালা সেটা অভিনয় করে দেখাল, সেটা দেখে টুনিও রীতিমতো শিউরে উঠল।
ভদ্রমহিলা কাঁপা গলায় বললেন, “পরিষ্কার তো করতে চাই, কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এত জিনিস হয়ে গেছে এখন কোন দিক দিয়ে কী পরিষ্কার শুরু করব বুঝে উঠতে পারি না।”
ঝুমু খালা এইবার বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, “আমার ওপর ছাইড়া দেন।”
“তোমার ওপর ছেড়ে দেব?”
“জে। আমার ওপরে ছাইড়া দেন। আমি আপনারে দেখাই কেমন করে এই খুচরা মাল দূর করতে হয়।”
“তুমি দেখাবে?”
“জী। আপনে বিছানার ওপর বালিশ ঠেস দিয়া বসেন।”
ভদ্রমহিলা বুড়ি নানি ঝুমু খালার কথামতো বিছানার ওপর বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ঝুমু খালা তখন নিচু হয়ে একটা চাঁদর টেনে বের করে এনে সেটা কোনোভাবে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে ঘরের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জিনিসের মাঝ থেকে একটা শাড়ি বের করে এনে বুড়ি নানিকে দেখিয়ে বলল, “এই শাড়িটা আপনি শেষ বার কুনদিন পরেছেন?”
ভদ্রমহিলা মাথা চুলকালেন, বললেন, “মনে করতে পারছি না। অনেক আগে হবে।
“আবার কুনদিন পরবেন? আজকে? কালকে?”
“না, না, এখন পরব না।”
“তাহলে এরে বিদায় দেন।”
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, “বিদায় দেব?”
“হ্যাঁ। শাড়িটা বুক চেপে ধরে বলেন, আমার আদরের শাড়ি! তোমাকে কতদিন পরছি। এখন তোমারে বিদায়। যেখানে থাকো সুখে থাকো আমার প্রিয় শাড়ি।”
বুড়ি নানি চোখ বড় বড় করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। ঝুমু খালা
রীতিমত ধমক দিয়ে বলল, “বলেন।”
বুড়ি নানি একটু ভয় পেয়ে বিড় বিড় করে বললেন, “আমার প্রিয় শাড়ি, তোমাকে কতদিন পরেছি। এখন তোমাকে বিদায়।”
ঝুমু খালা মনে করিয়ে দিল, “যেখানে থাকো, সুখ থাকো।”
ভদ্রমহিলা বললেন, “যেখানো থাকো সুখে থাকো।”
ঝুমু খালা তখন শাড়িটা মেঝেতে বিছানা চাঁদরের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে নিচ থেকে একটা ফুলদানিতে তুলে নিল। ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলল, “এই ফুলদানি আপনি কুনদিন ব্যবহার করছেন?”
“অনেক আগে।”
“এখন আবার ব্যবহার করবেন?”
“না।“
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন। একটা চুমা দিয়ে বিদায় দেন। বলেন সোনার চান ফুলদানি বিদায়।”
বয়স্ক মহিলা সোনার চান ফুলদানি বলে চুমা দিয়ে ফুলদানিকে বিদায় দিলেন। ঝুমু খালা ফুলদানিটাকে চাঁদরের উপর ফেলে দিল। এবারে নিচ থেকে একটা টেবিল ল্যাম্প তুলে নিল। সেটা বুড়ি নানির হাতে দিয়ে ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “এইটা? এই টেবিল ল্যাম্পটা কী ব্যবহার করবেন?”
বুড়ি নানি মাথা চুলকে বলল, “ঘরে এত ল্যাম্প লাইট–এইটা আর কেমন করে ব্যবহার করব?”
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন, ভালো কিছু বলেন যেন টেবিল ল্যাম্পটা মন খারাপ না করে।”
“মন খারাপ না করে?”
“জে নানি।”
বুড়ি নানি একটু সময় চিন্তা করে বলল, “আমার প্রিয় টেবিল ল্যাম্প। কত রাত তোমাকে জ্বালিয়ে বই পড়েছি এখন আর আগের মত বই পড়তে পারি না। তোমাকে তাই বিদায়।”
ঝুমু সাহায্য করল, বলল, “বলেন, মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।”
বুড়ি নানি বললেন, “মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।” ঝুমু খালা তখন টেবিল ল্যাম্পটাও চাঁদরের ওপর রাখল।
প্রথম প্রথম বুড়ি নানির জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দেওয়ার জন্যে কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হয় একটু ইতস্তত করছিলেন, একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তার লজ্জা কেটে গেল, তখন নিজেই উৎসাহ নিয়ে নানারকম কথা বলে জিনিসগুলোকে বিদায় দিতে লাগলেন। একটা পুতুলকে বললেন, “ওরে আমার আদরের পুতুল! এই ভিড়ের মাঝে থেকে থেকে তুমি নিশ্চয়ই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছ? যাও এখন মনের সুখে ঘুরে বেড়াও।” একটা শ্যাম্পুর শিশিকে বললেন, “ভাই শ্যাম্পু, তোমাকে মাথায় দিইনি দেখে তুমি নিশ্চয় আমার ওপরে রাগ করেছ। রাগ করো না ভাই, অন্য কারো কালো চুলে তুমি আনন্দ করো। বুড়ো মানুষের চুলে কোনো আনন্দ নাই।”
দেখতে দেখতে চাঁদরটা নানা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে উঠল, তখন ঝুমু খালা চাঁদরটাতে বেঁধে সব জিনিসপত্র একেবারে বাইরে নিয়ে ঢেলে এলো। তারপর আবার চাঁদরটা বিছানো হলো, আবার এর ওপর জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দিয়ে দিয়ে রাখা হলো। দেখতে দেখতে আবার সেই চাঁদরটা বোঝাই হয়ে গেল। ঝুমু খালা তখন আবার চাঁদরটা বাইরে খালি করে আবার ফিরে এলো। এইভাবে চলতেই থাকল।
সন্ধ্যেবেলা বুড়ি নানির ছেলে যখন ছোটাচ্চুকে নিয়ে ঝুমু খালা আর টুনিকে নিতে এলো তখন সে গাড়িটা ভেতরে ঢোকাতে পারল না, কারণ বাইরের পুরো জায়গাটা জিনিসপত্রের স্থূপে বোঝাই হয়ে আছে। গাড়ি বাইরে রেখে ছোটাচ্চু বুড়ি নানির ছেলের সাথে ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে তুলে বলল, “এখানে কী হচ্ছে?”
টুনি বলল, “ঝুমু খালার বাসা পরিস্কার প্রজেক্ট।”
ছোটাচ্চু বলল, “বাসা পরিষ্কার প্রজেক্ট? ঝুমুর না চিঠি খুঁজে বের করার কথা?”
টুনি এক গাল হেসে বলল, “চিঠি অনেক আগে বের করা হয়ে গেছে।”
ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “চিঠি বের করা হয়ে গেছে?”
ছোটাচ্চুর চিৎকার শুনে বুড়ো নানির ছেলে এগিয়ে এল। টুনি তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, “দেখবেন, এটাই সেই চিঠি নাকি?”
মানুষটি খাম খুলে ভেতরে এক নজর দেখেই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ। এইটাই সেই চিঠি। কী আশ্চর্য!”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি ভেবেছিলাম চিঠিটা লাল রংয়ের খামে হবে।”
টুনি বলল, “সবাই তাই ভেবেছিল তাই কেউ কোনোদিন খুঁজে পায় নাই।”
“মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, খামটা যদি লাল না হয়ে থাকে তাহলে মা লাল খাম লাল খাম বলছিল কেন?”
টুনি বলল, “আমি বইয়ে পড়েছি। মানুষ সবসময় এরকম করে। দেখে একটা বলে আরেকটা।”
ছোটাচ্চু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী আশ্চর্য!”
সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে টুনি ছোটাচ্চর সাথে বাসায় চলে এলো। চিঠিটা খুঁজে পাওয়া গেছে বলে ছোটাচ্চুর মেজাজ খুবই ভালো। ঝুমু খালা তাদের সাথে এলো না, তার বাসায় ফিরতে অনেক রাত হলো। পঞ্চাশ বছরের বাসা এক রাতে খালি করা সোজা কথা না!
.
দুদিন পর সন্ধেবেলা বাসায় দরজায় বেল বেজেছে। টুম্পা দরজা খুলে দেখে একজন ফর্সা মানুষ হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি বুড়ি নানির ছেলে। টুম্পাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন, “শাহরিয়ার সাহেব বাসায় আছেন?”
টুম্পা ভুরু কুচকে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব?”
“হ্যাঁ। ঐ যে বিখ্যাত ডিটেকটিভ?”
“ও। ছোটাচ্চু!”
টুম্পা মানুষটিকে সোফায় বসিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।
ছোটাচ্চু তার ময়লা গেঞ্জিটার ওপর পরিষ্কার একটা শার্ট পরে বসার ঘরে হাজির হলো, মানুষটাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “আরে! আপনি? কী মনে করে?”
মানুষটি বলল, “আমাদের সব রকম ঝামেলা মিটে গেছে তাই ভাবলাম আপনাকে একটা থ্যাংকস দিয়ে যাই। তার সাথে জিনিস খুঁজে বের করার স্পেশাল প্রফেশনাল ঝুমুকেও একটা থ্যাংকস–আমার মায়ের বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে! উনাকে একটা গোল্ড মেডেল দেওয়ার কথা ছিল। ভাবলাম মেডেলের বদলে একটা চেক দিই। নিজে গিয়ে মেডেল কিনে নিবেন। উনি কোথায় থাকেন জানি না, উনার চেকটা আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”
বাসায় কেউ এসে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বললে অন্যরা জানালার নিচে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে।
ঝুমু খালার জন্য একটা চেক আছে শুনে বাচ্চাদের উত্তেজনা থামিয়ে রাখা গেল না, তারা একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল!
ছোটাচ্চু বললেন, “ঝুমু আমাদের সাথেই থাকে। আমি ডাকছি আপনি নিজের হাতে দেন, ও খুশি হবে।”
ঝুমু খালার চেক নিতে আসতে একটু দেরি হলো, কারণ সে তার ফেবারিট গোলাপি শাড়ি পরে এলো, চুলগুলো বেঁধে নিতে হলো এবং কপালে একটা টিপ দিল। চেক হস্তান্তরের সময় সব বাচ্চারা ঝুমু খালার পাশে থাকল এবং অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। ঝুমু খালা চেকটা হাতে নিয়ে পরিমাণটা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আংকেল ভুলে শূন্য একটা বেশি দিছেন মনে হয়!”
মানুষটি হাসি মুখে বলল, “না, শূন্য বেশি দিইনি। ঠিকই আছে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ হা করে চেকটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “নানি কেমন আছেন?”
মানুষটি বলল, “ভালো আছেন। বাসা খালি হওয়ায় এখন হাঁটা-চলা করা যায়। শুধু একটা বিচিত্র ব্যাপার–”
“কী বিচিত্র ব্যাপার?”
“মা এখন দিন-রাত জিনিসপত্রের সাথে কথা বলেন। সেদিন মায়ের সাথে খেতে বসেছি। টেবিলে আলুর ভর্তা ছিল। মা আলু ভর্তা প্লেটে নিয়ে সেটাকে বলতে থাকলেন, “ভাই আলু তুমি কেমন আছ? মন মেজাজ ভালো? তোমাকে টিপে টিপে এরকম ভর্তা করে দিয়েছে সেইজন্যে আমি খুবই দুঃখিত।”
বাচ্চারা অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রাখল। তখন মানুষটা বলল, “সেদিন পাবদা মাছ খেতে দিয়েছি। মা একটা পাবদা মাছ মুখের কাছে নিয়ে বলতে থাকেন, ভাই মাছ, তুমি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন। এইভাবে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি তোমাকে খাব কেমন করে?”
বাচ্চারা এবারে আর পারল না, সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে দিল!