- বইয়ের নামঃ যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কক্সবাজার
প্রতি রাতেই এই বাসার বাচ্চা-কাচ্চারা তাদের লেখাপড়া শেষ করে দাদির (কিংবা নানির) ঘরে হাজির হয়। দাদি সাধারণত গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে কোনো একটা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, সেখান থেকে এক সেকেন্ডের জন্যে চোখ সরিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, লেখাপড়া হয়েছে ঠিকমতো?’ বাচ্চারা আসলে লেখাপড়া করে থাকুক আর নাই করে থাকুক চিৎকার করে বলে, হয়েছে দাদি (কিংবা নানি) দাদি তখন বলেন, “খবরদার কোনো গোলমাল চেঁচামেচি নাই। আমাকে নাটকটা দেখতে দে ঠিকমতো। বাচ্চারা চিৎকার করে বলে, “ঠিক আছে দাদি (কিংবা নানি) তারপর গোলমাল চেঁচামেচি চিৎকার শুরু করে দেয়।
আজকেও ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটছিল তখন ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। বাচ্চারা তাদের অভ্যাসমতো তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি গোলমাল থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তার হাতে কোনো খাবারের প্যাকেট নাই দেখে তারা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল, একজন বলল, “ছোটাচ্চু, আজকেও তুমি কিছু আন নাই?”
ছোটাচ্চু মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “কে বলেছে আনি নাই। অবশ্যই এনেছি।”
বাচ্চারা তখন এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? তোমার হাতে তো কোনো প্যাকেট নাই।”
ছোটাচ্চু তার মুখের হাসিটা আরো বাড়িয়ে রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, “আমি যেটা এনেছি সেটা আনতে কোনো প্যাকেটের দরকার হয় না।”
এবারে সবাই যথেষ্ট কৌতূহলী হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু? কী এনেছ? কী?”
ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে খুব কায়দা করে তার মোবাইল টেলিফোনটা বের করে এনে বলল, “একটা এসএমএস।”
“এসএমএস?” বাচ্চারা এবারে অবাক হবে না হতাশ হবে বুঝতে পারল না।
“হ্যাঁ, একটা এসএমএস।” ছোটাছুর আরো বেশি রহস্যের মত ভঙ্গি করে বলল, “আমি কী পড়ে শোনাব এসএমএসটা?”
বাচ্চারা একটু সন্দেহের ভঙ্গি করে বলল, “পড়।”
ছোটাচ্চু মুখটা গম্ভীর করে বলল, “এসএমএস-টা পাঠিয়েছে আমার বন্ধু জয়ন্ত। সে লিখেছে, দোস্ত, আমি তোর বাসার বাচ্চাদের বলেছিলাম তাদেরকে কক্সবাজার না হয় রাঙামাটি বান্দরবান পাঠাব। তারা কী রেডি? সামনের ছুটিতে কী যেতে পারবে? আমি কী আমার সেক্রেটারিকে বলব তোদের সাথে কথা বলে প্লেনের টিকিট কিনতে? হোটেল রিজার্ভেশন করতে?”
ছোটাচ্চু এসএমএসটা পড়ে শেষ করতে পারেনি তার আগেই বাচ্চারা এমনই গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল যে রান্নাঘর থেকে ঝুমু খালা ওপর থেকে বড় চাচা, মেজো চাচা এবং ছোট ফুপু ছুটে এলেন দেখার জন্যে কী হয়েছে। দাদির (কিংবা নানির) সিরিয়ালে খুবই একটা জটিল মুহূর্ত চলছিল, বাড়ির বউ শ্বাশুরির অত্যাচারে বাড়ির ছাদের কার্নিশে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কিছু একটা বলছিল, বাচ্চাদের চিৎকারে সেটা দাদি শুনতে পেলেন না। সেই চিৎকার শুনে ফুটফুটে বউটি চমকে উঠে কার্নিশ থেকে পড়ে না যায় দাদির সেরকম আশঙ্কা হতে লাগল।
ছোটাচ্চুর বন্ধু জয়ন্ত কাকু বাসায় সব বাচ্চাদের কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে শোনার পর সবাই মেনে নিল এরকম একটা কথা শোনার পর এ ধরনের বিকট চিৎকার দেওয়াই যেতে পারে। সত্যিই জয়ন্ত কাকু এটা লিখেছে নাকি ছোটাচ্চু বাচ্চাদের সাথে রসিকতা করছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সবাই একজন একজন করে এসএমএসটা পড়ল। বাসের টিকিট কিংবা ট্রেনের টিকিট লিখতে গিয়ে ভুলে প্লেনের টিকিট লিখে ফেলেছে কী না সেটা নিয়েও একটু আলোচনা হলো। শান্ত তখন সবাইকে মনে করিয়ে দিল জয়ন্ত কাকু ইচ্ছা করলে আস্ত প্লেনটাই রিজার্ভ করে ফেলতে পারে! তার জন্য আট-দশটা প্লেনের টিকিট কেনা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার মতো একটা ব্যাপার।
তখন তখনই কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সাথে কী কী নিতে হবে তার লিস্ট তৈরি করতে সবাই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল। প্রথম লিস্ট যেটা তৈরি হলো সেটা দেখে ছোটাচ্চু বলল যে এত মালপত্র নিয়ে প্লেনটা উড়তে পারবে না। তখন সবাই দ্বিতীয় লিস্ট তৈরি করতে বসে গেল, কিন্তু পরদিন সকালে স্কুলে যেতে হবে সেজন্যে সবাইকে রীতিমতো জোর করে ঘুমাতে পাঠানো হলো। বিছানায় শুয়েও তাদের চোখে ঘুম আসতে চায় না, কক্সবাজার গিয়ে কী করবে সেটা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সবাই ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে।
.
পরদিন থেকে কক্সবাজার যাবার প্রস্তুতি পুরো উদ্যমে শুরু হয়ে গেল। সবার আগে ঠিক করতে হবে কে কে যাবে। এই বাসার কেউ ঝুমু খালাকে ছাড়া নড়তেও পারে না তাই তাকে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো। ঝুমু খালা যখন জানতে পারল দাদি যাবেন না শুধু বাচ্চা কাচ্চারা যাবে তখন সে যেতে রাজী হলো না। মায়েরা যেভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের বুক আগলে রাখে ঝুমু খালাও অনেকটা সেইভাবে দাদিকে বাচ্চার মতো বুক আগলে রাখে। প্রমি ঝুমু খালাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সমুদ্র দেখেছ ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা বলল, “না দেখি নাই।”
প্রমি বলল, “তুমি যদি আমাদের সাথে যাও তাহলে সমুদ্র দেখতে পারবে।”