লোকগুলি তখনও মারছে, আজগর মামা তার মাঝে হাত দিয়ে লোকগুলোকে থামাতে গিয়ে নিজেই মনে হয় দুই-চারটা কিল-ঘুষি খেয়ে গেলেন, কিন্তু যেসব গা
করে মামা আবার চিৎকার করে ধমক দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এখানে? কী হচ্ছে?”
যে-কয়জন মানুষ খুব উৎসাহ নিয়ে পেটাচ্ছিল তাদের একন চকচকে চোখে বলল, “পকেটমার স্যার। পকেট মেরেছে।”
“কার পকেট মেরেছে?”
“এই যে স্যার, এই সাহেবের।”
যে-সাহেবের পকেট মেরেছে সে এসে নিচে-পড়ে-থাকা মানুষটিকে কষে একটা লাথি মারতেই আজগর মামা খপ করে লোকটার কলার চেপে ধরে বললেন, “এই লোক তো পকেট মেরেছে। আপনি কী করছেন?”
লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “কী করছি?”
“মানুষ মারছেন। এই লোকের যদি পকেট মারার জন্যে শাস্তি হয় আপনার তা হলে মানুষ মারার জন্যে শাস্তি হতে হবে।”
আশেপাশের যে-মানুষগুলো এতক্ষণ কিল ঘুষি লাথি মারছিল হঠাৎ তারা থতমত খেয়ে থেমে গেল। আজগর মামা চিৎকার করে বললেন, “আপনারা কি মানুষ না? একজন মানুষ কখনও আরেকজন মানুষকে এভাবে মারে!”
একজন, যে মারতে মারতে নিজের মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল, চোখ লাল করে বলল, “চোরকে মারব না তো কোলে তুলে রাখব?”
আজগর মামা মাথা ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, তাকে কোলে তুলে রাখবেন না–তাকে পুলিশে দেবেন। দেশে আইন-কানুন আছে সেটা সম্মান করতে হয়।”
আশেপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের কয়েকজন আবার মার মার করে এগিয়ে আসতে চাচ্ছিল, কিন্তু দেখা গেল বেশির ভাগ মানুষই হঠাৎ করে মারপিটে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকজন আজগর মামার সাথে একমত হয়ে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “ঠিকই তো, একজন মানুষকে কি কখনও এভাবে মারে?”
ভিড়টা তখন হঠাৎ পাতলা হয়ে গেল এবং আজগর মামা নিচে-পড়ে-থাকা মানুষটাকে টেনে তুললেন, মনে হল লোকটার সারা মুখ থেঁতলে গেছে, রক্তে মাখামাখি। শরীরের কাপড়জামা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, পরনের লুঙ্গিটা খুলে যাচ্ছিল, কোনোমতে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। মামা লুঙ্গিটা বেঁধে দিয়ে বললেন, “হাঁটতে পারবে?”
লোকটা রক্তমাখা একদলা থুতু ফেলে মাথা নাড়ল। আর ঠিক তখন দেখা গেল দুজন পুলিশ হেঁটে হেঁটে আসছে। পুলিশকে দেখামাত্রই যারা মারধোর করেছিল সাথে সাথে তারা সরে পড়ল।
রাজু আর সাগর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, মামা পুলিশ দুজনের সাথে কথা বলছেন। পুলিশ দুজন কথা শুনে মাথা নাড়ল, তারপরও একজন মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আয়েশ করে ধোয়া ছেড়ে লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল। মামা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন লোকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছে–তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছে উদ্বিগ্ন মুখে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন, দেখে মনে হল রাজু আর সাগরকে খুঁজছেন। রাজু আর সাগর তখন ছুটে গেল মামার কাছে। আজগর মামা দুই হাতে দুজনকে ধরে বললেন, “তোরা এখানে, আমি আরও ভাবলাম কোথায় গেলি!”
ঠিক তখন একজন বুড়োমতোলোক এগিয়ে এল, আজগর মামার খুব কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, “বাবা, আপনি আজকে একটা খুব বড় কাজ করেছেন।”
মামা কিছু না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা আবার বলল, “আপনি না থাকলে আজকে এই লোকটা খুন হয়ে যেত। সবার চোখে আমি খুন দেখেছিলাম–”
মামা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন। লোকটা মামার হাত স্পর্শ করে বলল, “আপনার জন্যে দোয়া করি বাবা। আরও মানুষ দরকার আপনার মতো।”
মামা একটু হাসলেন, লোকটা বলল, “যাই বাবা।”
মামা মাথা নাড়লেন আর লোকটা তখন হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
.
ট্রেনে উঠে রাজু আজগর মামাকে বলল, “মামা, তোমার অনেক সাহস তাই না?”
মামা অবাক হয়ে বললেন, “সাহস? সাহস কোথায় দেখলি?”
“এই যে এতগুলি লোক খেপেছিল, তুমি তার মাঝে গিয়ে কেমন করে লোকটাকে বাঁচালে–”
“এর মাঝে সাহসের কী দেখলি?”
“যদি লোকগুলি তোমাকে কিছু করত! কীরকম ভয়ানক লোক”
মামা একটু হেসে বললেন, “তোদের একটা কথা বলি, সবসময় মনে রাখিস। সব মানুষের মাঝে একটা ভালো জিনিস আছে–চোর ডাকাত খুনি বদমাস–সবার মাঝে। সবসময় চেষ্টা করতে হয় সেই ভালো জিনিসটা বের করে আনার। চেষ্টা করে দেখিস, মানুষের মাঝে ভালো জিনিসটা বের হয়ে আসবে। যদি চেষ্টা করিস দেখবি অসম্ভব খুনে ডাকাত বদমাইশ মানুষও হঠাৎ করে ভালো একটা-কিছু করছে।”
“কিন্তু মামা–”
কোনো কিন্তু নেই” মামা মাথা নেড়ে বললেন–”মানুষকে বিশ্বাস করবি। মানুষ কখনও খারাপ হতে পারে না।”
.
ট্রেনটা আর ঘণ্টা দুয়েক গিয়ে একটা ছোট স্টেশনে থেমে গেল। সেখানে থামবার কথা নয়, তাই লোকজন নেমে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে মুখ কালো করে ফিরে এল। সামনে একটা ছোট ব্রিজের কাছে লোকাল ট্রেনের বগি পড়ে আছে, সেটা না সরানো পর্যন্ত ট্রেন যাবে না। সবাই যখন সেটা নিয়ে কথাবার্তা বলছে মামা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
“এখনও জানি না।”
“তা হলে?”
“চল তত বের হই আগে–হেঁটে, রিকশায়, বাসে, স্কুটারে করে চলে যাব। ট্রেন থেমে থাকলে কি জীবন থেমে থাকবে নাকি?”
ট্রেনের অন্য লোকজন অবাক হয়ে মামার দিকে তাকিয়ে রইল। মামা তার মাঝে টেনে তার ব্যাগটা নামিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। মামার পিছুপিছু রাজু আর সাগর, আর তাদের দেখাদেখি আরও বেশ কয়েকজন। সবাই মিলে যখন হাঁটছে তখন তাদের দেখে ট্রেন থেকে লোকজন গলা বের করে খোঁজ নিতে শুরু করল। মামা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি জানি না যাওয়ার কোনো রাস্তা আছে কিনা–গিয়ে খোঁজ খবর নেব।”