রাজুর ট্রেনে চড়তে খুব ভালো লাগে। যতক্ষণ ট্রেন চলছে ততক্ষণ বাইরে তাকিয়ে কত কী দেখা যায়, তারপর ট্রেন যখন কোনো-একটা স্টেশনে থামে, তখন আরও মজার ব্যাপার শুরু হয়। অন্ধ ফকিরের সুর করে গান, বাদামওয়ালা, ঝালমুড়ি আর কলা, চিরুনি আর খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা। প্লাটফর্মে লোহার ট্রাংকের উপর গ্রামের বউ জবুথবু হয়ে বসে থাকে, আর ছোট একটা ছেলে মুখে আঙুল দিয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ-হঠাৎ দেখা যায় কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষটার মুখের দিকে তাকালে বুকের ভিতর জানি কীরকম করতে থাকে।
ট্রেনে উঠলে সবচেয়ে মজা লাগে লোকজনের কথা শুনতে। কত মজার মজার গল্প, রাজনীতির গল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, চোর ডাকাত বাটপারের গল্প। কত যে মজার মানুষ আর কত যে তাদের মজার মজার অভিজ্ঞতা, না শুনলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
ট্রেনটা অনেকক্ষণ একটানা চলতে চলতে শেষে একটা জংশনে থামল। ট্রেনটা প্রথম যখন এসে থামে তখন ভারি মজা লাগে, কিন্তু যদি বেশিক্ষণ থেমে থাকে তা হলে আবার মনে হতে থাকে, কী ব্যাপার, ছাড়ছে না কেন? সাগর একটু পরেই আবার শুরু করে দিল, “মামা, ট্রেন ছাড়ছে না কেন?”
মামা কী-একটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন, সেটা পড়তে পড়তে চোখ না তুলে বললেন, এটা বড় জংশন, অন্য ট্রেনের সাথে ক্রসিং হবে, ছাড়তে দেরি আছে।
রাজু বলল, “মামা, ট্রেন থেকে নামি?”
আজগর মামা বললেন, “নাম।” সাগর বলল, “আমিও নামি?”
“নাম। বেশি দূরে যাবি না কিন্তু। দুজনে একসাথে থাকবি। যখন ঘণ্টা দেবে চলে আসিস।”
“ঠিক আছে মামা।”
আজগর মামা বই থেকে চোখ তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, “ট্রেনের নিচে কাটা পড়িস না যেন!”
“যাও!” রাজু আর সাগর ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।
আজগর মামা কোনোকিছুতেই না করেন না, এইজন্যে রাজু মামাকে এত পছন্দ করে। যদি আব্বা আর আম্মা থাকতেন তা হলে এতক্ষণে দুজনে মিলে ধমক দিয়ে তাদের বারোটা বাজিয়ে দিতেন।
ট্রেন থেকে নেমে রাজু সাগরকে নিয়ে প্রথমে ইঞ্জিনটা দেখতে গেল। কী বিশাল ইঞ্জিন-গুমগুম শব্দ করছে! দেখে মনে হয় যেন একটা বিশাল ডাইনোসর কেউ বেঁধে রেখেছে বলে রেগে ওরকম শব্দ করছে। পুরো ট্রেনটাকে এই ইঞ্জিনটা টেনে নিয়ে যায়, দেখে বিশ্বাস হতে চায় না। ইঞ্জিনটা দেখে সাগর বলল, “আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনের ড্রাইভার হব।”
রাজু সাগরের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি। তুমি কী হবে?”
রাজু উদাস-উদাস মুখে বলল, “এখনও ঠিক করিনি। ফাঁইটার প্লেনের পাইলট হতে পারি।”
“প্লেনে কি হুইসিল আছে?”
“নেই।”
সাগর মাথা নাড়ল, “তা হলে আমি পাইলট হব না।”
রাজু সাগরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না, সে নিজে যখন ছোট ছিল তখন তার ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ফায়ার ব্রিগেডের ড্রাইভার হবে।
ইঞ্জিনটা দেখে তারা হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিল। স্টেশনে কতরকম মানুষ কিছু বেদেনি বসে আছে কাঁচের চুড়ির ঝাপি নিয়ে। কিছু ন্যাংটো ছেলে ছোটাছুটি করছে, কোমরে কালো সুতো দিয়ে ঘুঙুর বাধা, সেটা টুং টুং করে বাজছে সাথে সাথে, দেখে মনে হয় খুব মজার একটা খেলা চলছে এখানে। একটা ছাগল খুব গম্ভীর মুখে একটা ঠোঙা চিবিয়ে যাচ্ছে, পাশেই একটা কুকুর–সেটা তার পাশে দিয়ে যেই হাঁটছে তাকে খুঁকে যাচ্ছে, মনে হয় সেটাই যেন তার চাকরি। স্টেশনে ট্রেনের এত লোকজন, হৈচৈ–তার মাঝে একজন ময়লা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে–লোকটির নিশ্চয়ই অনেক ঘুম পেয়েছে।
রাজু আর সাগর যখন হেঁটে নিজেদের কামরার কাছাকাছি চলে এসেছে হঠাৎ তাদের সামনে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। হৈচৈ শুরু হয়ে গেলে রাজুর সবসময় একটু ভয়-ভয় করে, কিন্তু সাথে সাথে সেটা কী জন্যে হচ্ছে দেখার খুব কৌতূহল হয়। সে সাগরের হাত শক্ত করে ধরে সেটা দেখতে এগিয়ে গেল। কাছে যেতে না-যেতেই জায়গাটাতে খুব ভিড় জমে গেল, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে কোনো এক ধরনের ধস্তাধস্তি হচ্ছে। রাজু কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে, আর সাগর সাথে সাথে চেঁচাতে শুরু করে, “আমি দেখব, আমি দেখব।”
সামনে মানুষের খুব ভিড়, রাজু ভালো করে দেখতে পারছিল না, কিন্তু যেটুকুও দেখল তাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল, একজন মানুষকে ধরে অনেকগুলি মানুষ মিলে মারছে। সে কী মার, ঘুষিতে মুখ ফেটে রক্ত বের হয়ে আসছে, চুলের মুঠি ধরে মুখে ঘুষি মারছে, মাটিতে ফেলে লাথি মারছে–কী ভয়ংকর একটা দৃশ্য! লোকটাকে মারতে মারতে মানুষগুলি আস্তে আস্তে আরও খেপে উঠছে, দেখে মনে হয় কেউ যেন আর পুরোপুরি মানুষ নেই, কেমন যেন জন্তু-জন্তু হয়ে উঠেছে। চিৎকার করে গালি দিতে দিতে একজন আরেকজনের ওপর দিয়ে মানুষটাকে মারছে–এরকম করে মারলে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে!
মানুষের ধাক্কাধাক্কি হৈচৈ আরও বাড়তে থাকে, তার মাঝে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে রাজু আর সাগর পিছনে সরে আসে। রাজু তবু কিছুটা দেখতে পেরেছে, সাগর কিছু দেখেনি, তখনও তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে, “কী হয়েছে? আমি দেখব, আমি দেখব—”
যে-মানুষটাকে মারছে সেই মানুষটা এখন চিৎকার করে কাঁদছে, কিন্তু কারও ভিতরে কোনো মায়াদয়া নেই, মনে হয় তাকে মেরেই ফেলবে। কেন জানি হঠাৎ রাজুর শরীর খারাপ হয়ে যায়, মনে হতে থাকে বুঝি হড়হড় করে বমি করে ফেলবে। রাজু সাগরের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল, আর ঠিক তখন দেখল আজগর মামা ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, বিশাল গলায় হাঁক দিয়ে বলছেন, “কী হচ্ছে এখানে? কী হচ্ছে?”