আম্মা বললেন, “মোটামুটি। এত কাজের ঝামেলা–”
“সে কী।” মামা বললেন, “ছাড়িস না খবরদার! এত সুন্দর গলা তোর! গা দেখি একটা গান!”
“যাও! এইভাবে গান গাওয়া যায় নাকি?”
“এইভাবেই গাওয়া যায়–এখন তোর জন্যে শামিয়ানা টাঙিয়ে ঢাক ঢোল আনব নাকি! এইভাবেই গা!”
অন্য কেউ বললে কী হত কে জানে, কিন্তু আজগর মামা কিছু বললে কেউ সেটা ফেলে দিতে পারে না। আম্মা আব্বার গায়ে হেলান দিয়ে প্রথমে মৃদু স্বরে, তারপর আস্তে আস্তে গলা খুলে গান গেয়ে উঠলেন–আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই গান কিন্তু কী সুন্দর! রাজু অবাক হয়ে ভাবল আজ রাতে তারা যে সবাই এখানে এসেছে সেটা ঐ বুড়ো লোকটা জানল কেমন করে?
রাজু আর সাগর গিয়ে আজগর মামাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আম্মার গলার গান বাতাসে জাদুমন্ত্রের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল, আকাশ থেকে জোছনা গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে পড়তে লাগল আর নারকেল গাছের পাতা বাতাসে তিড়তিড় করে নড়তে লাগল।
হঠাৎ করে রাজুর মনে হল, বেঁচে থাকার ব্যাপারটা কী সে মনে হয় বুঝতে পেরেছে।
২. দ্বিতীয় দিন
রাজুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। তাদের ঘরে দুটি বিছানা একত্র করে একটা বড় বিছানা তৈরি করে তার মাঝে সাগর, রাজু আর আজগর মামা ঘুমিয়েছিল। ঘুমুতে ঘুমুতে অনেক দেরি হয়েছিল, আজগর মামা এলে সবসময় তা-ই হয়, সব নিয়ম কানুন ওলটপালট হয়ে যায়। সাগর এখনও ঘুমিয়ে আছে, রাজু উঠে পড়ল। বসার ঘর থেকে আব্বা, আম্মা আর আজগর মামার গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। চোখ মুছে সে বসার ঘরে উঁকি দিল–আজগর মামা সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, হাতে গামলার মতো বড় একটা মগ, সেটা বোঝাই গরম চা। মামা রাজুকে দেখে একটা হাঁক দিলেন, “রাজু! রেডি হয়ে যা।”
“কেন মামা?”
“যাবি আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“আমার বাসায়। দেখবি কী ফাস্টক্লাস একটা মোটর সাইকেল কিনেছি–ইয়ামাহা একশো সি.সি.! গুলির মতন যায়। রেডি হ।”
“সত্যি? রাজু তার আম্মা-আব্বার দিকে তাকাল।
আজগর মামা একটা ধমক দিয়ে বললেন, “সত্যি না তো কী? পরীক্ষা শেষ, এখন ঘরে বসে বসে টেলিভিশন দেখে পচে যাবি নাকি? যা, সাগরকে ডেকে তোল–”
আম্মা বললেন, “দাদা, তোমার অসুবিধে হবে, ওরা খুব জ্বালাতন করে।”
“করলে করবে। আজগর মামা গোঁফের ফাঁক দিয়ে হেসে বললে, আমিও জ্বালাতন করব। সমান-সমান হয়ে যাবে।”
রাজু আনন্দে একটা চিৎকার দিয়ে গিয়ে সাগরকে ডেকে তুলল। অন্য দিন হলে সাগর উঠেই রেগেমেগে কিছু একটা বলে বসত। আজকে কিছুই করল না, মামার বাসায় যাবে শুনে সেও চিৎকার করে বিছানা থেকে নেমে দুই হাত প্লেনের মতো দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সারা ঘরে দৌড়াতে শুরু করে।
ট্রেন দশটার সময়, হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিকঠাক করে নিতে হবে। বেশি জিনিস নিয়ে কোথাও যাওয়া মামা দুচোখে দেখতে পারেন না–আগেই ঘোষণা করে দিলেন যে যেটা নিজে টেনে নিতে পারবে সে সেটা নেবে। রাজু আর সাগর তাদের স্কুলব্যাগ খালি করে সেখানে কয়েকটা জামাকাপড় কাগজ-কলম গল্পের বই ভরে নিল। সাগর তার কিলবিলে গোখরো সাপ আর খেলনা-পিস্তল নিয়ে নিল। রাজু নিল তার পেন্সিল কাটার চাকু। আম্মা টুথব্রাশ চিরুনি আর তোয়ালে বের করে দিলেন। সাথে পানির বোতল আর ছোট বিস্কুটের প্যাকেট। আব্বা মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা বের করে দিলেন তার সাথে সেটা সাবধানে কীভাবে রাখতে হবে তার উপরে একটা বিশাল বক্তৃতা।
বের হবার আগে সকালের নাস্তা করে যেতে হবে, কিন্তু উত্তেজনায় রাজু আর সাগর কিছু খেতে পারছিল না। আম্মা বললেন, প্লেটের পুরো খাবার শেষ না করা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে পারবে না, তাতে ট্রেন ফেল করলে করবে।
এমনিতেই রোজ যা খেতে হয় আজকে তার থেকে দ্বিগুণ খেতে দিয়েছেন–শুধু তা-ই নয়, খাওয়ার পর পুরো এক গ্লাস দুধ-জীবনের উপরে বিতৃষ্ণা এসে যাবার মতো অবস্থা!
শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি তারা ঘর থেকে বের হল, আম্মা-আব্বা হেঁটে হেঁটে একেবারে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। স্কুটারে ওঠার আগে আম্মা প্রথমে সাগরকে, তারপর রাজুকে একবার বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “সাবধানে থাকিস। মামাকে বেশি জ্বালাবি না।”
সাগর বলল, “আর মামা যদি জ্বালায়?”
আম্মা হেসে ফেললেন, বললেন, “তা হলে কী হবে তো জানি না।”
.
স্টেশনে পৌঁছানোর পর থেকে শুধু দৌড়। প্রথমে দৌড়ে দৌড়ে টিকেট কেনা, তারপর দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে ওঠা। ট্রেনে উঠে দেখা গেল সেটা ভুল ট্রেন, তারপর আবার দৌড়ে দৌড়ে ঠিক ট্রেনে ওঠা। ছুটে ছুটে রাজু আর সাগরের দম ফুরিয়ে গেল সত্যি, কিন্তু ভারি মজা হল। ট্রেনে ওঠার পর দেখা গেল এত ছোটাছুটি করে ট্রেনে ওঠার কোনো দরকার ছিল না, ট্রেন ছাড়তে বেশ দেরি আছে।
ট্রেনে ওঠার আগে মনে হয় ট্রেনটা যেন ছেড়ে না দেয়, ট্রেনে ওঠার পর মনে হয় এখনও ছাড়ছে না কেন ট্রেনটা! সাগর একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “ছাড়ছে না কেন ট্রেনটা?”
আজগর মামা একটা খবরের কাগজ কিনে নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে সেটা পড়তে পড়তে বললেন, “সময় হলেই ছাড়বে। তোর এত তাড়া কিসের?”
সাগর আর রাজু তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকাল, ট্রেনে বসে সময় কাটানো খুব সোজা, চারিদিকে এত মজার মজার জিনিস থাকে যে দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। সেসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ গার্ডের বাঁশি শোনা গেল, ট্রেনের ইঞ্জিন তখন কয়েকটা হুইসিল দিয়ে নড়তে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বেগ বাড়তে থাকে, খটাং খটাং শব্দ হয় আর ট্রেনটা কেমন মজার মতো দুলতে থাকে। রাজু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, কত কী মজার জিনিস বাইরে! এমনিতেই যেসব জিনিস দেখলে একটুও মজা লাগার কথা না, কিন্তু ট্রেন থেকে দেখলে সেটাকেই কী অসাধারণ মনে হয়। একটা মানুষ উদাস মুখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে কিংবা একটা ছোট ছেলে ট্রেনের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে, যেন ট্রেনটাকে সে দৌড়ে হারিয়ে দেবে। একটা গরু ট্রেনের শব্দ শুনে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে আর তার পিছনে লাল চুলের একটা ছোট মেয়ে। দৌড়াচ্ছে সেটাকে ধরার জন্য, কী মজার দৃশ্য! শহরে রাস্তাঘাট আর গাড়ি স্কুটার দেখে দেখে চোখ পচে গেছে, ট্রেন থেকে বিশাল ধানক্ষেত নদী নালা পুকুর দেখে রাজুর চোখ জুড়িয়ে যায়।