“হ্যাঁ, যে বিক্রি করছিল সে বলে বাইগুড়ি। খুব ভালো নাকি খেতে।”
আম্মা বললেন, “এই চড়ুই পাখি তুমি খাবে?”
“ধুর! আজগর মামা হাত নেড়ে বললেন, এইটুকুন পাখিকে লোকজন জবাই করে করে খাবে শুনেই খারাপ লাগল। তাই কিনে এনেছি–সবগুলিকে ছেড়ে দেব।”
সাগর হাততালি দিয়ে বলল, “আমি ছাড়ব মামা আমি ছাড়ব!” আজগর মামা বললেন, “সবাই মিলে ছাড়” কী মজা হবে না?”
সাগর মাথা নাড়ল, রাজু মাথা নাড়ল, এমন কি আব্বা আর আম্মাও মাথা নাড়লেন। মামা পাখির খাঁচটা টেবিলের উপর রাখলেন, আম্মা বললেন, “টেবিলে রেখো না, নোংরা করে দেবে!”
আজগর মামা আম্মার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “করুক। চড়ুই পাখি কি আর মানুষ নাকি? কতই আর নোংরা করবে।”
বসার ঘর লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে আজগর মামা তার পোঁটলা-পুঁটলি খুলতে লাগলেন। মাটির হাঁড়িতে করে মোষের দুধের দই বের হল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি গোখরো সাপ বের হল, হাতে ধরলেই সেটা কিলবিল করে নড়তে থাকে। বিচিত্র রঙের মাটির পুতুল বের হল, মানুষের মস্তিষ্ক নামের ছবিওয়ালা ইংরেজি বই বের হল, নলেন গুড়ের সন্দেশ বের হল, রংচঙে শার্ট বের হল, গানের ক্যাসেট বের হল, খেলনা-পিস্তল বের হল, পেন্সিল কাটার চাকু বের হল, ছোট একটা ঢোল বের হল এবং সবার শেষে অনেকগুলি বাংলা গল্প-কবিতার বই বের হল। কে কোনটা নেবে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হল। আজগর মামাও সেই কাড়াকাড়িতে যোগ দিলেন এবং দেখা গেল শেষ পর্যন্ত তার ভাগে পড়েছে মাটির হাঁড়িতে করে আনা দুর্গন্ধযুক্ত মোষের দুধের দই। আব্বা পেয়েছেন রংচঙে শার্ট আর বই, আম্মা পেয়েছেন গানের ক্যাসেট আর সন্দেশ, বাকি সবকিছু রাজু আর সাগরের। তারা দুজনে কে কোনটা নেবে সেটা নিয়ে ঝগড়া বেধে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আজগর মামা এলে সবাই এত ভালো হয়ে যায় যে কেউ আর ঝগড়াঝাটি করল না। রাজু নিজে থেকে সাগরকে কিলবিলে সাপটা দিল, সাগরও পেন্সিল কাটার চাকুটার জন্যে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল না।
আজগর মামার জন্যে আবার টেবিলে খাবার দেওয়া হল, এবারে আব্বাও খেতে বসলেন। আম্মা দুজনকে খাবার তুলে দিতে লাগলেন আর পুরো সময়টাতে রাজু আর সাগর আজগর মামার গায়ে লেপটে দাঁড়িয়ে রইল। আজগর মামার খাওয়া একটা দেখার মতো ব্যাপার, যেটাই তাঁকে খেতে দেওয়া হয় সেটাই এত মজা করে খান যে দেখে লোভ লেগে যায়। মোরগের হাড়কে চুষে চুষে বারোটা বাজিয়ে সেটাকে চিবিয়ে একেবারে তুষ করে ফেলে দেন। মাছের মাথা কড়কড় করে চিবিয়ে সেটাকে লজেন্সের মতো করে চুষতে থাকে, ডালমাখা ভাত মুখে পুরে চোখেমুখে এমন একটা ভাব নিয়ে আসেন যেন দেখে মনে হয় পৃথিবীতে এর থেকে ভালো কোনো খাবারই নেই। রাজুর ধারণা, আজগর মামাকে যদি একটা খবরের কাগজ খেতে দেওয়া হয়, মামা সেটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিয়ে এমনভাবে চিবাতে থাকবেন যে দেখে মনে হবে বুঝি রসগোল্লা খাচ্ছেন।
খাওয়ার পর পাখির খাঁচা নিয়ে সবাই মিলে ছাদে উঠে এল। ছাদটা নির্জন সুনসান, আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ, তাতেই খুব সুন্দর নরম একটা আলো। পাশে নারকেল গাছ বাতাসে ঝিরঝির করে নড়ছে, দেখে কী যে ভালো লাগছে বলার মতো নয়। মামা পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট চড়ুই পাখি বের করে এনে বললেন, “যা ব্যাটা উড়ে যা–সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকিস!”
চড়ুই পাখিটা যেন মামার কথাটা বুঝতে পারল–চিড়িক করে একটা শব্দ করে রাতের আকাশে উড়ে গেল। মামার কথা শুনে রাজু আর সাগর হি হি করে হাসতে থাকে। মামা ধমক দিয়ে বললেন, “হাসছিস কেন? একটু উপদেশ দিয়ে দেয়া ভালো না?”
সাগরও পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা চড়ুই পাখি বের করে এনে বলল, “যা পাখি উড়ে যা, মিলেমিশে থাকিস!”
তখন আম্মাও পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা পাখি বের করে এনে বললেন, “যা পাখি উড়ে যা! পৃথিবীর যত মানুষ তাদের বউদের সাথে ঝগড়া করে সবার মাথায় পিচিক করে বাথরুম করে দিস!”
শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, আব্বা হাসলেন সবচেয়ে জোরে, তারপর আব্বাও একটা চড়ুই পাখি বের করে এনে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “যা পাখি উড়ে যা! পৃথিবীর যত বদমেজাজি বউ আছে তাদের নাকের ডগায় ঠোকর দিয়ে আয়!”
তখন রাজু একটা পাখি বের করে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “পৃথিবীর সব অঙ্কের মাস্টারের মাথায় বাথরুম দিস!”
তখন সাগর একটা পাখি বের করে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “যা রে পাখি উড়ে যা, আজগর মামার মাথায় বাথরুম করে দিস!”
তখন আজগর মামা খুব রেগে যাবার ভান করে সাগরকে মাথায় উপরে তুলে নিলেন যেন আছাড় মেরে ফেলে দেবেন। আর তা-ই দেখে সবাই আবার হি হি করে হাসতে লাগল।
একটা একটা করে সবগুলি পাখিকে ছেড়ে দেওয়া হল। ছাড়ার আগে সবগুলি পাখিকেই কোনো-না-কোনো উপদেশ দিয়ে ছাড়া হল। কাউকে বলা হল বানান শিখতে, কাউকে বলা হল অঙ্ক করতে, কাউকে বলা হল ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করতে। অনেকগুলি পাখি ছাড়া হল ভণ্ড পীর-ফকিরদের মাথায় বাথরুম করতে। আম্মা অনেকগুলি ছাড়লেন যারা তিন-চারটা বিয়ে করে তাদের মাথায় ঠোকর দিতে। সবচেয়ে বেশি পাখি ছাড়া হল রাজাকারদের চাঁদিতে বাথরুম করার জন্যে।
পাখিগুলি ছেড়ে দেবার পর সবাই ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের নরম আলোতে কেন জানি কেউ জোরে কথা বলে না, আজগর মামা পর্যন্ত আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলেন। খানিকক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে মামা আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেল, “ঝর্না, তুই গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?”