আগুনালি সবাইকে দেখে একটু লজ্জা-লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু তার মাঝেই দাঁত বের করে হেসে রাজুর কাছে এসে তার হাত ছুঁয়ে বলল, “রাজু তুমি তো শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছ!”
রাজু কিছু না বলে আগুনালির দিকে তাকিয়ে হাসল। আগুনালি বলল, “তোমাকে দেখতে ম্যাচের কাঠির মতো লাগছে। শুকনো একটা শরীর–তার মাঝে বড় একটা মাথা! বেশি করে খাচ্ছ তো?”
“খাচ্ছি।”
“হ্যাঁ, বেশি করে খাও।”
“খাব। তুমি ভালো আছ?”
“ভালো আছি।”
“তোমার আগুনের কাজকারবার কেমন চলছে?”
“ভালো।” আগুনালি হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, “নতুন একটা বোমা আবিষ্কার করেছি, তুমি যদি দেখ–”
আজগর মামা হঠাৎ তাদের গলা নামিয়ে কথা বলতে দেখে চিৎকার করে বললেন, “এদের আলাদা করে রাখো। এক্ষুনি আলাদা করে রাখো, নাহয় আবার কিছু-একটা কেলেঙ্কারি করে ফেলবে!”
মামার কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল আর আজগর মামা তখন আরও রেগে ওঠার ভান করে বললেন, “তোরা ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি? মোটেও ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি।”
মামা রাজুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “গুলি খেয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছিস বলে ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দেব? কক্ষনো না। নেভার। শাস্তি তোকে পেতেই হবে!”
“কিসের শাস্তি?”
“এখনও জানিস না কিসের শাস্তি? ঠিক আছে বলছি। আমার নতুন মোটর সাইকেলটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস! ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো তোর নানার আমলের বন্দুকটা যত্ন করে রেখেছিলাম, সেটাকেও শেষ করেছিস। ব্যারেল বাকা, পিন ভাঙা! বন্দুকটা বের করার জন্যে আলমারিটা ভেঙেছিস। বাসার দরজা-জানালা খোলা রেখে পালিয়েছিস, চোর এসে বাসার সব জিনিস নিয়ে পালিয়েছে। যেসব নেয়নি বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপচুপে।”
সাগর হি হি করে হেসে বলল, “সব তোমার দোষ মামা!”
“আমার দোষ?”
”হ্যাঁ মামা। তুমি যদি না যেতে, তুমি যদি থেকে যেতে, তা হলে কিছু হত। যদি চান মিয়াও আসত।–”
মামা মাথা চুলকে বললেন, “হ্যাঁ, চান মিয়ার ব্যাপারটায় অবিশ্যি কারওই হাত নেই। আমি নিজে তাকে পাঠিয়েছি, কিন্তু আমি কেমন করে জানব ফেরিঘাটে সে ঝগড়া মারপিট করবে, আর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে হাজতে ভরে রাখবে? সেটা আমি কেমন করে জানব?”
সাগর মাথা নেড়ে বলল, “সেটা আমি জানি না! সব দোষ তোমার মামা।”
শাওন বলল, “না মামা, আপনারা সবাই ভুল বলছেন। আসলে কারও কোনো দোষ নেই। আপনি যদি চলে না যেতেন তা হলে রাজুর সাথে আগুনালির দেখা হত না। আর আগুনালির সাথে যদি রাজুর দেখা না হত তা হলে আগুনালি তাকে ভূত দেখাতে নিয়ে যেত না। আর ভূতের জায়গায় যদি আমাকে না দেখত তা হলে এতদিনে আমি সত্যি সত্যি মরে ভূত হয়ে যেতাম।”
সাগর হি-হি করে হেসে বলল, “সত্যিকারের ভূত?”
“হ্যাঁ, সত্যিকারের ভূত।”
আজগর মামা নরম চোখে শাওনের দিকে তাকিয়ে তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ মা। খোদা তোমাকে বাঁচানোর জন্যেই আমাকে গ্রামে পাঠিয়েছিলেন। গ্রামে গিয়ে আমি স্কুলটাকেও বাঁচিয়েছি। মোটর-সাইকেল বন্দুক আলমারি বাসার জিনিসপত্র সবকিছু নষ্ট হয়েছে খোদার ইচ্ছায়। আমি সবকিছু মেনে নিচ্ছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই মানতে রাজি না। সেই অপরাধের শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।”
“সেটা কোন অপরাধ মামা?”
“বিশাল একটা ডেকচিতে তোরা যে বিশ কে, জি, খিচুড়ি বেঁধে বাইরে ফেলে রাখলি, একবারও তোদের মনে হল না সেটা পচে গলে নষ্ট হয়ে পোকা হয়ে যেতে পারে?”
“তাই হয়েছে মামা?” সাগর চোখ বড় করে বলল, “তাই হয়েছে?”
“হ্যাঁ। মামা মাথা নাড়লেন, তাই হয়েছ। যেই মুহূর্তে রাজু ভালো হবে তখন সবাই মিলে আমার বাসায় গিয়ে আমার সেই ডেকচি তোদের পরিষ্কার করে দিতে হবে।”
রাজু খিকখিক করে হেসে বলল, “দেব মামা, দেব।”
“আর যখন আমার বাসায় যাবি, আমার মোটরসাইকেল আর বন্দুক থেকে একশো হাত দূরে থাকবি। কমপক্ষে একশো হাত!”
“থাকব মামা।”
আজগর মামা হঠাৎ করে রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, তোরা যে হৈ চৈ করে মান্ধাতা আমলের একটা গাদাবন্দুক নিয়ে গেলি, একবারও কি ভেবেছিলি যে বন্দুক ব্যবহার করতে গুলি লাগে?”
“গুলি?”
“হ্যাঁ, তোরা কি জানিস ওটাতে গুলি ছিল না? ঐ বন্দুকটা একটা লাঠি হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসত না?”
শাওন খিলখিল করে হেসে বলল, “গুলি ছাড়াই ওটা চমৎকার কাজ করেছে, মামা। আমার বাবাকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরের বার”
মামা চোখ পাকিয়ে বললেন, “দাঁড়াও তোমাদের পরের বার আমি বের করছি!”
মামার রাগ দেখে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে রাজুর বুকের ব্যান্ডেজটাতে হঠাৎ টনটন করে ওঠে–তবু সে হাসি থামাতে পারে না। রাত্রে ডাক্তার রাজুর বুকের ব্যান্ডেজটা পালটে দিচ্ছিলেন। ভেতরের ঘা শুকিয়ে আসছে, খানিকক্ষণ লক্ষ করে কী-একটা ওষুধ দিয়ে নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বললেন, “ইয়ংম্যান, তুমি খুব লাকি, তাই বেঁচে গিয়েছ। কিন্তু একটা দাগ থেকে যাবে সারাজীবনের জন্যে। যখন বড় হবে, বিয়ে করবে–তোমার বউকে এই দাগটা নিয়ে কী বলবে এখন থেকে সেটা ঠিক করে রেখো!”
রাজু ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “যদি এমন হয় যে সে আগে থেকে জানে?”
ডাক্তার রাজুর কথা ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললে ইয়ংম্যান?”