রাজু হাত নামিয়ে এনে চোখ বন্ধ করল। ভয় নয়, আতঙ্ক নয়, কষ্ট বা যন্ত্রণা নয়, ক্লান্তি লাগছে তার। কী অমানুষিক ক্লান্তি–সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে সেই ক্লান্তিতে। কেউ যেন তাকে ডাকছে বহুদূর থেকে। খুব চেষ্টা করে চোখ খুলল রাজু। তার উপর ঝুঁকে আছে শাওন। চিৎকার করে ডাকছে তার নাম ধরে। রাজু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। শাওনের দিকে, কী সুন্দর দেখতে মেয়েটি! আহা, কী সুন্দর! সে কি তাকিয়ে থাকতে পারবে শাওনের দিকে? নাকি আবার তার চোখ বন্ধ হয়ে আসবে?
রাজু শাওনের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল সে ডাকছে তার নাম ধরে, “রাজু-রাজু-রাজু-”
রাজুর ইচ্ছে করল বলতে, এই তো আমি কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। সে শাওনের দিকে তাকিয়ে রইল, দেখল সে এখনও চিৎকার করে ডাকছে, কিন্তু তার কথা আর শোনা যাচ্ছে না। শুধু তাকে দেখছে, কিন্তু কিছু আর শুনতে পারছে না। মানুষজনের চিৎকার হৈচৈ কোলাহল কিছু নেই। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে শুধু আশ্চর্য সুমসাম নীরবতা।
এটাকেই নিশ্চয়ই মৃত্যু বলে–এমন কিছু তো খারাপ নয়।
শাওন অবাক হয়ে দেখল রাজুর মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠেছে।
৭. পরিশিষ্ট : দুই সপ্তাহ পর
টেবিলের উপর একটা ফুলদানি, সেটা ভরে উপচে রয়েছে ফুলে। ঘরের ভিতরে সাধারণত ফুল থাকে না, ফুল থাকবে বাগানে, তবুও কীভাবে জানি একটা মৌমাছি খবর পেয়ে চলে এসেছে ভিতরে। একটা একটা করে ফুল পরীক্ষা করে দেখছে মৌমাছিটা, মনে হচ্ছে না খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের কোনো ফুলই পছন্দ হচ্ছে। না, আবার চলেও যাচ্ছে না বিরক্ত হয়ে।
রাজু বিছানায় আধশোয়া হয়ে মৌমাছিটাকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। পৃথিবীতে কত ছোট ছোট জিনিসই-না আছে যেগুলি সে কোনোদিন চোখ খুলে দেখেনি, অথচ আর একটু হলে তার কিছুই আর দেখা হত না। গুলিটা যদি আর এক সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যেত তার হৃৎপিণ্ড ফুটো হয়ে যেত। ফুসফুঁসে গুলি লেগে সেটা বুজে গিয়েছিল, বেঁচে যে গিয়েছে সেটা নাকি একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বড় বিপদটা কেটে গিয়েছে, এখন শুধু ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়া। ডাক্তার বলেছে কম করে হলেও তিন মাস সময় লাগবে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু কিছু করার নেই। রাজু একটা নিঃশ্বাস ফেলে একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল সাথে সাথে বুকের ভিতরে টনটন করে ওঠে যন্ত্রণায়। রাজু দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা সহ্য করে, বেঁচে থাকা বড় মধুর ব্যাপার–তার জন্যে যেটুকু কষ্ট করা দরকার সে করবে।
দরজায় টুকটুক করে একটা শব্দ হল। আম্মা উঠে গেলেন দেখতে। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই প্রথম শাওন এবং শাওনের পিছুপিছু তার মা এসে ঢুকলেন। শাওন কেমন করে এত সুন্দর হল সেটা তার মাকে দেখলে খানিকটা বোঝ যায়–দেখতে ঠিক শাওনের মতো সুন্দরী, দেখে বোঝাই যায় না শাওনের মা, মনে হয় বুঝি বড় বোন। শাওন আম্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজু কেমন আছে খালাম্মা?”
“ভালো মা, অনেক ভালো। কালকে একটু হেঁটেছে।”
“সত্যি।”
“সত্যি।”
“ওর সাথে কথা বলা যাবে?”
“হ্যাঁ মা, কথা বলা যাবে। ডাক্তার বলেছে এখন শুধু সুস্থ হওয়া বাকি। যত মন ভালো থাকবে তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন ইনফেকশান না হয়ে যায়।”
“আমরা বাইরে জুতো খুলে রেখে এসেছি খালাম্মা।”
“সেটাই ভালো।”
শাওন আর তার আম্মা রাজুর কাছে এগিয়ে গেলেন, শাওনের মা রাজুর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু আদর করে দিলেন–যেন সে পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা। রাজুর একটু লজ্জা লাগছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। শাওনের আম্মা রাজুর সাথে একটা-দুটো কথা বলে খোঁজখবর নিয়ে রাজুর আম্মার সাথে কথা বলতে লাগলেন।
শাওন তার আম্মা সরে যাবার পর বুকের কাছে ধরে রাখা প্যাকেকটা বিছানায় রেখে রাজুর উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, “কেমন আছ রাজু?”
“ভালো।”
“দেখি তোমার ব্যান্ডেজটা!”
রাজু ব্যন্ডেজটা দেখাল। ব্যান্ডেজ দেখে সে কী বোঝে কে জানে, কিন্তু তবু সে খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি না থাকলে আমি গিয়েছিলাম। এই গুলিটা তা হলে আমার মাথার মাঝে দিয়ে যেত।”
রাজু কিছু না বলে একটু হাসল। শাওন প্যাকেটটা খুলে ভিতরে থেকে কয়েকটা ডিটেকটিভ আর অ্যাডভেঞ্চার বই, দুটা ইংরেজি গানের ক্যাসেট আর একটা চকলেটের বাক্স বের করল। রাজু দেখে বলল, “সব আমার জন্য এনেছ?”
“হ্যাঁ, চকলেট অবিশ্যি আমিও কিছু খেতে পারি।”
“খাও।”
শাওন যখন খুব মনোযোগ দিয়ে চকলেটের বাক্স খুলছে ঠিক তখন হঠাৎ দড়াম করে দরজা খুলে গেল এবং সাগর মাথা ঢুকিয়ে বলল, “ভাইয়া, বলো দেখি কে এসেছে?”
সাগরের উত্তেজনা দেখে অবিশ্যি বুঝতে বাকি রইল না, মানুষটি কে হতে পারে, কিন্তু রাজু ইচ্ছে করে না-বোঝার ভান করল, জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আজগর মামা আর আগুনালি!”
“সত্যি?”
“সত্যি। এই দ্যাখো!” সে দরজা খুলে দিতেই আজগর মামা এবং তার পিছুপিছু আগুনালি এসে ঢুকল। আজগর মামাকে চেনা যাচ্ছে, কিন্তু আগুনালিকে চেনার কোনো উপায় নেই। তার চুল তেলে ভিজিয়ে পাট করে আঁচড়ানো, পরনে নতুন চকচকে শার্ট আর প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো এবং মোজা। সাগর যদি বলে দিত, রাজু তাকে হঠাৎ করে দেখে চিনতে পারত না।