শাওন রাজুর পিছনে বসে পড়ে বন্দুকটা তার বাবার বুকের দিকে তাক করে রাখল।
শাওনের বাবা লম্বা পায়ে হেঁটে আসছিল, হঠাৎ করে বন্দুকটা দেখে থেমে গেল। শাওন চিৎকার করে বলল, “আর এক পা এলে গুলি করে দেব।”
শাওনের বাবা থেমে গেল, তার ফরসা মুখ আস্তে আস্তে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁতে ঘসে বলল, “বেতমিজ মেয়ে–”
শাওন চিৎকার করে বলল, “চুপ করো তুমি চুপ করো!
রাজু কোনোদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারে তাদের ঘিরে ভিড় জমে উঠছে। রাস্তায় গাড়ি থেমে যাচ্ছে, গাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার নেমে আসছে। ট্রাক থেকে ট্রাক-ড্রাইভাররা নেমে আসছে। দোকানপাট থেকে মানুষ ছুটে আসছে। ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা বাচ্চা মেয়ে তার বয়সী একটা ছেলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সম্ভ্রান্ত চেহারার একজন মানুষের দিকে তাক করে রেখেছে–দৃশ্যটি অকল্পনীয়। কেউ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
শাওনের বাবা হুঙ্কার দিয়ে বলল, “ফারজানা–”
”আমি ফারজানা না। আবার নাম শাওন।”
শাওনের বাবার মুখ অসহ্য ক্রোধে বিকৃত হয়ে গেল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রাখল। তাদেকে ঘিরে যেসব মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
শাওনের বাবা শান্ত গলায় বলল, “আমার মেয়ে। বদ ছেলের পাল্লায় পড়ে কী করেছে দেখেন। দেশে আইন নেই? এই বয়সী ছেলের হাতে বন্দুক? মোটর সাইকেল?”
মানুষজনের মাঝে একটা গুঞ্জন শোনা যায়, আজকালকার ছেলেরা যে অসম্ভব পাজি হঠাৎ করে সে-বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকে না। শাওনের বাবা গলা উঁচিয়ে বলল, “আপনারা যারা আছেন তারা মেয়েটার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেন দেখি—”
এরকম সম্ভ্রান্ত চেহারার একজন মানুষের কথা শুনে কয়েকজন সত্যি সত্যি পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসছিল, তখন হঠাৎ শাওন চিলের মতো চিৎকার করে উঠল, “খবরদার! ঐ মানুষটা আসলে জানোয়ার। সে রাজাকার। তার বাবা রাজাকার-আমাকে মায়ের কাছে থেকে ধরে এনেছে–খবরদার কেউ কাছে আসবে না।”
যারা কাছে এগিয়ে আসছিল তারা হঠাৎ থেমে গেল। শাওনের মতো ফুটফুটে চেহারার একটা মেয়ে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে না। শাওন আবার চিৎকার করে বলল, “আমাকে বেঁধে রেখেছিল–আমি পালিয়ে এসেছি। মায়ের কাছে যাচ্ছি–এরা এসেছে আমাকে ধরে নিতে।”
কমবয়সী একজন মানুষ হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে শাওনের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”
শাওনের বাবা কিছু বলার আগেই শাওন বলল, “সত্যি। আমার কথা বিশ্বাস করলে আমার মাকে জিজ্ঞেস করেন। পুলিশ ডেকে আনেন–ঐ লোকটার কথা বিশ্বাস করবেন না। সে জানোয়ার। রাজাকার”
একটি বাচ্চা মেয়ে যদি পুলিশকে ডেকে আনতে বলে নিজের মাকে ডেকে আনতে বলে, সে নিশ্চযই বদ ছেলের পাল্লায় পা বখে-যাওয়া মেয়ে হতে পারে না। উপস্থিত লোকজন হঠাৎ করে শাওনের পক্ষে চলে আসে। শাওন আবার চিৎকার করে বলল, “আমাদের ধরে নেয়ার জন্যে দেখেন সে আমাদের গুলি করেছে–”
রাজু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শাওনের বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষটির মুখে পরাজয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বুঝতে পেরেছে সবাই শাওনের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার মুখে প্রথম ক্রোধ, তারপর ঘৃণা, এবং সবার শেষে একধরনের বিচিত্র জিঘাংসার চিহ্ন ফুটে উঠল। রাজু মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করে। হঠাৎ করে মানুষটি সত্যি সত্যি দানবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে মুখে চেহারায় একটা হিংস্র পশু বের হয়ে আসে। মানুষটি হঠাৎ শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বের করে আনে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লম্বা পা ফেলে এসে শাওনের মাথার দিকে তাক করে ধরল। রাজু মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, আর হঠাৎ করে বুঝতে পারল সে ভয় দেখানোর জন্যে শাওনের মাথায় রিভলবারটি ধরেনি, গুলি করার জন্যে ধরেছে। শাওনকে মানুষটি মেরে ফেলবে। আর একটিমাত্র মুহূর্ত, তারপর শাওন আর্তনাদ করে পিছনে পড়ে যাবে, কেউ আর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কেউ পারবে না। আর একটিমাত্র মুহূর্ত। মাত্র একটি মুহূর্ত।
সেই একটি মুহূর্ত যেন হঠাৎ বিশাল মহাকালের মতো বিস্তৃত হয়ে গেল। রাজু দেখতে পেল ট্রিগারে আঙুল চেপে বসেছে, দেখতে পেল রিভলবারের সকেট ঘুরতে শুরু করেছে, দেখতে পেল রিভলবারের হ্যাঁমার পিছন দিকে সরে যাচ্ছে, দেখতে পেল মানুষটির মুখে কুশ্রী একটা আত্মতৃপ্তির হাসি লেপটে যাচ্ছে, আর সেইসব কিছু দেখতে দেখতে হঠাৎ রাজুর সমস্ত যন্ত্রণা যেন উবে গেল ম্যাজিকের মতো। হঠাৎ করে তার শরীরে যেন চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা এসে ভর করল। তার সমস্ত শরীর হঠাৎ ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে উঠল, তারপর ক্রুদ্ধ গোখরো যেমন করে ছোবল দেয় ঠিক সেইরকম আক্রোশ নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল দানবটির দিকে। সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল মানুষটির রিভলবার-ধরা হাতটিকে।
প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনতে পেল রাজু, সাথে সাথে ভয়ংকর একটা আঘাতে ছিটকে পড়ল নিচে। গুলি লেগেছে তার শরীরে। কোথায় লেগেছে গুলি? ব্যথা করছে না কেন তার? রাজু চোখ খুলে তাকাল, রাস্তায় শুয়ে আছে সে, উপরে আকাশ। কী সুন্দর নীল আকাশ! আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ টের পেল তার শরীর ভিজে যাচ্ছে উষ্ণ রক্তে। উপুড় করে রাখা বোতলের মতো গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রাজু তার হাতটা রাখল বুকে, হাত ভিজে গেল রক্তে। সে চোখের সামনে এনে ধরল তার হাত, টকটকে লাল হয়ে আছে তার হাত। রক্ত এত লাল হয়? কী আশ্চর্য!