“বোঝা যাচ্ছে না।”
রাজু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দেয়। এখন তার আর কিছু করার নেই। শাওনকে নিয়ে ঢাকার দিকে ছুটে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
বাজারের কাছে এসে সে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে আনল, রাস্তার পাশে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। একটা বাচ্চা ছেলে বিশাল একটা মোটরসাইকেল ছুটিয়ে নিচ্ছে আর তার পিছনে বসে আছে একটা ফুটফুটে মেয়ে। বাতাসে মেয়েটার চুল উড়ছে আর সে শক্ত করে ধরে রেখেছে ছেলেটাক। মেয়েটার পিঠে ঝুলছে একটা বন্দুক। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য–তারা সত্যিই দেখছে কি না কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই মোটর-সাইকেলটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তাদের সামনে থেকে।
রাজু ডানদিকে ঘুরে রাস্তায় উঠে গিয়ে আবার মোটরসাইকেলের বেগ বাড়িয়ে দিল। রাস্তাটা অনেক ভালো, তার মনে হল সে বুঝি মোটর-সাইকেলকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সত্যি আর উড়িয়ে নেওয়ার দরকার নেই, আগুনালি যদি মাইক্রোবাসটাকে পুড়িয়ে দিতে পেরে থাকে তাদের বিপদ মনে হয় কেটে গেছে। এখন তাদের শুধু সরে যেতে হবে। যত দূর সম্ভব সরে যেতে হবে।
বড় রাস্তায় উঠে প্রথম কিছুক্ষণ রাজু আর শাওনের সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে ছিল। খুব ধীরে ধীরে তারা খানিকটা সহজ হল। মোটর-সাইকেলটা মোটামুটি ভালভাবে যাচ্ছে, রাস্তার দুপাশের গাছপালা হুশ হুশ করে বের হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে বিকট একটা ট্রাক সামনের দিকে থেকে ছুটে আসে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে রাজুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তবে বড় রাস্তায় ট্রাক বাস গাড়ির মাঝখানে সে আগেও সাইকেল চালিয়েছে, কাজেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে রাস্তার এক পাশে চলে এসে ট্রাকগুলিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তবে ওদের সমস্যা হল সম্পূর্ণ অন্যদিকে দিয়ে যেসব গাড়ি ট্রাক বাস তাদের পিছন থেকে আসছে তারা তাদের দেখে ব্যাপারটা কী হচ্ছে বোঝার জন্যে তাদের পাশে পাশে যাবার চেষ্টা করে। কৌতূহলী মুখ জানালা দিয়ে মাথা বের করে, কিছু একটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করে। তখন হয় রাজুকে এক্সেলেটর ঘুরিয়ে সামনে চলে যেতে হয়,
হয় ব্রেক করে পিছিয়ে আসতে হয়। তবু তারা মানুষের কৌতূহল থেকে উদ্ধার পাবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় খবর ছড়িয়ে পড়েছে, পুলিশের কানে যখন যাবে তখন তারাও কি চলে আসবে না? মানুষের যখন বিপদ তখন তো পুলিশের কাছেই যাবার কথা, কিন্তু এই ব্যাপারটায় পুলিশ কি তাদের পক্ষে, নাকি শাওনের বাবার পক্ষে?
রাজু যত ভালো করে মোটরসাইকেল চালাবে ভেবেছিল তার থেকে অনেক ভালো করে চালাচ্ছে। প্রথম প্রথম যেটুকু ভয় ছিল এখন তার একবিন্দুও নেই। যত সময় যাচ্ছে উলটো তার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যদি পিছন থেকে ধরতেও আসে সে এত জোরে চালিয়ে যেতে পারবে যে কেউ তাকে ধরতেও পারবে না। মনে হচ্ছে যদি সামনে একটা খানাখন্দ চলে আসে উড়ে বের হয়ে যেতে পারবে।
মোটর-সাইকেলে যেতে যেতে রাজু আর শাওন টুকরো টুকরো কথা বলতে শুরু করে, বাতাসের শব্দ, মোটরসাইকেলের গর্জন সব মিলিয়ে কথা শোনা যায় না, তাই চিৎকার করে করে কথা বলতে গচ্ছিল। জরুরি কথা চিৎকার করে বলা যায়, কিন্তু সাধারণ কথা চিৎকার করে বলা সহজ নয়। তবু তারা চেষ্টা করে যেতে থাকে–কে কোন ক্লাসে পড়ে, কোন স্কুলে যায়, রোল নম্বর কত, সবচেয়ে খারাপ লাগে কোন সাবজেক্ট পড়তে, সরল অঙ্ক এত কঠিন, কিন্তু সরল নাম কেন দেওয়া হল–তারা এই ধরনের কথাবার্তা চালিয়ে যায়। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য পালটে যেতে থাকে। প্রথমে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ছিল, ধীরে ধীরে সেগুলি পালটে গিয়ে গ্রামের দৃশ্য এসে যায়। রাস্তার দুপারে বিস্তীর্ণ সোনালি ধানক্ষেত, বিল, নদী, গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, গোরু নিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলে। এরকম পরিবেশ এলে মন ভালো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু রাজুর মন ভালো হয়ে যাচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা ভয়–সবকিছু মিলিয়ে একধরনের অশান্তি। সাগরকে একা একা ছেড়ে এসেছে, আগুনালি আবার মাইক্রোবাসের ভিতর একটা বোমা ছেড়ে বসেছে, সেটা করতে গিয়ে তার আর কোনো বিপদ হল কি না, ধরা পড়ে গেল কি না? যদি ধরা পড়ে গিয়েই থাকে তা হলে কী অবস্থায় আছে, সাগরই-বা কী অবস্থায় আছে–সব মিলিয়ে ভিতরের চাপা দুশ্চিন্তায় একটুও শান্তি পাচ্ছে না। শুধু তাই না, শাওনের বাবার লোকজন তাদেরকে চলে যেতে দেখেছে, আগে হোক পরে হোক তাদের পিছুপিছু ছুটে আসবে। যখন ধরে ফেলবে তখন কী হবে? রাজু জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল। যা হবার হবে–সে যেটা করেছে সেটা যদি না করত তা হলেও শাওনের সর্বনাশ হয়ে যেত। জেনেশুনে সে শাওনকে তো মারা যেতে দিতে পারে না– কিছুতেই না।
রাজু ঘণ্টাখানেক একটানা মোটর-সাইকেল চালিয়ে রাস্তার পাশে মোটর সাইকেলটা থামাল। গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে, একটু হাত-পা ছড়িয়ে হেঁটে শরীরটাকে ঠিক করে নেওয়া দরকার। ব্যাপারটা অবিশ্যি খুব সহজ হল না, দেখতে দেখতে তাদেরকে ঘিরে ছোট বাচ্চাদের একটা ভিড় জমে উঠল। শুধু তাই না, যেসব গাড়িকে তারা পার হয়ে এসেছিল তাদেরকে থামতে দেখে এইসব গাড়িও থেমে গেল। গাড়ি থেকে লোকজন নেমে এল কথা বলার জন্যে। রাজু ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে আবার মোটরসাইকেলে চেপে বসে, তার পিছনে শাওন। লোকজন তাদেরকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, কিন্তু রাজু না শোনার ভান করে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। ব্যাপারটা ভালো হল না খারাপ হল সে জানে না, কিন্তু তাদের আর কিছু করার নেই।