“একটু একটু পারি।”
“তুমি সত্যি সত্যি পারবে?”
রাজু সত্যি সত্যি পারবে কি না জানে না, কিন্তু সে মুখ শক্ত করে বলল, “একশোবার পারব।”
শাওন একবার আগুনালির দিকে তাকাল, আগুনালি মাথা নেড়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস বুদ্ধি!”
সাগর হঠাৎ চোখ মুছে উজ্জ্বল চোখে বলল, “হ্যাঁ ভাইয়া, হ্যাঁ। মামার বন্দুকটা বের করব?”
রাজু চমকে উঠল, সাগর সত্যি কথাই বলেছে, মামার একটা বন্দুক রয়েছে। আলমারিতে তালা মারা, কিন্তু কাঁচ ভেঙে ভিতর থেকে বের করে নেওয়া যেতে পারে। রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আগুনালি, দেখো তো বন্দুকটা বের করতে পার কি না–পারলে নিয়ে আসো।” তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো শাওন আমার সাথে।”
মোটর-সাইকেলের চাবিটা বের করে সে শাওনের হাত ধরে তাকে নিয়ে ছুটে চলল।
যে-ঘরটাতে মোটরসাইকেলটা রাখা সেটা এক কোণায়। সামনের দরজাটা ছিটকিনি নিয়ে লাগানো ছিল, রাজু সাবধানে সেটা খুলে নিল। এখন মোটর সাইকেল নিয়ে ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিলেই সেটা ছিটকে খুলে যাবার কথা। রাজু মোটরসাইকেলে বসে চাবি ঢোকাল। শাওন আগে কখনও মোটর-সাইকেলে চড়েছে বলে মনে হল না, সেখানে কেমন করে বসতে হয় সেটা দেখিয়ে দিতে হল। রাজু গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখো।”
শাওন মাথা নেড়ে বলল, “রাখব।”
রাজু স্টার্টারে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আগুনালি বন্দুকটা বের করতে পেরেছে কি-না কে জানে, যদি না পারে তা হলে এমনিতেই যেতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে মোটরসাইকেলে বসে থেকে যখন প্রায় স্টার্ট দিয়ে দিচ্ছিল তখন সে হঠাৎ দেখতে পেল আগুনালি আর সাগর ছুটে আসছে, আগুনালির হাতে মামার বন্দুকটা। কাছে এসে বলল, “কী করব এটা?”
রাজু বলল, “আমাদের কাছে দাও। বন্দুক দেখে যদি ভয় পায়”
“কেমন করে নেবে?”
“শাওনের পিঠে ঝুলিয়ে দাও।”
আগুনালি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সেটা শাওনের পিঠে ঝুলিয়ে দিল। রাজু গলা নামিয়ে বলল, “আমরা যখন বের হব তখন সবাই আমাদের পিছুপিছু ছুটবে। সেই ফাঁকে তুমি সাগরকে নিয়ে বের হয়ে যেয়ো। বাসায় ভিতরে থেকো না, টিলার দিকে চলে যেয়ো।”
“যাব।”
“আর আমি চেষ্টা করব ঢাকার দিকে যেতে। রাস্তাটা কোনদিকে তুমি জান?”
“জানি। খুব সোজা রাস্তা। এই বাসার রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার গেলে বাজার। তখন ডান দিকের বড় রাস্তায় উঠে যাবে। সেটা ধরে সোজা পশ্চিম দিকে।”
“পশ্চিম কোনদিকে? আমি পূর্ব-পশ্চিম চিনি না।”
“ডানদিকে। সোজা ডানদিকে।”
“ঠিক আছে। আমরা তা হলে গেলাম।” রাজু আগুনালির চোখের দিকে। তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, “দোয়া কোরো।”
“করব।”
রাজু এবারে সাগরের দিকে তাকাল, তার দিকে চোখ মটকে বলল, “সাবধানে থাকিস।”
সাগর খুব সাবধানে চোখ মুছে মাথা নাড়ল। সে সত্যিই সাবধানে থাকবে।
রাজু তার স্টার্টারে লাথি দিতেই মোটর-সাইকেলটা গর্জন করে উঠল, সাথে সাথে সে অনুভব করল শাওন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, ঘাড়ের কাছে তার মুখটা রেখেছে, প্রায় তার গাল স্পর্শ করে আছে তার মুখ, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেবে আসছে, সব মানুষের শরীরে বুঝি একধরনের গন্ধ থাকে।
রাজু বাম হাতে ক্লাচটা শক্ত করে ধরে এক্সেলেটর ঘোরাল, মোটর সাইকেলটা হঠাৎ হিংস্র একটা জানোয়ারের মতো দাপিয়ে ওঠে, সে ক্লাচ ছেড়ে দিতেই সেটা প্রায় লাফিয়ে উঠে একটা ঝটকা দিয়ে সামনে ছুটে গেল, প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল দরজাকে। বিকট শব্দে দরজার পাল্লাগুলি ছিটকে খুলে যায় আর তার মাঝে দিয়ে রাজু গুলির মতো বের হয়ে আসে।
বাসার সামনে খানিকটা জায়গা অসমতল, সেখানের মোটর-সাইলেকটা একবার লাফিয়ে উঠে প্রায় কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পা দিয়ে সে কোনোমতে সামলে নিল। ঠিক তার সামনে দুইজন মানুষ কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল, তাদের মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন। রাজু মোটর-সাইকেলটা সোজা তাদের দিকে ছুটিয়ে নেয়, মানুষগুলি লাফিয়ে দুই পাশে সরে গেল। রাজু এক্সেলেটর ঘোরাতেই মোটর সাইকেলটা আবার গর্জন করে উঠে প্রায় লাফিয়ে উঠল এবং সবার চোখের সামনে দিয়ে সেটা তীব্র গতিতে বের হয়ে গেল।
শাওন মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল, ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। কিছু মানুষ ছোটাছুটি করছে, কিন্তু তাদেরকে আর ধরতে পারবে না। রাজু পা দিয়ে গিয়ার পালটে নেয় দ্রুত, দেখতে দেখতে মোটরসাইকেলের বেগ আরও বেড়ে যায়। খোয়া-ছড়ানো রাস্তায় সেটা ধুলো উড়িয়ে যেতে থাকে। রাজুকে শক্ত করে ধরে রেখে শাওন আবার পিছন দিকে তাকাল, দূরে আজগর মামার বাসাবাসার সামনে মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে। বাসাটাকে ঘিরে কিছু মানুষজন, কিন্তু তারা বাসটাতে উঠছে না, ছোটাছুটি করছে। কেন মানুষগুলি মাইক্রোবাসে উঠছে না বোঝা গেল হঠাৎ, বিশাল একটা আগুনের হলকা ভিতর থেকে বের হয়ে এল। আগুনালি নিশ্চয়ই তার তৈরি একটা বোমা ভিতরে ছুঁড়ে দিয়েছে।
রাজু রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই কিলোমিটার সামনে একটা বাজার, বাজারে গিয়ে ডানদিকে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে হবে। শাওন রাজুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “আগুনালি মাইক্রোবাসে বোমা মেরেছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, আগুন জ্বলছে বাসে।”
“তাকে ধরতে পারেনি তো?”