শাওনকে যখন ছেলে সাজানো গেল না তখন তাকে বড় একজন মহিলা সাজানো যায় কি না সবাই সে-চিন্তা করতে লাগল। শাড়ি পরিয়ে যদি লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে দেওয়া যায় তা হলে কেউ তার চেহারা দেখতে পারবে না। বুদ্ধিটা খুব খারাপ না, কিন্তু একটা সমস্যা, আজগর মামার বাসায় কোনো শাড়ি নেই। মামি মারা গেছেন বহু আগে, বসার ঘরে মামির একটা ছবি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাসায় কোথাও মামির কোনো একটা শাড়ি রয়ে যাবে তার কোনো আশা নেই জেনেও তার একটু খোঁজাখুঁজি করে দেখল। যখন কিছুই খুঁজে পেল তখন আগুনালি বলল, “একটা শাড়ি কিনে আনলে কেমন হয়?”
“শাড়ি? কিনে আনলে?”
“হ্যাঁ। বাজারে কাপড়ের দোকানে কত শাড়ি! সস্তা একটা কিনে আনলেই হয়।”
“সস্তা?” সাগর চিৎকার করে বলল, “সস্তা কেন?”
আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “ঠিক আছে, দামিই নাহয় কিনে আনলাম।”
শাওন মাথা নাড়ল, বলল, “না না, শুধু শুধু একটা দামি শাড়ি কেন কিনে আনবে? আমি শাড়ি ভালো করে পরতেও পারি না। সস্তা কিনে আনলেই হবে।”
“কী রঙের শাড়ি কিনব?” সাগর গলা উঁচিয়ে বলল, “লাল–লাল।”
রাজু মাথা নাড়ল, “না, লাল না। লাল শাড়ি সবার চোখে পড়বে। ম্যাটম্যাটে রঙের শাড়ি কিনতে হবে। নীল না হলে সবুজ। রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পারবে একটা শাড়ি কিনে আনতে?”
“না পারার কী আছে!”
দুপুরের ট্রেনটা ধরতে হলে এখনই একটা শাড়ি কিনে আনতে হবে, আগুনালি তাই তখন-তখনই রওনা দিল। বাজার থেকে শাড়ি কিনে রেস্টুরেন্টের ছেলেটাকে বলবে একটু বেশি করে খাবার পাঠাতে।
আগুনালি বের হবার পর রাজু আর সাগর তাদের ব্যাগ বের করে মাত্র সেখানে কাপড়-জামা রাখতে শুরু করেছে হঠাৎ দেখতে পেল কে যেন ছুটে ছুটে তাদের বাসার দিকে আসছে। রাজু আর সাগর অবাক হয়ে বাইরে গিয়ে দেখল আগুনালিই ছুটতে ছুটেতে ফিরে আসছে। বারান্দায় উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে!”
রাজুর হঠাৎ ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। ঢোক দিলে বলল, “কী সর্বনাশ?”
“একটা মাইক্রোবাস থেমেছে। বাসভরতি অনেকগুলি মানুষ–”
মুহূর্তে শাওনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আগুনালি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “মানুষগুলির হতে বন্দুক।”
“বন্দুক?”
“হ্যাঁ। মানুষগুলি নেমে বাসাটাকে ঘিরে ফেলছে।”
“ঘিরে ফেলছে?”
“হ্যাঁ, তাকালে মনে হয় দেখতে পারবে। আগুনালি ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে তাকাল এবং হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “ঐ দেখো!”
রাজু শুকনো গলায় বলল, “সবাই ভিতরে চলোতাড়াতাড়ি।”
সবাই ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। সাগর হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়, খানিকক্ষণ কান্না আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে হঠাৎ কেঁদে উঠে বলল, “এখন কী হবে?”
শাওন এতক্ষণ ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়েছিল, এবারে খুব ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসে নিজের হাঁটুর উপর হাত রেখে শূন্যদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাল। তারপর প্রায় শোনা যায় না সেরকম গলায় বলল, “একটা ব্লেড আছে?”
রাজু চমকে উঠে শাওনের দিকে তাকাল। শাওন চোখ সরিয়ে নিয়ে খুব নরম গলায় বলল, “আমার বাবা খুব ভয়ংকর মানুষ। তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। কত ভয়ংকর।”
কেউ কোনো কথা বলল না। শাওন চোখ তুলে বলল, “আমরা ধরা পড়ে গেছি। এখন আর কিছু করার নেই। আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে। আমাকে পেলে তোমাদের হয়তো কিছু বলবে না।”
তখনও কেউ কোনো কথা বলল না। শাওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা খুঁজে আমাকে একটা ব্লেড এনে দাও। প্লিজ দেরি কোরো না।”
রাজু আগুনালির দিকে তাকাকেই সে মাথা নিচু করে ফেলল। সাগর এতক্ষণ নিজের কান্না আটকে রেখেছিল, এবারে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রাজু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, যে-মানুষগুলি আস্তে আস্তে বাসাটাকে ঘিরে ফেলছে তারা আরও এগিয়ে এসেছে, তাদের চেহারা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মানুষগুলির চেহারা কী ভয়ংকর মুখে কোনোরকম অনুভূতির চিহ্ন নেই! হাতে নিশ্চয়ই কোনোরকম অস্ত্র ধরে রেখেছে, কিন্তু চাঁদরে শরীর ঢাকা, তাই অস্ত্রটা দেখা যাচ্ছে না। রাজু মানুষগুলিকে দেখে একবার শিউরে উঠল, কী ভয়ংকর ভাবলেশহীন চেহারা!
শাওন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেরি করে লাভ নেই রাজু। তোমার মামার শেভ করার ব্লেড নিশ্চয়ই আছে, খুঁজে দেখো। আমি লুকিয়ে রাখব নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
রাজু শেষবারের মতো ব্যাপারটা চিন্তা করার চেষ্টা করে। সত্যিই কি তাদের কিছু করার নেই? কোনোভাবেই কি আর শাওনকে বাঁচাতে পারবে না? হঠাৎ করে তার মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে ওঠে। এতদূর আসার পর তাদের হেরে যেতে হবে? একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে না?
রাজু হঠাৎ শাওনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাওন”
শাওন রাজুর গলার স্বর শুনে চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে রাজু?”
“তুমি বলছ তুমি তো মরেই যাবে।”
“হ্যাঁ।”
“যে মরে যাবে তার তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই? তুমি কি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাও?”
শাওন অবাক হয়ে বলল, “কী চেষ্টা?”
“আমার মামার একটা মোটর-সাইকেল আছে। তুমি মোটর-সাইকেলে আমার পিছনে বসবে। লোকগুলি যখন খুব কাছে আসবে হঠাৎ দরজা খুলে মোটর-সাইকেলে করে আমরা বের হয়ে যাব।”
শাওন এমনভাবে রাজুর দিকে তাকাল যন সে ঠিক বুঝতে পারছে না রাজু কী বলছে। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি মোটর সাইকেল চালাতে পার?”