“কী খেলা?”
“সারা শরীরে আগুন লাগিয়ে পানির মাঝে ঝাঁপ দেওয়া।”
শাওন ভয়ে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে বলল, “তুমি শরীরে আগুন লাগিয়ে পানিতে ঝাঁপ দাও?”
“এখনও পুরো শরীরে লাগাই নাই। দুই হাতে লাগিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। পেট্রোল দিয়ে আগুন দিতে হয়। পেট্রোল পুড়ে গেলে আগুন নিজ থেকে নিভে যায়, দেখে ভয় লাগে, আসলে ভয়ের কিছু নাই। তুমি দেখ নাই সার্কাসে দেখায়?”
শাওন মাথা নাড়ল, সে দেখেনি।
আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেইজন্যে এত ভয় পেয়েছ। ভয়ের কিছু নাই। আগুনকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তোমরা যদি আগুন নিয়ে খেল
অনেক বিপদ হতে পারে, আমি যদি খেলি কোনো বিপদ নাই।”
শাওন থমথমে মুখে বলল, “তোমার যা ইচ্ছা তুমি বলতে পার, কিন্তু এখন আমাকে ছুঁয়ে তোমার একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।”
আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “কী প্রতিজ্ঞা?”
“আগে আমাকে ছোঁও।” সাগর জিজ্ঞেস করল, “ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলে কী হয়?”
শাওন সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেল তা হলে যাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে সে মরে যায়। শাওন আবার আগুনালির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “ছোঁও। ছুঁয়ে আমার সাথে সাথে বলো–”
“কী বলব?”
“বলো, আমি জীবনে শরীরের কোনো জায়গায় আগুন লাগাব না–”
“কিন্তু–কিন্তু—”
“না। আমি কোন কথা শুনব না। আমাকে ছুঁয়ে তোমার বলতে হবে। আমি কোনো কথা শুনব না। বলো–”
আগুনালি আরও কয়েকবার চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে শাওনকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল যে সে জীবনে কখনও নিজের, শরীরে আগুন লাগাবে না। রাজুর ধারণা ছিল প্রতিজ্ঞাটা করার পর আগুনালির নিশ্চয়ই একটু মন খারাপ হবে, কিন্তু দেখা গেল তার ঠিক মন-খারাপ হল না। একজন মানুষের তার জন্যে এত মমতা থাকতে পারে–ব্যাপারটা অনুভব করে হঠাৎ তার নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে লাগল।
আগুনালির খেলা শেষ হবার পর তারা কীভাবে ঢাকা ফিরে যাবে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকে। আগুনালি বলল যে খুব ভোরে একটা ট্রেন ছিল, সেটা চলে গেছে। পরের ট্রেনটা দুপুরে। রাজু বলল, “আমাদের সেটাই ধরতে হবে।”
সাগর বলল, “যদি শাওন আপুকে চিনে ফেলে?”
“কে চিনে ফেলে?”
“শাওন আপুর আব্বা?”
হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। গত রাতে শাওনকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর কী হয়েছে কেউ জানে না। তারা চলে আসার পর দরজাটা ভেঙে নিশ্চয়ই সবাই ভিতরে ঢুকেছে। যখন দেখেছে ভিতরে শাওন নেই তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে গেছে। তখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। দারোয়ানটা আগুনালিকে খুব ভালো করে দেখেছে, সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আগুনালি বারবার নাহার মঞ্জিলে গিয়ে সে তার গোরু খোঁজাখুঁজি করেছে তার পিছনে আসলে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। আগুনালিকে একবার দারোয়ানটা রাজু আর সাগরের সাথেও দেখেছিল। তখন সেটা দেখে হয়তো কিছু মনে করেনি, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। তারা একসাথে ঘোরাঘুরি করেছ, দুই মাথাওয়ালা গোরু দেখতে গিয়েছে, বাজারে রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়েছে–তখন আবার আগুনালি সবাইকে বলে বেড়িয়েছে রাজু আর সাগর মাস্টার সাহবের ভাগনে। কাজেই কেউ যদি ভালোভাবে খোঁজাখুঁজি করে করে তাদেরকে খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই জানতে পারবে না, এক-দুইদিন লেগে যাবার কথা। কিন্তু আর দেরি করে লাভ নেই–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা চলে যেতে হবে।
সাগর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “যদি শাওন আপুর আব্বা দেখে ফেলে তখন কী হবে?”
রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তখন অনেক বড় বিপদ হবে।”
“শাওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, অনেক বড় বিপদ।”
“কাজেই এখন আমাদের কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না কিছুতেই না।”
“যদি কেউ আমাদের ধরতে চায় তা হলে সে রেলস্টেশনে আর বাসস্টেশনে অপেক্ষা করবে।”
“কেন?”
“কারণ তারা নিশ্চয়ই জানে আমরা ঢাকা যাব। আর ঢাকা যাবার উপায় কী, ট্রেন নাহয় বাস।”
“তা হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে!”
রাজু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ মুশকিল হয়ে যাবে। আমাদেরকে দেখলে হয়তো চিনবে না, কিন্তু শাওনকে তো চিনে ফেলবে।”
সবাই শাওনের দিকে তাকাল, সাগর মুখ ছুঁচালো করে বলল, “শাওন আপুর চেহারা এত সুন্দর, কেউ একবার দেখলেই ট্যারা হয়ে যাবে।”
রাজু চোখ পাকিয়ে সাগরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। সাগর আবার বলল, “শাওন আপুকে ছদ্মবেশ করিয়ে নিলে কেমন হয়?”
“কী ছদ্মবেশ?”
“জুতা পালিশওয়ালা, না হলে কুলি, না হলে বাদামওয়ালা।”
সবাই আবার শাওনের দিকে তাকাল, সে জুতাপালিশ করছে কিংবা মাথায় করে সুটকেস টেনে নিচ্ছে কিংবা বাদাম বিক্রি করছে–ব্যাপারটা কেউ চিন্তাও করতে পারল না। রাজু আবার সাগরকে একটা ধমক দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আগুনালি বলল, “সাগর বুদ্ধিটা খারাপ দেয় নাই, যদি শাওন রাজুর শার্ট প্যান্ট পরে চুলগুলি কেটে নেয়—”
সাগর মাথা নাড়ল, “নাহ্! তবু শাওন আপাকে ছেলের মত লাগবে না। কলম দিয়ে যদি মোচ এঁকে দেওয়া যায়—”
“ধুর গাধা! রাজু এবারে একটা ধমক লাগাল। আজকাল তো অনেক ছেলে মাথায় বেসবলের টুপি পরে। সেরকম একটা টুপি পরে নিলেই হয়।”
ছেলের ছদ্মবেশ পরার পর তাকে দেখতে কেমন লাগবে সেটা পরীক্ষা করে দেখা হল, কিন্তু শাওনের চেহারার মাঝে মেয়ের ভাবটা এত বেশি যে, যতই চেষ্টা করা যাক কিছুতেই তাকে ছেলের মতো দেখানো গেল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সবাই হাল ছেড়ে দিল।