রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে আব্বা খেতে এলেন না, সাগর কয়েকবার তার হাত ধরে টানাটানি করে বলল, “খেতে আসো আব্বু, খেতে আসো!”
আব্বা নরম গলায় বললেন, “তোরা খা, আমার খিদে নেই।”
“রাত্রিবেলা খেতে হয়। মনে নেই তুমি বলেছিলে না খেলে চড়ুই পাখির সমান রক্ত কমে যায়?”
আব্বা হেসে বললেন, “আমার গায়ে অনেক রক্ত, দুই-চারটা চড়ুই পাখির রক্ত কমে গেলে কিছু হবে না। তোরা খা।”
রাজু বুঝতে পারল আসলে আব্বা আর আম্মার ঝগড়া এখনও মেটেনি, দুজনে তাই একসাথে বসতে চাইছেন না। সাগর অবিশ্যি বেশি বোঝাবুঝির মাঝে গেল না, খাবার টেবিলে বসে আম্মার সাথে তর্ক করতে লাগল, “আম্মা, আব্বু ভাত খাবে না কেন?”
“খিদে নেই মনে হয়।”
“আমার যখন খিদে থাকে না তখনও তো তুমি আমাকে জোর করে খাওয়াও। খাওয়াও না?”
আম্মা উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্কর মতো বললেন, “ও!”
“কথা বল না কেন আম্মা?”
আম্মা সাগরের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, “এই তো কথা। বলছি!”
‘আব্বাকে ডাকো খাওয়ার জন্যে।”
“খেতে না চাইলে কি জোর করে খাওয়ানো যায়?”
“আমাকে তো জোর করে খাওয়াও। মনে নেই সেদিন ছোট মাছে কত কাঁটা ছিল, আমার খাওয়ার ইচ্ছা করেনি তবু তুমি বললে খেতে হবে?”
আম্মা সাগরের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে বাবা, আর বলব না।”
সত্যি সত্যি খাবার টেবিলে আম্মা কিছু বললেন না। রাজু ইচ্ছে করে যখন বাঁধাকপির ভাজাটা নিল না আম্মা সবজির উপকারিতা নিয়ে কোনো বক্তৃতা দিলেন না। ছোট মাছটা একটু খেয়ে ফেলে দেবার পরেও খাবারের অপচয় যে কত খারাপ এবং পৃথিবীতে তার বয়সী কত শিশু যে না খেয়ে আছে সেই কথাগুলি মনে করিয়ে দিলেন না। মজার ব্যাপার হল, রাজুর মনে হতে লাগল সবজির উপকারিতা কিংবা খাবারের অপচয়ের ওপরে আম্মার উঁচু গলার বক্তৃতাটাই আসলে চমৎকার ব্যাপার। আম্মার বকুনি না খেয়ে এই প্রথমবার রাজুর মন খারাপ হয়ে গেল।
রাজু আর সাগরের পরীক্ষা শেষ, পড়াশোনার ঝামেলা নেই। পরীক্ষা চলার সময় মনে হয় পরীক্ষা শেষ হলে কত কী করবে, কিন্তু সত্যি যখন পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে দেখা যায় কিছুই করার নেই। বিশেষ করে আজকের দিনটা বাড়াবাড়ি খারাপ, রাজু বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা গল্পবই পড়বে নাকি টেলিভিশন খুলে কী হচ্ছে দেখবে ঠিক করতে পারছিল না, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল–কেউ একজন এসেছে। রাজু দরজা খুলেই দেখে বাইরে আজগর মামা দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে রাজুর মনে হল নিশ্চয়ই খোদা বলে কেউ আছেন, শুধু তাই না, সেই খোদা নিশ্চয়ই ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পছন্দ করেন, যখন দেখেন তারা খুব কষ্ট পাচ্ছে তখন একজন-দুইজন ফেরেশতাকে মানুষের মতো রূপ দিয়ে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তা না হলে আজকের দিনে এই সময়ে আজগর মামা কেমন করে এলেন! সারা পৃথিবীতে একটিমাত্র মানুষই আছে যে অসম্ভব খারাপ, দুঃখের, কষ্টের, যন্ত্রণার একটা সময়কে পুরোপুরি পালটে দিয়ে সেটাকে আনন্দের, মজার, হাসি-তামাশা, ফূর্তির একটা সময় তৈরি করে ফেলতে পারেন, আর সেই মানুষটি হচ্ছেন আজগর মামা। কী আশ্চর্য–সেই আজগর মামা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন!
আজগর মামা নিচু গলায় বলতে পারেন না–তাই দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হাঁক দিলেন, “কী হল, ভিতরে ঢুকতে দিবি, নাকি দাঁড়িয়ে থাকবি?”
রাজু উত্তর না দিয়ে চিৎকার করে এক লাফে আজগর মামার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তেরো বছরের একজন সাধারণত কারও উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না, আজগর মামা সতর্ক ছিলেন বলে কোনোমতে সামলে নিয়ে আরেকটা হাঁক দিলেন, “আরে ছাগল, ঘাড়ে উঠে পড়বি নাকি? ছাড় বলছি–ছাড়!”
রাজু আজগর মামাকে ছাড়ল না। এবং রাজুর চিৎকার শুনে সাগর ছুটে এসে সেও লাফিয়ে আজগর মামার ঘাড়ে ঝুলে পড়ল। আজগর মামা সেই অবস্থাতে দুজনকে ঝুলিয়ে নিয়ে কোনোমতে ঘরে ঢুকে দুই পাক খেয়ে তাদের সোফায় ছুঁড়ে দিলেন। সাগর চিৎকার করে ঘরে দৌড়াতে লাগল, ‘আজগর মামা এসেছে, আজগর মামা অজগর মামা
আজগর মামা ঘরের বাইরে থেকে তার জিনিসপত্র আনতে যাচ্ছিলেন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার দিলেন, “অজগর বলবি তো মাথা ভেঙে ফেলব পাজি ছেলে-”
ধমক খেয়ে সাগরের আরও আনন্দ হল, সে দুই হাত দুইদিকে প্লেনের মতো ছড়িয়ে দিয়ে”অজগর অজগর” করে চিৎকার করে ঘরে দৌড়াতে লাগল।
চিৎকার হৈচৈ শুনে আব্বা-আম্মা বের হয়ে এলেন এবং প্রথমবার তাঁদের দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, শুধু তা-ই না, তারা দুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। সারাদিন যে ঝগড়া করে মুখ গোমড়া করে বসে ছিলেন সেটা হঠাৎ করে তাঁরা কেমন করে যেন ভুলে গেলেন।
আব্বা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আরে আজগর ভাই! আপনি কোথা থেকে?” আম্মা বললেন, “দাদা, তুমি হঠাৎ করে?”
আজগর মামা তাঁর ঝোলাঝুলি নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “হঠাৎ করেই তো আসতে হয়। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আসব নাকি?”
মামার হাতে একটা পাখির খাঁচা-সেখানে অনেকগুলি পাখি, হঠাৎ ঘরে আলোর মাঝে এসে কিচিরমিচির করতে শুরু করল। রাজু অবাক হয়ে বলল, “মামা, পাখি এনেছ? পাখি?”
“হ্যাঁ, স্টেশনে দেখলাম বিক্রি করছে, কিনে আনলাম।”
আব্বা ভালো করে দেখে বললেন, “এ তো চড়ুই পাখি!”