“হ্যাঁ, তুমি কখন উঠেছ?”
“অনেক ভোরে।”
“মশার কামড়ে খেয়ে?”
“না, মশা কামড়ায়নি। এমনিতেই ঘুম ভেঙে গেল।” ঘুম হয়েছে তোমার?”
শাওন আবার একটু হাসল, “হয়েছে, মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙেছে, তখন হঠাৎ করে মনে পড়েছে আমি পালিয়ে চলে এসেছি–তখন যে কী মজা লেগেছে!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, ইচ্ছে হয়েছে উঠে ডিগবাজি দিই।”
একটা ফুটফুটে মেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ডিগবাজি দিচ্ছে–দৃশ্যটা চিন্তা করে রাজু খিকখিক করে হেসে ফেলল।
শাওন আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “জায়গাটা কী সুন্দর!”
রাজু এগিয়ে গিয়ে শাওনের পাশে দাঁড়াল। দূরে ছোট ছোট টিলা, টিলার কাছে গাছের সারি, পুরো এলাকাটা একধরনের নরম কুয়াশার ঢেকে আছে। এখনও সূর্য ওঠেনি, আকাশে একটা লালচে ভাব এসেছে। বাইরে পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে, কে জানে, তাদেরও মনে হচ্ছে খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেছে।
শাওন বাইরে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, যে–”
শাওন তার কথাটা শেষ করল না। রাজু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “যে?”
“যে আমাকে মরতে হবে না!”
কথাটা শুনে রাজুর এত মায়া লাগল যে বলার নয়। সে নরম গলায় বলল, “মরবে কেন, ছি!”
“আমি একেবারে রেডি হয়েছিলাম–”
”থাক। এগুলো মনে করে আর লাভ নেই।”
“মরে গেল আর এত সুন্দর জায়গাটা দেখতে পারতাম না।”
“এখন তো দেখছ। সবাই ঘুম থেকে ওঠার পর নাস্তা খেয়ে আমরা ট্রেন স্টেশনে যাব। সেখান থেকে ট্রেন করে ঢাকায় তোমার আম্মার কাছে। চিন্তা করো তোমার আম্মা কী খুশি হবেন!”
শাওন সাবধানে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, “হ্যাঁ, বেচারি আম্মা! কী কষ্টটাই-না পাচ্ছে!”
“থাক, এখন আর দুঃখকষ্টের কথা ভেবে লাভ নেই। সকালে কী নাস্তা করবে বলো!”
“নাস্তা তৈরি করবে কে?”
“এই আমরা নিজেরাই তৈরি করব।”
“কী কী আছে তৈরি করার?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “বেশি কিছু নেই। মুড়ি আর বিচিকলা।”
শাওন হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। চোখ মুছে বলল, “মুড়ি আর বিচিকলা! তুমি যেভাবে জিজ্ঞেস করেছে মনে হল হাতি ঘোড়া কত কী খাবার আছে!”
রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আসলে চান মিয়া তো এখনও আসেনি, সেজন্যে এই অবস্থা! আগুনালি অবিশ্যিও চাও তৈরি করতে পারে, কিন্তু সে চাও খাওয়া যায় না।”
“কেন?”
“আলকাতরার মতো কুচকুচে কালো হয় আর খেতে একেবারে ইঁদুর মারার বিষের মতো।”
শাওন আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে আর তাকে হাসতে দেখে এবারে রাজুও প্রথমে একটু একটু তারপর বেশ জোরে জোরে হাসতে শুরু করল।
.
সবাই যখন ঘুম থেকে উঠল তখন বাসাটিতে একটা কর্মব্যস্ততার ভাব ফুটে উঠল। কয়দিনে বাসার নানা জায়গায় যেসব জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল শাওন সেগুলি গোছাতে শুরু করে এবং অন্য তিনজন অবাক হয়ে লক্ষ করল কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো বাসার চেহরাটা পালটে গেছে। আগুনালি নাস্তা তৈরি করার দায়িত্ব নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল, রাজু গেল তাকে সাহায্য করতে। সাগর শাওনের পিছুপিছু ঘুরঘুর করে তার কাজকর্মে পদেপদে ঝামেলা করতে লাগল। রাজু হলে এতক্ষণে সাগরকে তুলে একটা আছাড় দিয়ে বসত, কিন্তু শাওন একটুও রাগ করল না। মনে হয় খোদা যখন মেয়েদের তৈরি করেছেন তখন তাদের শরীরে ধৈর্য প্রায় দশ কে. জি. বেশি দিয়েছেন।
সকালের নাস্তা খাওয়ার অনুষ্ঠানটি হল খুব চমৎকার। রাজু কাছে কাছে ছিল বলে এবারে আগুনালি চা-টা বেশি কড়া করতে পারল না এবং সেটা বেশ খাওয়া গেল। মুড়ি শেষ হওয়ার পর বিচিকলা মুখে দিয়ে পুট করে তার বিচি কে কতদূরে ছুঁড়ে দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় আগুনালিকে কেউ হারাতে পারল না। দেখে বড় প্রতিযোগী মনে না হলেও শাওন হল রানার্স আপ। সাগর অনেক চেষ্টা করার পরও তার বিচিগুলি মুখ থেকে বের হয়ে থুতুনির মাঝে ঝুলে থাকতে লাগল। সেটা দেখে প্রথমে শাওন এবং শাওনকে দেখে অন্য সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। যদিও সাগরকে নিয়ে সবাই হাসছে, কিন্তু সাগর তবুও এতটুকু রেগে গেল না। বরং সবাইকে এত আনন্দ দিতে পারছে বলে সে নিজেও হাসতে লাগল। নাস্তা শেষ হবার পর আগুনালি তার আগুনের খেলা দেখাল। তার আগুনি পাখুনি নিয়ে সে বিশাল একটা আগুনের হলকা শাওনের একেবারে কানের কাছে দিয়ে পাঠিয়ে দিল। শাওন প্রস্তুত ছিল না বলে ভয়ে চিৎকার করে রাজুকে জড়িয়ে ধরল, আর তাই দেখে অন্য সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। শাওনকে অবাক করে দেবার জন্যে আগুনালি মুখে পেট্রোল নিয়ে আগুনের উপর দিয়ে ফুঁ দিয়ে বের করতেই মনে হল তার মুখ থেকে ড্রাগনের মতো আগুন বের হয়ে এল। সেটা দেখে শাওন এত ভয় পেল, যে চিৎকার দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল। আগুনালি আবার সেটা দেখানোর চেষ্টা করতেই শাওন ছুটে গিয়ে আগুনালির হাত ধরে ফেলে বলল, “না না, তুমি এটা করতে পারবে না।”
আগুনালি দাঁত বের করে বলল, “ভয় পাবার কিছু নাই, এর মাঝে কোনো বিপদ নাই। মুখে পেট্রোলের গন্ধ খারাপ লাগে, কিন্তু কোনো বিপদ নাই।”
শাওন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “একশো বার আছে।”
“এইটা দেখেই ভয় পাও, আমার অন্য খেলা দেখলে তুমি কী করবে?”