রাজু শাওনের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “যখন দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যাবে তখন আমরা এখান থেকে বের হয়ে দৌড় দেব।”
“দেখে ফেলবে না?”
“দেখলে দেখবে, কিছু করার নেই।”
রাজু আর শাওন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থেকে শুনতে পায় শাওনের বাবা আর দারোয়ান দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকবার দরজার লাথি দিতেই তাদের বুক কেঁপে উঠছিল। দরজাটা নিশ্চয়ই শক্ত, কারণ অনেক চেষ্টা করেও সেটা ভাঙতে পারল না। দারোয়ানটা বলল, “দরজা খুব শক্ত স্যার। গর্জন কাঠ দিয়ে বানিয়েছে, দুই পাল্লা দিয়েছে–একটা খন্তা হলে সুবিধে হত।”
“কথা না বলে একটা খন্তা নিয়ে আয়-না কেন?”
“এই বাসায় তো নাই হুজুর।”
“নাই? অন্যকিছু নাই?”
“জি না।”
“ড্রাইভারকে গিয়ে বল একটা খন্তা আনতে।”
“জি হজুর।” দারোয়ান চলে যেতে যেতে ফিরে এসে বলল, “জানালা দিয়ে একবার দেখলে হয় না স্যার?”
“জানালা দিয়ে?”
“জি।”
“কেমন করে দেখবি?”
“এই পাশের ঘর থেকে কার্নিস ধরে যদি যাই।”
“যেতে পারবি?” দারোয়ানটা বলল, পারব হুজুর।”
“যা তা হলে।”
দারোয়ানটা নিশ্চয়ই কার্নিসের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। কলার ছিলকেগুলি আছে, সত্যি কি কাজে লাগবে এখন? রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে এবং হঠাৎ একটা বিকট আর্তনাদ, তারপর ধপাস করে কোনো মানুষের পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। রাজু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড!”
শাওনের বাবা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
বাইরে নিচে থেকে দারোয়ানটির কাতর গলায় স্বর শোনা গেল, কিছু একটা বলছে, এখান থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না। শাওনের বাবা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “আহাম্মক কোথাকার! এখন মাজা ভেঙে আমাকে ঝামেলায় ফেলবি?”
রাজু আর শাওন কান পেতে থাকে, শাওনের বাবা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই পিছনে গিয়ে দারোয়ানটাকে দেখতে তার কী অবস্থা। ড্রাইভারও নিশ্চয়ই যাবে–এই সুযোগ!”
রাজু শাওনকে বলল, “চলো যাই।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, যদি দেখে ফেলে ভয় পেয়ো না–চোখ বন্ধ করে দৌড়াবে। জঙ্গলে আমার জন্যে আগুনালি অপেক্ষা করছে–দরকার হলে ফাঁইট দেবে।”
শাওন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে অপেক্ষা করছে?”
“আমার বন্ধু আগুনালি। একটু পরেই দেখবে। চলো যাই।”
“চলো।”
কয়েক মুহূর্ত পরে দেখা গেল রাজু আর শাওন দরজা খুলে ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
শাওনের নিশ্চয়ই দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, জঙ্গলের আড়ারে গিয়ে সে রাজুকে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “ওফ, মারা যাচ্ছি একেবারে!”
রাজু খুশিতে হেসে ফেলে বলল, “না শাওন, তুমি আর মারা যাবে না। তোমাকে আমরা উদ্ধার করে এনেছি।”
রাজুর কথা শেষ না হতেই হঠাৎ করে আগুনালি আর সাগর হাজির হল। শাওন ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কে? কে তোমরা?”
রাজু বলল, “ভয় নেই শাওন। এই হচ্ছে আগুনালি আর এই ছোটজন সাগর, আমার ভাই।”
সাগর বলল, “ভাইয়া বলেছে তুমি নাকি দেখতে খুব সুন্দর। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।”
রাজু লজ্জা পেয়ে বলল, “চুপ কর গাধা!”
সাগর বলল, “তুমি বলনি? একশোবার বলেছ–”
আগুনালি রাজুকে উদ্ধার করল। বলল, “এখানে দেরি করে লাভ নেই, তাড়াতাড়ি চললা বাসাই যাই। যদি দেখে ফেলে বিপদ হবে।”
“হ্যাঁ, চলো যাই। রাজু মাথা নাড়ল, “চলো। যেতে যেতে তোমাদের বলি কী হয়েছে?”
আগুনালি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ও! যা ভয় পেয়েছিলাম সে আর বলার মতো না! কাল সকালেই একটা মুরগি ছদকা দিতে হবে।”
সাগর জিজ্ঞেস করল, “মুরগি ছদকা দিলে কী হয়?”
“বিপদ কেটে যায়।”
১৬৯
“বিপদ তো এখন কেটে গেছে, এখন তা হলে কেন দেবে?”
রাজু বলল, “চুপ কর তো সাগর, খালি ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না।”
অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সাগর সত্যি চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল দুটি কিশোর আর একটি শিশু অপূর্ব সুন্দরী একটা কিশোরীকে নিয়ে চাঁদের আলোতে হেঁটে যাচ্ছে। যেতে যেতে নিচু গলায় কথা বলছে রাজু। হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছে সে বুঝি আর ছোট নেই, সে বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছে। বুকের ভিতরে হঠাৎ সে আশ্চর্য একধরনের অনুভূতি অনুভব করতে থাকে, যার সাথে তার আগে কখনও পরিচয় হয়নি। চাঁদের আলোয় সে একটু পরেপরে শাওনের মুখের দিকে তাকায় আর সাথে সাথে আবার তার বুকের ভিতরে কেমন যেন করতে থাকে।
একটি মানুষ দেখতে এত সুন্দর কেমন করে হতে পারে।
৬. ষষ্ঠ দিন
রাত্রে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে, কিন্তু রাজুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। বিছানায় তার পাশে সাগর মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। পাশের বিছানায় ঘুমাচ্ছে আগুনালি। সে যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ হম্বিতম্বি করতে থাকে, কিন্ত ঘুমাচ্ছে গুটিসুটি মেরে একেবারে একটা বলের মতো হয়ে। শাওন পাশের ঘরে সোফার উপরে শুয়ে ঘুমিয়েছে। মশারি খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু কয়েকটা মশার কয়েল পাওয়া গিয়েছিল। কে জানে ঠিক করে ঘুমাতে পেরেছিল কি না!
রাজু বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে উঁকি দিল। শাওন সোফায় নেই, প্রথমে বুকটা ধক করে ওঠে, কিন্তু পরের মুহূর্ত সে শান্ত হয়ে আসে। শাওন জানালার কাছে দুই গালে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজু একটু শব্দ করে ঘরে ঢুকতে শাওন ঘুরে তাকাল। রাজুকে দেখে হেসে বলল, “তুমিও উঠে গেছ?”