শাওন গলা নামিয়ে বলল, “তোমার কী মনে হয়? আমরা বের হতে পারব?”
রাজুর বুক ভয়ে ধুকধুক করছে কিন্তু সে সেটা বুঝতে দিল না গলায় জোর এনে বলল, ‘একশো বার।”
“যদি না পারি?”
“না পারার কী আছে! সবচেয়ে কঠিন কাজটাই তো হয়ে গেছে!”
“কোনটা?”
“তোমার ঘরের তালা খুলে বের করে আনা।”
“তা ঠিক।”
রাজু অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কলার কাঁদিটা বের করে একটা কলা ছিলে খেতে খেতে বলল, “তুমি খাবে একটা?”
“না। আমি কলা দুচোখে দেখতে পারি না।”
“তা হলে বিস্কুট খাও।”
“না, আমার খিদে নেই।”
রাজু অন্ধকার বসে বসে বিস্কুট আর কলা খেতে থাকে তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে এরকম অবস্থায় বসে বসে খাচ্ছে! মানুষ ভয় পেলে মনে হয় খিদে পায় বেশি।
কয়েকটা কলা খেয়ে হঠাৎ রাজু উঠে দাঁড়াল। শাওন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাও?”
“এই কলার ছিলকেগুলি ফেলে আসি।”
“কোথায় ফেলবে?”
“তোমার জানালার নিচে কার্নিস। তোমার তালা খুলতে না পেরে দারোয়ান নিশ্চয়ই দেখার জন্যে কার্নিস ধরে জানালার দিকে যাবে। যখন জানালার কাছে যাবে তখন ধুড়ম করে আছাড় খেয়ে পড়বে।”
“সর্বনাশ! উপর থেকে পড়ে যদি মরে যায়?”
“মরবে না, বেশি উঁচু তো নয়। ব্যথা পাবে। পাওয়া দরকার।”
রাজু পা টিপে টিপে শাওনের ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে কার্নিসে কলার ছিলকেগুলি ছুঁড়ে ফেলল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলো এস পড়ল, আলোটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্যে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই হঠাৎ করে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। সর্বনাশ! নিশ্চয়ই শাওনের বাবা এসেছে।
রাজু প্রায় ছুটে শাওনের কাছে ফিরে এল, শাওন উঁকি দিকে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। রাজুকে দেখে গলা নামিয়ে বলল, “আমার বাবা এসেছে। এখন কী হবে?”
রাজু নিজের ভয় লুকিয়ে রেখে বলল, “কী হবে, কিছু হবে না।”
দুজনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাইক্রোবাসটা বাসার সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। গাড়ির ভিতর থেকে শাওনের বাবা বের হয়ে এল। বাইরে সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির শব্দ শুনে দারোয়ানটাও বের হয়ে এল, মাথা নিচু করে লম্বা সালাম দিল, দু-একটা ছোট কথাবার্তাও বলল, কিন্তু ওপর থেকে ঠিক বোঝা গেল না, শুধুমাত্র ফারজানা নামটা কয়েকবার শোনা গেল। রাজুর হঠাৎ মনে পড়ল শাওনের বাবা তাকে ফারজানা বলে ডাকে।
শাওনের বাবা ড্রাইভারকে দু-একটা কথা বলে ভিতরে ঢোকে এবং প্রায় সাথে সাথেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই শাওনের ঘরের সামনে এসে হাজির হবে–তারপর কী হবে? রাজুর বুকের ধুকধুকানি হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সে ঢোক গিলে শাওনের দিকে তাকাল। অন্ধকারে বোঝ যাচ্ছে না, কিন্তু শাওনের মুখও নিশ্চয়ই ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শাওনকে না পেয়ে যদি এই বাসায় তাকে খুঁজতে থাকে তারা কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে?
রাজু আর শাওন শুনতে পেল শাওনের বাবা আর দারোয়ান ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে। দারোয়ান নিশ্চয়ই চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে তালাটা খুলতে পারছে না। শাওনের বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল?”
দারোয়ানটা খুব অবাক হলে বলল, “তালাটা খোলা যাচ্ছে না।”
“খোলা যাচ্ছে না মানে? ঠিক চাবি ঢুকিয়েছিস?”
“জি, ঠিকটাই ঢুকিয়েছি, এই দেখেন।”
“দেখি, আমার কাছে দে।”
এবারে নিশ্চয়ই শাওনের বাবা খুলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সেও খুলতে পারছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হঠাৎ মানুষটা রেগে উঠে বলল, “ব্যাটা উলুক, তুই নিশ্চয়ই ভুল চাবি ঢুকিয়ে তালাটা নষ্ট করেছিস।”
“না হুজুর, আমি ভুল চাবি ঢুকাই নাই–”
“চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা! বেতমিজ!”
গালি খেয়ে দারোয়ান মানুষটা একেবারে চুপ করে গেল, আর কোনো কথা বলল না। শাওনের বাবা এবারে শাওনকে ডাকল, “ফারজানা!”
শাওন হঠাৎ চমকে উঠে রাজুর হাত চেপে ধরল। রাজু ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেয়ো না।”
শাওনের বাবা আবার গলা উঁচিয়ে ডাকল, “ফারজানা! দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে এবারে ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠল, “ফা-র-জা-না!”
শাওন আবার চমকে উঠে রাজুকে শক্ত করে ধরে রাখল। মেয়েটা কী অসম্ভব ভয় পায় তার বাবাকে! রাজু আবার ফিসফিস করে বলল, “কোনো ভয় নেই শাওন, কোনো ভয় নেই–”
শাওনের বাবা এবার প্রচণ্ড জোরে দরজায় লাথি দিয়ে বলল, “কথা বল ফারজানা ফারজানা কোনো কথা বলল না এবং হঠাৎ করে দারোয়ানটির দুর্বল গলা স্বর শোনা গেল, বলল, “হুজুর একটা কথা–”
“কী কথা?”
“আপা একটা কথা বলেছিলেন–“
”কী কথা?”
“বলেছিলেন গলায় দড়ি দেবেন–”
“কখন বলেছে?”
“এই তো মাঝে মাঝেই বলেছেন।”
শাওনের আব্বা কয়েক মুহূর্তে কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী বলছিস তুই? সুইসাইড করেছে?”
“করতেও তো পারে! খুব মনের কষ্টে ছিলেন—”
দরজায় প্রচণ্ড জোরে লাথির শব্দ শোনা গেল। শাওনের আব্বা গলা উঁচিয়ে বলল, “ভাঙ দরজাটা। তাড়াতাড়ি।
রাজু হঠাৎ বুঝতে পারে তার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বেশি ভয় পেলে ব্যাপারটা কেন হয় কে জানে? এ-যাত্রা বেঁচে গেলে আজগর মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।