রাজু সাথে সাথে বাইনোকুলারটা আগুনালির হাতে দিয়ে বলল, “এক্ষুনি খাবার নিয়ে যাচ্ছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, তাকিয়ে দ্যাখো।”
আগুনালি বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে কিছু দেখতে পেল না। মানুষটা হেঁটে হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেছে। রাজু মাথা নেড়ে বলল, “আমি দেখেছি, ভিতরে গেছে।”
“তা হলে দেরি কোরো না, এক্ষুনি যাও। জানালা দিয়ে উঠতে পারবে তো?”মনে হয় পারব।”
“ভিতরে ঢুকে প্রথমে দরজাটা খুলে দেবে। চোরেরা যখন কোনো বাড়িতে চুরি করতে যায় তখন ভিতরে ঢুকে প্রথমেই পালিয়ে যাবার রাস্তাটা ঠিক করে।”
“আমি কি চুরি করতে যাচ্ছি?”
“চুরির মতোই। যাও।”
রাজু অন্ধকার গুঁড়ি মেরে বাসাটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। জানালা গলে ভিতরে ঢুকতে বেশি অসুবিধে হল না, তবে দরজাটা খুলতে খুব কষ্ট হল। ছিটকিনিটা ওপরে এবং খুব শক্ত করে লাগানো ছিল। যখন সেটা ভোলার চেষ্টা করছিল তখন শুধু মনে হচ্ছিল হঠাৎ বুঝি দারোয়ানটা এসে যাবে। রাজুর কপাল ভালো দারোয়ানটা এল না। শেষ পর্যন্ত ছিটকিনিটা খুলে পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে এসে শাওনের পাশের ঘর লুকিয়ে গেল। শাওনের সাথে দারোয়ানটা কথা বলছে, তবে ঠিক কী নিয়ে কথা হচ্ছে কিছু বোঝা গেল না। শাওন মনে হল রেগেমেগে কিছু-একটা বলল, দারোয়ানটাও তার উপর কিছু একটা বলল, তারপর মনে হল শাওন আরও রেগে গেল। তারপর অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই। কে জানে এখন হয়তো শাওন খাচ্ছে কিংবা মনের দুঃখে কাঁদছে। আসলে কী হচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই এবং রাজুরও চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। রাজু তাই চুপচাপ বসে রইল। মশাদের মনে হয় রাজুকে পেয়ে খুব আনন্দ হল, পিনপিন করে তারা রাজুকে এসে ছেকে ধরল। শুধু মেয়ে-মশারা কামড়ায়, যদি ছেলে-মশারাও কামড়ানো শুরু করত তা হলে তো বিপদ ছিল। রাজু মশাকে থাবা দিয়ে মারতেও পারছিল না, নিঃশব্দে যে-কয়টাকে তাড়ানো যায়। সে-কয়টাকে তাড়িয়ে কোনোমতে বসে থাকে। মশারা মনে হয় আস্তে আস্তে টের পেয়ে গেল রাজু কাউকে থাবা মারবে না এবং তাদের সাহস আস্তে আস্তে বেড়ে যেতে থাকে–একটা দুইটা মশা নাকের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করল, অনেক কষ্ট করে তখন রাজুকে তার হাঁচি সামলে রাখতে হল।
এভাবে কতক্ষণ সে বসেছিল তার খেয়াল নেই। সময়টা হয়তো খুব বেশি নয়, টেনেটুনে আধা ঘণ্টাও হবে না, কিন্তু তার মনে হল বুঝি অনন্ত কাল। শেষ পর্যন্ত পাশের ঘর থেকে দারোয়ানটা বের হয়ে দরজায় আবার তালা মেরে থালাবাসন নিয়ে নিচে নেমে গেল।
রাজু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে পা টিপে টিপে তার লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসে। খুব সাবধানে সে শাওনের ঘরের সামনে দাঁড়াল, কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, নিচে থেকে দারোয়ানটা আবার উপরে উঠে আসছে কি না। মানুষটা মনে হয় নিচেই আছে, থালাবাসন ধোয়াধুয়ি করছে। রাজু পকেট থেকে চাবি বের করে তালায় গালাল, তার বুক ধুকধুক করছে, কে জানে শাওন তালাটা পালটাতে পেরেছে কি না!
চাবিটা ঘোরাতে তালাটা টুক করে খুলে গেল। রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে দরজার কড়াটা সরিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। ঠিক দরজার সামনে বড় বড় চোখে শাওন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সত্যিই রাজু দরজা খুলে ঢুকেছে। শাওন কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, রাজু তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল। পা টিপে, টিপে সামনে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল, “চলো যাই।”
শাওন ফিসফিস করে বলল, “কেমন করে যাব?”
“বাইরে গিয়ে ঠিক করব। চলো।”
শাওন দুই পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল পরে নিয়ে বলল, “চলো।”
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাজু দেখল একটা টেবিলের উপরে এক কাঁদি কলা। কলাগুলি দেখে হঠাৎ সে বুঝতে পারল তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। সে কলার কাঁদিটা হাতে তুলে নেয়। শাওন অবাক হয়ে বলল, “তোমার খিদে পেয়েছে?”
রাজু একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “এই একটু।”
“তুমি দাঁড়াও, আমার কাছে বিস্কুটও আছে।”
“বিস্কুট লাগবে না।”
শাওন তবু কথা শুনল না, যে-কোনো মুহূর্তে দারোয়ান ওপরে চলে আসতে পারে জেনেও সে তার বিছানার ওপর থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এল। রাজু খুব সাবধানে দরজার পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেয়, তার ভিতর দিয়ে প্রথমে রাজু এবং রাজুর পিছনে পিছনে শাওন বের হয়ে এল। রাজু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল তালাটা লাগাবে না খোলা রাখবে, মনে হল লাগিয়ে রাখাই ভালো–ভিতরে নেই সেটা জানতে না হলে সময় লাগবে বেশি। সে তালাটা লাগিয়ে দিল।
ঘর থেকে বের হয়েছে সত্যি, কিন্তু বাসা থেকে এখনও বের হয়নি। সেটা ঠিক কীভাবে করবে সে এখনও জানে না। আগুনালি যতক্ষণ পর্যন্ত একটা কায়দা-কানুন করে দারোয়ানকে দরজা থেকে না সরাচ্ছে, মনে হয় কিছু করার নেই। রাজু ফিসফিস করে বলল, “এই দিকে চলল, এখন লুকিয়ে থাকতে হবে।”
শাওন ফিসফিস করে বলল, “আমরা বের হব কেমন করে?”
এখনও ঠিক করিনি। রাজুও গলা নামিয়ে বলল, “বাইরে আমার বন্ধু আছে, সে ব্যবস্থা করবে।”
“এখন কী করব?”
“ভিতরে লুকিয়ে থাকতে হবে।”
“কোথায় লুকাবে?”
“চলো ঐ পাশে যাই।”
রাজু শাওনকে নিয়ে বাসার অন্য পাশে চলে এল। একটা ভাঙা দেয়ালের পাশে দুজন গুঁড়ি মেরে বসে। এখান থেকে বাইরে দেখা যায়, আগুনালি সাগরকে নিয়ে সে জায়গায় অপেক্ষা করছে সেই জায়গাটাও মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। যখন সে তার আগুন নিয়ে কিছু একটা কায়দা-কানুন শুরু করবে এখান থেকে সেটা খুব সহজে দেখা যাবে।