“ভূত?”
শাওনা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে। রাজু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এরকম ভাবে থেকেও একজন মানুষ এত সুন্দর করে হাসতে পারে!
“তুমি যখন ছাদে হাঁট তুমি একা থাক?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সিঁড়িতে দারোয়ান বসে থাকে। আমার বাবা আসে কখনও কখনও।”
“রাত্রিবেলা তুমি ঘরে বাতি জ্বালাও না?”
“মাঝে মাঝে একটা হারিকেন দেয়, কিন্তু তখন জানালা বন্ধ রাখতে হয়, যেন বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পারে।”
রাজু কোনো কথা বলল না, একজন মানুষকে অন্য মানুষ কীভাবে এত কষ্ট দিতে পারে? বাইরে দারোয়ান কী করছে কে জানে, কিন্তু এখন বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রাজু নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, “শাওন, এখন যেতে হবে। তালাটা রেখো ঠিক করে। তুমি তালাটা পালটাতে পেরেছ কিনা সেটা বুঝব কেমন করে?”
“তোমাকে আবার আসতে হবে।”
“ঠিক আছে, আসব। যাই এখন।”
“সাবধানে থেকো।”
রাজু আবার কার্নিস বেয়ে হেঁটে এসে জানালা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল, তারপর পা টিপে টিপে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে থাকে। বাইরে আগুনালি বেশ কয়েকটা আগুন তৈরি করে হাতে মশাল নিয়ে তার সামনে লাফালাফি করছে, আর দারোয়ানটা তাকে ধরার চেষ্টা করছে। অন্য যে-কোনো সময় এরকম একটা দৃশ্য দেখলে হাসিতে তার পেট ফেটে যেত, কিন্তু এখন সবকিছু নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে হাসাহাসির অবস্থা নেই। রাজু খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতেই আগুনালি তার লাফঝাঁপ বন্ধ করে দিল, তাকে নিশ্চয়ই বের হতে দেখেছে। আগুনালি বলল, “যাই আমার গোরু খুঁজে দেখি। ভেবেছিলাম এখানে একটা আগুন করব, কিন্তু করতে দিলেন না।”
“ভাগ ব্যাটা পাগলা–”
“পাগল-ফাগল বলবেন না। বেশি ভালো হবে না কিন্তু–”
“কেন, কী করবি?”
এই আগুনটা মুখের মাঝে ঠেসে ধরব, একেবারে জন্মের মতো মুখপোড়া বান্দর হয়ে যাবেন।”
“কী বললি?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না? আসেন কাছে–” বলে আগুনালি লোকটার দিতে এগুতে থাকে–লোকটা কী করবে বুঝতে না পেরে পিছিয়ে আসে। আগুনালি হঠাৎ মশালটা মানুষটির দিকে ছুঁড়ে দিল, লাফিয়ে সরে যেতে গিয়ে মানুষটা খুব খারাপভাবে আছাড় খেয়ে পড়ল, আর সেই ফাঁকে আগুনালি এক দৌড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রাজু আর সাগর একটা গাছের নিচে অপেক্ষা করছিল, আগুনালি ছুটে এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। তাদের একটু ভয় হচ্ছিল যে, মানুষটা বুঝি আগুনালির পিছুপিছু ছুটে আসবে। কিন্তু ছুটে এল না, বেকায়দা আছাড় খেয়ে পড়ে খুব খারাপভাবে ব্যথা পেয়েছে। বাসার সামনে আগুনগুলি কোনোভাবে নিভিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আগুনালি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ফাস্ট ক্লাস! তারপর রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, সবকিছু ঠিক ঠিক হয়েছে?”
“তা হয়েছে, কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
“কী ঝামেলা?”
“আমাকে আবার ঢুকতে হবে।”
“কেন?”
“যদি তালাটা বদলাতে পারে তা হলে খুলে শাওনকে বের করতে হবে না?”
“কিন্তু ঝামেলাটা কী?”
“শাওন বলেছে এই একটু পরেই নাকি দারোয়ান খাবার নিয়ে যাবে, তখনই যদি তালাটা বদলে দেয় তা হলে তো আমার ভিতরেই থাকা উচিত ছিল। শুধু শুধু বের হলাম। একবারে দুজনে মিলে বের হয়ে আসতে পারতাম।”
আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেটা কোনো সমস্যা না, তুমি যতবার চাইবে ততবার আমি দারোয়ানকে দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাব। আমার উপর কী রকম রেগেছে দেখেছ? এখন আমাকে দেখলেই আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসবে।”
“যদি ধরে ফেলে?”
“কোনোদিন ধরতে পারবে না। দশ পা দৌড় দিলেই ব্যাটার দম ফুরিয়ে যাবে। শুধু যদি ধরে ফলে, আমার কাছে আছে আগুন পাখুনি। এমন একটা দাগা দিয়ে দেব যে ব্যাটা জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে।”
রাজু গাছের আড়াল থেকে বাসার ভিতরে উঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল, “সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনোরকম হৈচৈ না করে ঢোকা যায়। বারবার কিছু একটা হৈচৈ করলে সন্দেহ করা শুরু করতে পারে।”
“তা হলে কীভাবে ঢুকবে?”
“যখন মনে কর দারোয়ানটা উপরে শাওনের ঘরে খাবার নিয়ে যাবে তখন যদি আমি চুপিচুপি ঢুকে গিয়ে পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকি?”
সাগর ভয়ে-পাওয়া গলায় বলল, “যদি দেখে ফেলে?”
“দেখবে কেন? দেখবে না। আমি লুকিয়ে থাকব। তবু যদি দেখে ফেলে তা হলে দৌড় দেব। যদি ধরে ফেলে তা হলে আগুনালি তার আগুন পাখুনি নিয়ে আসবে বাঁচানোর জন্য। কী বল?”
আগুনালি মাথা নাড়ল, একবার দারোয়ান মানুষটিকে ঘোল খাইয়ে তার সাহস অনেক বেড়ে গেছে–সে এখন কোনোকিছুতেই আর ভয় পায় না। রাজুকে বলল, “তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি লোকটা কী করছে, যদি দেখি খাবার নিয়ে ওপরে যাচ্ছে তা হলে ইঙ্গিত করব, তুমি তখন চলে এসো।”
রাজু বলল, “তোমার জানালার কাছে যেতে হবে না, এখান থেকেই দেখা যাবে, আমাদের কাছে বাইনোকুলার আছে না?”
“তাই তো! মনেই থাকে না আমার।”
রাজু চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দেয়, প্রথমে মনে হয় বেশি অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দারোয়ানটা স্পষ্ট হয়ে যায়, উবু হয়ে বসে বসে কিছু-একটা করছে। দারোয়ানটা উঠে দাঁড়াল, হাতে একটা ট্রে-তার মাঝে পানির গ্লাস, একটা প্লেট-তার মাঝে ভাত, সাথে একটা ছোট বাটি। দেখে খুব একটা আহামরি খাবার বলে মনে হচ্ছে না। দারোয়ানটা ট্রে হাতে নিয়ে ভিতরের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।