আগুনালি তার জিনিসপত্র নিয়ে সাবধানে নাহোর মঞ্জিরের দিকে হাঁটতে থাকে, বাসার সামনে মাইক্রোবাসটা নেই, তার মানে শাওনের বাবা আবার চলে গেছে। এখন হয়তো শুধু দারোয়ানটাই আছে বাসার সামনে। ব্যাপারটা তা হলে সহজই হওয়ার কথা।
আগুনালি গিয়ে বন্ধ দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে থাকে, প্রায় সাথে সাথেই দারোয়ানটা বের হয়ে আসে। আগুনালিকে দেখে মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল। আগুনালি অবিশ্যি মোটেও ঘাবড়ে গেল না, গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “দুপুরে আমি একটা গোরু এনেছিলাম, সেটা দেখেছেন?”
আগুনালির কথা শুনে মানুষটা যত রাগ হল তার থেকে অবাক হল আরও বেশি। আগুনালিকে ধরে প্রায় মার দেয়-দেয় অবস্থা–হাত তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “তোর গোরু আমি কোলে তুলে রেখেছি? বাসার ভিতরে মানুষ গোরু খোঁজ করে শুনেছিস কোনোদিন?”
আগুনালি উদাস গলায় বলল, “ভাঙা বাড়ি, কোনো ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেছে কি-না কে জানে!”
মানুষটা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ আগুনালি জিজ্ঞেস করল, “ম্যাচ আছে?”
“ম্যাচ? ম্যাচ দিয়ে কী করবি?
“কাজ ছিল–বলে আগুনালি নিজের পকেটে ম্যাচ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করে ম্যাচটা পেয়ে যায়। সে ভিতর থেকে একটা কাঠি বের করে এক হাতেই কাঠিটা ফস করে জ্বালিয়ে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়–কাঠিটা যখন নিচের দিকে নেমে আসছে সে তার হাতের মশালটা এগিয়ে দেয় সাথে সাথে দপ করে মশালটা জ্বলে ওঠে। মশালটা সে কী দিয়ে তৈরি করেছিল কে জানে, কিন্তু সেটা একটা ছোট বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে বিশাল একটা আগুনের কুণ্ডলী তৈরি করে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। দারোয়ান মানুষটা ভয়ে চিৎকার করে পিছনে সরে গেল সাথে সাথে।
আগুনালি ইচ্ছে করে সেই বিশাল আগুনটি লোকটির নাকের ডগার কাছে ধরে রাখে, মানুষটা কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?
“আগুন জ্বালালাম।”
“কেন আগুন জ্বালচ্ছিস এখানে?”
“অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে–তাছাড়া গোরুটা কোথায় গেল, অন্ধকারে রাস্তা-না হারিয়ে ফেলে!”
মানুষটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “দূর হ এখান থেকে! দূর হ! পাগলা কোথাকার–”
আগুনালি দারোয়ানটার গালিগালাজে কান দিল না, খুব ধীরেসুস্থে নিচে নেমে এসে অল্প কিছু দূর গিয়ে মাটিতে মশালটা গেঁথে দিয়ে পকেট থেকে তার বোমাটা বের করে সলতের মতো জায়গাতে আগুন লাগিয়ে সে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। খানিকটা উপরে উঠে সেটা নিচে শব্দ করে পড়তেই দপ করে বেশ খানিকটা জায়গায় দাউদাউ করে আগুন লেগে যায়।
দারোয়ানটা এবারে বাসা থেকে নেমে আগুনালির দিকে চিৎকার করতে করতে তেড়ে গেল, “কী হচ্ছে, কী হচ্ছে এখানে?”
আগুনালি তার আগুনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “আগুন! আগুন আমার বড় ভালো লাগে!”
মানুষটা দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “তোর আগুন আমি বের করছি, ব্যাটা পাগল কোথাকার”
আগুনালি মশালটা হাতে তুলে নিতেই মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল, যে অবলীলায় এত বড় বিশাল একটা আগুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাকে একটু ভয় পেতে হয়।
রাজু দরজার দিকে তাকাল, মানুষটি দরজা থেকে নেমে নিচে চলে গেছে, তার দৃষ্টি এখন আগুনালির দিকে। এই সুযোগ যে শুট করে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। আগে একবার এসেছে, তাই কোনদিকে যেতে হবে জানে। আবছা অন্ধকার সিঁড়ি ধরে সে উপরে উঠতে উঠতে শুনতে পেল বাইরে বাসার দারোয়ানটা মুখ-খারাপ করে আগুনালিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
দোতলায় একটু হেঁটেই শাওনের ঘরটা পাওয়া গেল। এখনও দরজায় তালা ঝুলছে। রাজু পকেট থেকে তালাটা বের করে মিলিয়ে দেখল। দেখতে হুবহু একরকম। দরজায় টোকা দেবে কি না ভাবল একবার, কিন্তু না দেওয়াই স্থির করে আগের বারের মতো কার্নিস ধরে হেঁটে যেতে শুরু করে। দিনের বেলায় যে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল সেটা বন্ধ। রাজু জানালায় টোকা দিয়ে নিচু গলায় ডাকল, “শাওন!”
প্রায় সাথে সাথেই শাওন জানালা খুলে দেয়। আবছা আলোয় তাকে অন্য জগতের একজন মানুষের মতো মনে হচ্ছে। জানালার শিক ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “তুমি আবার এসেছ?”
“হ্যাঁ শাওন। আমি একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি। বাইরে দারোয়ানকে আমার বন্ধু ব্যস্ত রেখেছে। সময় বেশি নেই।”
“কী জিজ্ঞেস করবে?”
“তোমার ঘরে যখন কেউ ঢোকে তখন বাইরের তালাটা কোথায় রাখে?”
“খেয়াল করে দেখিনি। শাওন খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “দাঁড়াও মনে পড়েছে, মনে হয় এনে টেবিলের উপরের রাখে–একবার দেখেছিলাম।”
“গুড! রাজু পকেট থেকে তালাটা বের করে শাওনের হাতে দিয়ে বলল, “এই তালাটা তোমার কাছে রাখো। পরের বার যখন কেউ তালা খুলে ভিতরে ঢুকবে তখন এই তালাটা পালটে দেবে যে মানুষটা বুঝতে না পারে। আমরা এসে তখন এই তালা খুলে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব। পারবে?”
“জানি না।”
“তোমাকে পারতেই হবে।”
শাওন একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “দেখি পারি কি না।”
“তোমার ঘরের ভিতরে কখন মানুষ আসে?”
“এই তো একটু পরে খাবার আনবে। তারপর যখন আরও অনেক রাত হয় তখন একবার বের হতে দেয়–আমি তখন ছাদে একা একা হাঁটি।”
রাজু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমরা দেখেছি।”
“দেখেছ?”
“হ্যাঁ তাই তো আমরা জানলাম তুমি এখানে আছ। প্রথমে অবিশ্য ভেবেছিলাম তুমি ভূত।”