রাজু তখনও নাক-মুখ কুঁচকে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। যদি এই বুদ্ধিটা কাজ না করে তা হলে অন্য বুদ্ধি খুঁজে বের করতে হবে।
টিফিন-ক্যারিয়ার হতে ছেলেটা টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপরে রেখে দেয়। রাজু রান্নাঘরে গিয় কিছু থালাবাসন নিয়ে এসে খেতে বসে।
খাবারে এখনও অনেক ঝাল–মাছের টুকরো, আলু ডালে ধুয়ে নিতে হল। খেতে খেতে একটু পরেপরেই রাজুর শাওনের কথা মনে পড়ল। বেচারি একা একা ঐ বাসাটায় আটকা পড়ে আছে কে জানে তাকে ঠিক করে খেতে দিচ্ছে কি
দুপুরে খাবারের পর রোজ তাদের একটু আলসেমি লাগে, সোফায় কিংবা বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আজ অবিশ্যি সেরকম কিছুই হল না, তারা তিনজনই এত উত্তেজিত হয়েছিল যে, একবারও বিশ্রাম করার কথা মনে পড়ল না। বাইরের বারান্দায় তিনজন হাঁটাহাঁটি করতে করতে কীভাবে শাওনকে ছুটিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়, বড় কোনো মানুষের সাহায্য না নিয়ে কীভাবে এটা করা যায় সেটা ভেবে তারা কোনো কূলকিনারা পেল না। সাগর একটু পরে-পরে বলতে লাগল মামার বন্দুকটা নিয়ে গিয়ে গুলি করে শাওনের বাবার বারোটা বাজিয়ে দিতে–সেটা বলা খুব সহজ, কিন্তু বন্দুক দিয়ে সত্যি সত্যি কি আর কাউকে গুলি করা যায়? আজগর মামা সাগরকে যে খেলনা-পিস্তলটা দিয়েছেন সেটা বরং আরও ভালো অস্ত্র, সেটা দিয়ে ভয় দেখানো সোজা। সত্যি সত্যি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে আগুনালি তার আগুনি পাখুনি নিয়ে আসতে পারে, মুখের উপর আগুনের হলকা ছুঁড়ে দিলে মানুষ সাধারণত বাপ-বাপ করে পালায়।
কী করা যায় সেটা নিয়ে রাজু, আগুনালি আর সাগর আরও ভাবনাচিন্তা করতে লাগল। ঠিক হল বিকেলবেলায় দিকে তারা বের হবে। তার আগে আগুনালি বাড়ি যাবে তার নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতে। কিছু নতুন জিনিস তৈরি করার জন্যে কিছু কেনাকাটা আছে, সেজন্যে রাজু তাকে বেশকিছু টাকা ধরিয়ে দিল। আগুনালি ঠিক নিতে চাচ্ছিল না, কিন্তু এখন এসব ব্যাপার নিয়ে আর দ্ৰতা করার সময় নেই।
সারা দুপুর রাজু বারান্দায় বসে বসে চিন্তা করে কাটাল। যেভাবেই সে চিন্তা করে, কোথাও কোনো কূলকিনারা পায় না। রাজু প্রথমবার আজগর মামার অভাব সত্যিকারভাবে অনুভব করে। যদি এখন আজগর মামা থাকতেন কী সহজেই-না পুরো সমস্যাটার সমাধান করে দিতে পারতেন, তাদের কিছুই চিন্তা করতে হত না। কিন্তু এখন তাদের কিছুই করার নেই–নিজেরা নিজেরা গিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করতেই হবে। যদি ধরা পড়ে যায় তখন কী হবে? শাওন বলেছে তার বাবা নাকি ভয়ংকর মানুষ রাজাকাররা সবসময় ভয়ংকর হয়। একাত্তর সালে সব প্রফেসর ডাক্তারদের নিয়ে ধরে ধরে মেরে ফেলেছিল। যারা প্রফেসর ডাক্তারদের মেরে ফেলতে পারে তারা হয়তো বাচ্চা ছেলেদেরও মেরে ফেলতে পারে। যদি তাদের ধরে ফেলে তখন কী হবে? সাগরকে যদি ধরে ফেলে? রাজু হঠাৎ শিউরে উঠল।
.
বিকেলবেলা আগুনালি এসে দেখে রাজু বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ করে বসে আছে। সে রাজুকে খুব বেশি বার গভীরভাবে চিন্তা করতে দেখেনি, তাই তার মুখ দেখে ঘাবড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজু, তোমার শরীর খারাপ করেছে?”
রাজু চমকে উঠে আগুনালিকে দেখে বলল, “না! শরীর খারাপ হবে কেন?”
“মুখ দেখে মনে হল–
সাগর কাছে দাঁড়িয়েছিল। সে মুখ বাঁকা করে বলল, “ভাইয়া সবসময় মুখ এরকম করে রাখে।”
রাজু রেগে কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল–এখন এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে রাগারাগি করার সময় নেই। সে আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের তালাটা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
“কীভাবে ঢুকবে? দারোয়ানটা যদি থাকে?”
“কোনোভাবে দারোয়ানটাকে দরজা থেকে সরাতে হবে।”
“কীভাবে সরাব?”
”তুমি তোমার আগুন দিয়ে কিছু-একটা কায়দা-কানুন করতে পারবে না?”
আগুনালি এক মুহূর্ত চিন্তা করে দাঁত বের করে হেসে বলল, “একশো বার। এমন কায়দা করব দারোয়ানের বারোটা বেজে যাবে!”
সাগর চোখ বড় বড় করে বলল, “কী করবে তুমি?”
“চলো, দেখবে সময় হলে।”
তিনজনের ছোট দলটা আবার রওনা দেয় নাহার মঞ্জিলের দিকে। আগুনালির হাতে একটা বাজারের ব্যাগ, তার মাঝে আগুন লাগানোর নানা ধরনের জিনিসপত্র, কখন কোনটা কাজে লাগবে জানা নেই, তাই পুরো ব্যাগটাই সাথে নিয়েছে। রাজুর পকেটে বাসার তালাটা। মামার আলমারির তালাটা বাসার দরজায় লাগিয়ে এসেছে। তালাটা ছোট, মামার বাসায় চোর-ডাকাত এলে মনে হয় ধমক দিয়েই এ-তালাটা খুলে ফেলতে পারবে, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।
তিনজন হেঁটে হেঁটে যখন নাহার মঞ্জিলের কাছে এসে পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যে হয়-হয় করছে। আগুনালি তার ব্যাগটা একটা গাছের গোড়ায় রেখে সেখান থেকে কিছু ন্যাকড়া বের করে একটা লাঠির আগায় প্যাঁচাতে থাকে। তারপর সেটার মাঝে কয়েক ধরনের তেল ঢালে, কোনটা কেরোসিন কোনটা পেট্রোল কোনটা তাৰ্পিন–কোনটা দিয়ে কী হবে সেটা শুধুমাত্র আগুনালিই জানে। তারপর ছোট ছোট বোতলে নানারকম জিনিসপত্র ঢেলে ন্যাকড়া ঢুকিয়ে একধরনের বোমার মতো তৈরি করল। সাথে তার বিখ্যাত আগুনি পাখুনি এবং অনেকগুলি ম্যাচ নিয়ে রওনা হল। ঠিক করা হল আগুনালি দারোয়ানকে বাসার বড় দরজা থেকে সরিয়ে নেয়ামাত্রই রাজু হুট করে ভিতরে ঢুকে পড়বে। সাগরও গোঁ ধরল সে রাজুর সাথে ভিতরে যাবে, তাকে অনেক কষ্টে শান্ত করা হল, বলা হল শাওনকে উদ্ধার করে আনার পর তার ওপর ভার দেওয়া হবে শাওনকে চোখে-চোখে রাখার। রাজু আর আগুনালি এমন একটা ভাব করল যে, সেই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাগরের মতো একজন মানুষ ছাড়া সেই কাজটা করা সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত সাগর রাজি হল।