রাজু আর সহ্য করতে পারল না, জানালার শিক ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুমি চুপ করো, এভাবে কথা বোলো না।”
“কেন বলব না? সেই থেকে আমার এত আনন্দ হচ্ছে যে, আমি আর হাসি থামাতে পারছি না। নিচের টুকরোটি দিয়ে একটু কেটে দেখেছি, এই দ্যাখো”
মেয়েটা তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সত্যি সত্যি কবজির কাছে খানিকটা কাটা, রক্ত জমে আছে। মেয়েটা খুশি-খুশি গলায় বলল, “বাবা ভেবেছিল সে মাকে শিক্ষা দেবে–উলটো আমি বাবাকে শিক্ষা দিয়ে দেব!”
মেয়েটা হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “শুধু একটা সমস্যা। কাঁচের টুকরো দিয়ে কাটতে খুব ব্যথা লাগে, ব্লেড হলে কী সুন্দর একবারে ঘ্যাঁচ করে কেটে দেওয়া যাবে–তুমি দেবে তো আমাকে একটা ব্লেড এনে? বলে দেবে।
“না–” রাজু মাথা নাড়ল, “আমি তোমাকে ব্লেড এনে দেব না। আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব।”
মেয়েটা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল আর হঠাৎ মেয়েটির অপূর্ব সুন্দর দুটি চোখ গভীর বিষাদে ভরে গেল। রাজু দেখল মেয়েটির চোখ হঠাৎ পানিতে ভরে উঠেছে আর সেটা দেখে রাজুর বুকের ভিতরে হঠাৎ এত কষ্ট হতে থাকে যে সেটা বলার মতো নয়। সে জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “তুমি মন-খারাপ কোরো না।
আমি তোমাকে যেভাবে পারি এখান থেকে নিয়ে যাব। খোদার কসম বলছি!”
মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, “তুমি পারবে না রাজু। কিন্তু তুমি যে বলেছ সেটা শুনেই আমার এত ভালো লাগছে! আমার চারপাশে এখন শুধু খারাপ মানুষ–এত খারাপ যে তুমি চিন্তা করতে পারবে না। তোমাকে যদি ধরতে পারে তা হলে আমার যত বড় বিপদ তোমার তার থেকে আরও বড় বিপদ হয়ে যাবে।”
“হোক। আমি ভয় পাই না। তুমিও ভয় পেয়ো না। যেভাবে হোক আমরা তোমাকে বাঁচাব-”
ঠিক এরকম সময় হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ শুনতে পেল। রাজু বাইরে তাকায়, দেয়ালের পাশে আগুনালি দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিছু-একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। রাজু সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়াল, মেয়েটিকে বলল, “আমাকে এখনই যেতে হবে, “কেউ-একজন আসছে।”
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, “যাও। তাড়াতাড়ি যাও।”
রাজু এক পা গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, “তোমার নাম কী?”
“আমার মা আমাকে ডাকে শাওন। আমার বাবা ডাকে ফারজানা।”
“আমি তোমাকে তা হলে শাওন ডাকব।”
“ঠিক আছে।”
রাজু একটু হাসার ভঙ্গি করে দ্রুত কার্নিস বেয়ে ছুটে যেতে থাকে।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই আগুনালি আর সাগরকে নিয়ে রাজু যখন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে যাবার জন্যে ছুটে যাচ্ছিল, ঠিক তখন একটা মাইক্রোবাস নাহার মঞ্জিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাসের দরজা খুলে একটা দীর্ঘকায় মানুষ নামল। মানুষটির চেহারা সুন্দর, ফরসা মুখে কালো চাপদাড়ি। চেহারায়, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একধরনের আভিজাত্যের চিহ্ন রয়েছে, দেখে একধরনের সম্ভ্রম জেগে ওঠে।
জঙ্গলে গাছের ফাঁক দিয়ে মানুষটিকে দেখে রাজুর ভিতরে অবশ্য কোনো সমবোধ জেগে উঠল না, মানুষটি শাওনের বাবা, কেউ তাকে বলে দেয়নি, কিন্তু তবুও তার বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না।
শাওনের বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত না ভিতরে ঢুকে গেল ততক্ষণ রাজু, সাগর আর আগুনালি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। একেবারে ভিতরে ঢুকে যাবার পর তিনজন চুপিচুপি গাছের আড়ালে আড়ালে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। হেঁটে হেঁটে বেশ অনেক দূর সরে যাবার পর রাজু তার মুখ খুলল।
রাজুর মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে আগুনালি চুপ মেরে যায়, এরকম একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সে বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারছিল না। শাওনের দুঃখে সাগরের চোখে একেবারে পানি এসে যায়, সে সাবধানে চোখ মুছে বলল, “আমরা এখন কী করব ভাইয়া?”
“শাওনকে উদ্ধার করতে হবে।”
“কেমন করে উদ্ধার করবে?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “এখনও ঠিক করিনি। চল বাসায় গিয়ে দেখি মামা এসেছে কি-না। মামা চলে এলে সবচেয়ে ভালো হয়, তা হলে মামা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।”
বাসায় এসে দেখল মামা তখনও আসেননি, বারান্দায় টিফিন-ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে হোটেলের ছেলেটা বসে আছে। খাবার দেখে হঠাৎ তিনজনের একসাথে খিদে লেগে গেল। রাজু চাবি বের করে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তালাটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ তার একটা জিনিস মনে হয়েছে, মানুষ কোনো ঘরের তালা খুলে সবসময় তালাটা কি ভিতরে নিয়ে আসে? তা-ই যদি হয় তা হলে সে একটা জিনিস করতে পারে শাওনকে এই তালাটা দিতে পারে, যখন তার বাবা তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তালাটা কোথাও রাখবে, শাওন কোনোভাবে তালাটা পালটে দেবে। তার বাবা কিছু জানবে না, আবার তাকে যখন তালা মেরে রেখে যাবে তখন এই তালাটা দিয়ে তালা মেরে যাবে। যখন আবার বাসায় কেউ থাকবে না রাজুরা গিয়ে তালা খুলে শাওনকে বের করে নিয়ে আসবে।
পুরো ব্যাপারটা রাজু চিন্তা করে দেখে, যদি শাওন তালাটা পালটে দিতে পারে তা হলে বুদ্ধিটা কাজ করে করার কোনো কারণ নেই। সে ঘুরে আগুনালির দিকে তাকাল। আগুনালির জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“শাওনকে এই তালাটা দিতে হবে।”
“কেন?”
রাজু তখন পুরো বুদ্ধিটা খুলে বলল, “শুনে আগুনালি মাথা নেড়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস বুদ্ধি, ফাস্ট ক্লাস!”